যে কোনও বড় আদর্শের মর্মবস্তু তার সংস্কৃতি ও রুচিগত মানের মধ্যে নিহিত থাকে — শিবদাস ঘোষ

‘‘নৈতিকতার সংকটের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। এ কথা ঠিক যে, দেশে খাদ্য সংকট তীব্র হচ্ছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে, শিল্পোন্নয়ন হচ্ছে না, বেকার সমস্যা বাড়ছে, বিদ্যুৎ নেই– এই সমস্ত সমস্যায় আমরা ঘরে ঘরে ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তার চেয়েও বড় ক্ষতি, নীতি ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে এবং যুক্তিহীন মানসিকতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সমাজজীবনে যে সমস্যা আমাদের দেশে দেখা দিয়েছে, সেখানে ঘটছে। মনে রাখা দরকার, অভাব এবং অত্যাচারের তাড়না যতই হোক না কেন তার দ্বারা একটা জাতিকে মেরে ফেলা যায় না। ব্রিটিশরা দুশো বছরের উপর আমাদের পদানত করে রেখেছিল। কিন্তু, গোটা জাতিটাকে মারতে পারেনি। ভিয়েতনামকে বোমা মেরে মেরে আমেরিকা মরুভূমি বানিয়ে দিয়েছে এবং সেখানকার মানুষগুলোকে একেবারে মাটির তলায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, কিন্তু গোটা দেশের, জাতির মেরুদণ্ড ভাঙতে পারেনি। কিন্তু, আমাদের দেশের শাসক সম্প্রদায় আজ দেশে কি শুধু অর্থনৈতিক দুর্দশাই সৃষ্টি করছে? যে যুক্তি দ্বারা তারা নিজেদের অন্যায় আচরণকে সমর্থন করছে, লোককে সমর্থন করতে বলছেন, পুলিশ যে ভাবে প্রকাশ্যেই প্রতিদিন আইনকে পদদলিত করে চলেছে, এবং পুলিশের এইসব আচরণকে রাজনৈতিক নেতারা এবং প্রশাসকরা যেভাবে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন; উপরন্তু, যুক্তিহীন মানসিকতা যদি এমন স্তরে পৌঁছে থাকে যে, দেশের তরুণরাও কোনও কিছু বুঝতে না চান, রাস্তাঘাটে অশালীন আচরণ করেন এবং তা দেখে বয়স্করাও চুপ করে থাকেন, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে অপরের মতামত সম্বন্ধে সহনশীলতার এরূপ অভাব ঘটে থাকে, তা হলে কী প্রমাণ হয়? শুধু আমরা খেতে পাচ্ছি না এবং আমাদের অভাব– এইটেই প্রমাণ হয়? নাকি, এটাও প্রমাণ হয় যে, আমাদের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে? মনে রাখবেন, একটা জাতি খেতে না পেলেও উঠে দাঁড়ায়, না খেতে পেলেও সে লড়ে যদি মনুষ্যত্ব থাকে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠলে মানুষ বলতে দেশে আর বিশেষ কেউ থাকবে না। কারণ, মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সে বাধা সৃষ্টি করে। …

… আমি বলেছিলাম, যে কোনও বড় আদর্শের মর্মবস্তু তার সংস্কৃতিগত ও রুচিগত মানের মধ্যে নিহিত থাকে। সংস্কৃতিগত এবং রুচিগত মান যদি উঁচু না থাকে, তা হলে যেকোনও একটি উঁচুদরের রাজনৈতিক আদর্শের ধাঁচাটা একটা প্রাণহীন দেহের মতো হয়ে যায়। একটা শরীর দেখতে খুব সুন্দর হলেও যদি তার প্রাণ না থাকে তা হলে তা যেমন অকার্যকরী, ফেলে রেখে দিলে সমাজের পক্ষে অনিষ্টকর, তেমনি কেউ কোনও একটা বড় আদর্শের কথা বলেও যদি উন্নত রুচি এবং সংস্কৃতিগত মান প্রতিফলিত না করে তা হলে সেটাও ঠিক সেই রকম সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক এবং পচনশীল।

কাজেই কোনও একটা পার্টি আদর্শের বড় বড় কথা বলছে কি না সেটা বড় কথা নয়। তাদের আদর্শ সত্যিই বড় কি না তার একটা বড় প্রমাণ হচ্ছে, তাদের নেতা, কর্মী ও সমর্থকবৃন্দ ব্যক্তিগত জীবনে, প্রতিদিনের ব্যবহারে ও রাজনৈতিক আচার-আচরণে উন্নত রুচি ও সংস্কৃতিগত মান প্রতিফলিত করছে কি না।”

ফ্যাসিবাদ ও বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নৈতিকতার সংকট, রচনাবলি, চতুর্থ খণ্ড