Breaking News

অনুপ্রবেশকারী কত? মনগড়া তথ্যে ধরা পড়ছে বিজেপির মতলব

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহ বিজেপির বিভিন্ন স্তরের নেতারা ক্রমাগত বলে চলেছেন, ভারতে অনুপ্রবেশ একটা ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, অনুপ্রবেশের জন্য দেশের এবং বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলির জনবিন্যাসের চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। এ বারের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, অনুপ্রবেশকারীরা দেশের সম্পদ দখল করে নিচ্ছে। ২০২৪ এর নভেম্বরে ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচনের সময় বিজেপির পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয় যে, বাংলাদেশ থেকে মুসলিমরা মালদা জেলা দিয়ে ভারতে ঢুকছে, তারপর সাঁওতাল মেয়েদের বিয়ে করে আদিবাসীদের জমি দখল করে নিচ্ছে। আসামের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সুর আরও চড়া। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীরা জাতীয় নিরাপত্তার সামনে ভয়াবহ বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তা হলে হিমন্তবাবুর কথার ভিত্তিতে প্রশ্ন ওঠে, এ রকম একটা ভয়াবহ জাতীয় বিপদ সৃষ্টি হল যে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শাসনে, তাঁরা কেন পদত্যাগ না করে বহাল তবিয়তে বসে আছেন?

অনুপ্রবেশ নিয়ে প্রচারের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ করুন। নভেম্বরে বিহার বিধানসভা নির্বাচন। এই উপলক্ষে গত ১৭ অক্টোবর পাটনার জনসভায় অমিত শাহ বলেন, ‘‘অনুপ্রবেশ সমস্যা গুজরাটে, রাজস্থানে কেন নেই? অসমে এখন কেন অনুপ্রবেশ হচ্ছে না? কারণ সেখানে বিজেপি সরকার। বাংলার ভোটারদের বলছি অনুপ্রবেশ রুখতে হলে দিদির সরকার পাল্টে দিন’’ (আনন্দবাজার পত্রিকা ১৯/১০/২৫)। এই বক্তব্য দেখিয়ে দেয় অনুপ্রবেশ ভোটের একটি লোভনীয় ইস্যু।

বিদেশিরা ঢুকে আমাদের দেশের সম্পদ দখল করে নিক, এটা কোনও ভারতবাসী চায় না। ওরা অবৈধভাবে এসে সরকারি সুবিধা কুক্ষিগত করে নিক, এটাও কেউ চায় না। ফলে অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য সরকারকে তার দায়িত্ব কঠোরভাবে পালন করতে হবে, এ ক্ষেত্রে কোনও শিথিলতা দেখানো চলবে না, অবহেলা চলবে না– এটা জনগণেরই দাবি। কিন্তু অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে যিনি এত বলছেন সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত এগারো বছর ধরে দেশের শাসন ক্ষমতায়, অথচ অনুপ্রবেশ ঘটে নাকি জনবিন্যাস পাল্টে দিচ্ছে, এটা কি করে সম্ভব? তবে কি মোদির হাতে দেশ বিপন্ন?

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রমুখ প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ বলছেন, ভারতকে আমরা ধর্মশালা বানাতে দেব না। অথচ কি অদ্ভুত দেখুন! এরাই বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য সিএএ আইন পাশ করালেন। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখরা এলে তাকে দেওয়া হবে নাগরিকত্ব ,আর কোনও মুসলিম এলে তাকে ধরে চালান করা হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে অথবা পুশ ব্যাক করা হবে– এটা কি শুধুই দ্বিচারিতা? বিজেপি সরকারের এই যে অবস্থান তা একটা স্পষ্ট বার্তা দিতেই, সেটা হল বিজেপি হিন্দুর রক্ষাকর্তা। মুসলিম বিরোধিতা ছাড়া ওরা হিন্দু প্রীতি দেখাতে পারে না। কতটা দেউলিয়া এদের রাজনীতি! একটা কথা মনে রাখা জরুরি– চাকরি বাকরি ব্যবসার প্রয়োজনে অর্থনৈতিক কারণে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার ঘটনা সব দেশেই চলছে। বহু ক্ষেত্রে বেআইনি পথে ভারত থেকে বহু মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। তেমনি বাংলাদেশ থেকে কিছু আসতে পারে। যদি এসে থাকে তার বিচার হবে আইনমাফিক। আইনি না বেআইনি তার ফয়সালা হবে আদালতে। তাকে রাজনৈতিক ময়দানে টেনে আনার যৌক্তিকতা কী?

অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা নিয়ে বিজেপির নানা মুনির নানা মত। ২০০২ সালে কেন্দ্রের প্রাক্তন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবানি বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গেই অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ৮ কোটির একটু বেশি। সেই হিসাবে আদবানির মতে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গেই ২ কোটি। কোনও কোনও নেতা এমনও বলছেন সংখ্যাটা ৫ কোটি। কেউ কেউ আবার বলছেন সব মিলিয়ে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা দশ কোটি। এ বারের ১৫ আগস্ট দিল্লির লাল কেল্লার ভাষণে বা ২২ আগস্ট কলকাতার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদি অবশ্য সংখ্যাটা চেপে যান। কেবল হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন অনুপ্রবেশের ফানুস।

২০১৬ সালের একটি তথ্য দেওয়া যাক। লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বলেছিল, ভারতে দু-কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী আছে। কী ভাবে এই দুই কোটি গণনা করা হল, কোথায় তাদের বাস, কেউ জানে না। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আরেকটি তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায় ২০১৬ সালে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় মোট ১৬০১ জন বাংলাদেশি ধরা পড়েছিল, ২০১৭ সালে ধরা পড়েছে ৯০৭, ২০১৮-তে ধরা পড়েছে ৮৮৪ জন, ২০১৯-এ ধরা পড়েছে ১১০৯ এবং ২০২০ সালে ধরা পড়েছে ৯৯৫ জন। অর্থাৎ বেআইনি অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে এই সংখ্যাটা গড়ে প্রতি বছর এক হাজারের একটু বেশি।

বিএসএফের তথ্য কী বলছে? বিএসএফের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ এর ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ এর ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৪৮৯৬ জন বাংলাদেশি নাগরিক ভারতে অনুপ্রবেশের সময় ধরা পড়েছে। তাদের হিসাবে ২০২৩এ ধরা পড়েছে ২৪০৬ জন, ২০২৪ এ ধরা পড়েছে ২৪২৫ জন। এরা সবাই মুসলিম এমন কোনও তথ্য বিএসএফ দেয়নি। বিএসএফের ধর পাকড় সত্ত্বেও আড়ালে আবডালে কিছু অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। যদি তা ঘটে থাকে তাহলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই নিতে হবে। তিনি তা কতটুকু করেছেন জনগণের কাছে প্রকাশ্যে না রেখে, অনুপ্রবেশ থিমকে হাতিয়ার করে এক একটা রাজ্যে বিরোধী সরকারকে ভোটে পরাজিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। এরপর বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় কি অনুপ্রবেশ একটা ভোটের ইস্যু ছাড়া কিছু নয়?

বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, পশ্চিমবঙ্গে ৭০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে। মায়ানমার থেকে সামরিক জুন্টা সরকারের অত্যাচারে কত রোহিঙ্গা উচ্ছেদ হয়েছে? সংখ্যাটা প্রায় দশ লাখ। এরা সবাই ভারতে আসেনি। তারা ঢুকেছে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ায়। কিছু এসেছে ভারতে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ৪০ হাজার, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে এক হাজার থেকে ১২০০-র মতো। সেখানে ৭০ লাখের গল্প কোত্থেকে আসে?

অধিকারী সাহেব আরও একটা দাবি করে বসলেন গত জুলাইয়ে। তাঁর দাবি পশ্চিমবঙ্গের ভোটার লিস্টে ১ কোটি ২৫ লক্ষ বেআইনি অনুপ্রবেশকারী এবং রোহিঙ্গার নাম রয়েছে। তিনি এই দাবির পিছনে কোনও তথ্য প্রমাণ দিলেন না। সংখ্যাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন। কারণ প্রচারমাধ্যমে অনুপ্রবেশ ইস্যুটিকে জিইয়ে রাখাই তাদের কৌশল। এটাই তাদের ভোটের মেরুকরণের হাতিয়ার। অনুপ্রবেশ নিয়ে খেলতে গিয়ে বিজেপি সম্প্রতি কিছু প্রশ্নের সামনে পড়ছে। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন, সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের। তাহলে অনুপ্রবেশের জন্য ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পদত্যাগ করুন। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অমিত শাহ এর ব্যাখ্যা, ‘বাংলা, কাশ্মীর, পাঞ্জাবের সীমান্ত যারা দেখেছেন তারা জানেন, সীমান্ত কোনও শহরের সরল রাস্তার মতো নয়। অজস্র নদী, জঙ্গল, পাহাড় রয়েছে। ভৌগোলিক কারণে সর্বত্র কাঁটাতার দেওয়া, অনেক সময় ২৪ ঘণ্টা নজরদারি সম্ভব নয় (আনন্দবাজার ১৯-১০-২০২৫)। তা হলে অমিত শাহ স্বীকার করে নিলেন তিনি তার দপ্তরকে দিয়ে এই কাজটা করাতে পারেননি। তার দপ্তরের এটা একটা গুরুতর ব্যর্থতা। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর অমিত শাহকে দিতে হবে, যে বিপদসঙ্কুল এলাকায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত মিলিটারি কাজ করতে পারছে না, সেই স্থান দিয়ে দলে দলে সাধারণ মুসলিম ভারতে ঢুকে যাবে এটা কি করে সম্ভব?

অমিত শাহ রাজ্যের উপর দায় চাপাতে বেশ পটু। রাজ্যগুলিকে অভিযুক্ত করে তাঁর বক্তব্য, অনুপ্রবেশকারীরা দেশের কোন গ্রামে ঢুকলে সেটা থানা বা স্থানীয় প্রশাসন জানতে পারে না কেন? এই যে কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোর– দেশের মানুষ তা বহু দেখেছে। মানুষ মনে করে এক্ষেত্রে উভয় সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে। অনুপ্রবেশ সত্যিই কিছু ঘটে থাকলে তা কেন্দ্র ও রাজ্যকে সমন্বয়ের ভিত্তিতে সমস্যা মেটাতে হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্যের সাথে বসতে হবে। কিন্তু অমিত শাহদের সেদিকে উৎসাহ কম। তাদের একটাই বক্তব্য ভোট দিন বিজেপিকে। অনুপ্রবেশের থেকে ভোটের উদ্বেগটাই তাদের বড়ো। বোঝা যায় ওদের জনসমর্থনের পারদ অনেকটাই নেমে গেছে। তাই নন-ইস্যুকে ইস্যু করে ভোট রাজনীতির ছল।

অনুপ্রবেশ নিয়ে হইচই তুলে আসলে বিজেপি একটা আশঙ্কার পরিবেশ তৈরি করতে চায়। ‘বিজেপিকে ভোট দাও, না হলে সব কিছু মুসলমানরা দখল করে নেবে’! জার্মানিতে হিটলারও ইহুদিদের বিরুদ্ধে এই রকম ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়িয়েছিল নিজের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে। তার সর্বনাশা ফলে জার্মান জাতির মতো একটা জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত জাতি প্রায় ধ্বংস হতে বসেছিল। ভারতে বিজেপি সেই জিগিরই তুলছে। এর ফল একই রকম বিষময়। এটাই ফ্যাসিবাদের একটি রূপ। মানুষকে বিভ্রান্ত করো, ভুল বোঝাও। যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসী করে তোলো। অনুপ্রবেশ নিয়ে বিজেপি তাই করছে।