ভুয়োদের চাকরি বাতিল হল যোগ্যদের নিয়োগ হবে কবে

৭০০তম দিনে আন্দোলনের মঞ্চে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য তরুণ মণ্ডল।

আদালতে দাঁড়িয়ে স্কুল সার্ভিস কমিশন স্বীকার করেছে স্কুলে ভুয়ো চাকরি দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে ১৯১১ জন গ্রুপ ডি কর্মীর চাকরি বাতিল করেছে আদালত। ঠিক এই কথাটাই ৭০০ দিন ধরে লাগাতার বলে আসছেন ন্যায্য চাকরি থেকে বঞ্চিত, কিন্তু নাছোড় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া অবস্থানকারী হবু শিক্ষকরা। ১২ ফেব্রুয়ারি তাঁদের অবস্থান আন্দোলন পড়ল ৭০০ দিনে। একটানা এই ধরনা আন্দোলনের ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করেছে।

এর আগেও তাঁরা অবস্থান করেছেন। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে ২৯ দিন ধরে চলা হবু শিক্ষকদের অনশন রাজ্যের মানুষ নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। এরপর ২০২১-এ সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কের ৫ নং গেটের কাছে ফের ১৮৭ দিনের অবস্থান ও অনশন আন্দোলন চালান তাঁরা। সরকার বারবার নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগকে উড়িয়ে দিলেও প্রতিবারই ভোটের জন্য আন্দোলনকারীদের মঞ্চে গিয়ে কি মুখ্যমন্ত্রী কি শিক্ষামন্ত্রী সকলেই মেধা তালিকাভুক্তদের নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু কথা রাখেননি। উল্টে আন্দোলনকারী নেতাদের র্যাঙ্ক জাম্প করিয়ে চাকরি পাইয়ে দিয়ে আন্দোলন ভাঙতে চেয়েছেন।

তাই ২০২১-এর ৮ অক্টোবর থেকে ধর্মতলার গান্ধীমূর্তির পাদদেশে ধরনায় যাঁরা বসেছেন তাঁরা আর সেই ভুল করেননি। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব আসা সত্ত্বেও আন্দোলন তাঁরা প্রত্যাহার করেননি। ৭০০ দিন ধরে চলা আন্দোলনে সংহতি জানাতে ১২ ফেব্রুয়ারি এস ইউ সি আই (সি)-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রাক্তন সাংসদ ডাঃ তরুণ মণ্ডলের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল আন্দোলন মঞ্চে যান। তাঁরা আন্দোলনকারীদের অভিনন্দন জানান।

রাস্তার আন্দোলনের পাশাপাশি দাবি আদায়ের পরিপূরক হিসাবে চলেছে আদালতে কড়া নাড়া। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পাঁচটা রোদ-ঝড়-বৃষ্টি-শীত সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে চলেছে তাদের লড়াই। প্রচলিত সংবাদমাধ্যম প্রথমে উদাসীন থাকলেও শিক্ষকতার চাকরির ন্যায্য দাবিদার আন্দোলকারীরা তাতে দমে যাননি। বরং তাদের বলিষ্ঠতা, সংগ্রামী মানসিকতা দৃঢ় হয়েছে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকা হার না মানা এই লড়াই-ই বাধ্য করেছে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দলসহ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, তাঁদের দাবির যৌক্তিকতা বুঝতে। এ ভাবেই শুধুমাত্র রাস্তায় বসে থেকে এই সংঘবদ্ধ আন্দোলন ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে এক প্রবল জনসমর্থন। আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই এস ইউ সি আই (সি) দল ও যুব সংগঠন এআইডিওয়াইও এই আন্দোলনের পাশে থেকেছে। আদালত বারবার তদন্তকারী সংস্থার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে, অফিসার বদল করেছে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা হতাশ হননি। তাঁদের এই দৃঢ়চিত্ততা, শেষ দেখে ছাড়ার মানসিকতা সকল পক্ষকে বাধ্য করেছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। আন্দোলন যত ছড়িয়েছে, সরকার ও স্বার্থান্বেষী বিরোধী পক্ষের চক্রান্ত উন্মোচিত করে আন্দোলন যত গড়ে উঠেছে, ততই চাপ সৃষ্টি হয়েছে সরকার ও পার্লামেন্টারি বিরোধীপক্ষ সহ সকলের উপর। আর সেই চাপেই একের পর দুর্নীতি প্রকাশিত হয়ে পড়ছে।

এই আন্দোলনের চাপেই অবশেষে বাঁকা পথে নিয়োগের কথা মানতে বাধ্য হল রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। আদালতে হলফনামা দিয়ে কার্যত রাজ্য সরকার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতির কথা কবুল করেছে। এর ফলে নবম দশম শ্রেণির শিক্ষক পদে চাকরি খোয়াতে চলেছেন ৮০৩ জন। চাকরি হারাতে বসেছেন বিভিন্ন স্কুলের গ্রুপ ডি বা চতুর্থ শ্রেণির ২৮২০ টি পদে নিযুক্তরাও। ইতিমধ্যে ১৯১১ জন গ্রুপ ডি কর্মীর চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। যাদের নিয়োগ বাতিল হল তারা আদালতে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ না করে আর কোনও দিন চাকরির পরীক্ষায় বসতে পারবেন না এবং এদের প্রত্যেককে প্রাপ্ত বেতনের টাকা ফেরত দিতে হবে। সিবিআই এদের তদন্তের আওতায় আনবে, প্রয়োজনে তাদের হেফাজতেও নিতে পারবে। এই সব শূন্যপদে ওয়েটিং লিস্টে থাকা পদপ্রার্থীদের মেধা তালিকা থেকে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে।

নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে চাকরি যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়, এর আগেও হয়েছে। কিন্তু এই দুর্নীতির বহর কতখানি? জানলে অবাক হতে হয়। গ্রুপ ডি-র ঘোষিত শূন্য পদ ছিল ৩৯৫৬ টি। এর মধ্যে ২৮২০ পদেই চাকরি পেয়েছে ভুয়ো প্রার্থীরা। ইতিমধ্যে দুই খেপে ২৫২৮ জনের চাকরি বাতিল হয়ে গেছে। ওএমআর শিট কারচুপি করেই হয়েছে এই নিয়োগ। শুধুমাত্র মেধা তালিকায় নয়, ওয়েটিং লিস্টেও কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। এনওয়াইএসএ সংস্থাকে এসএসসি নিয়োগ করেছিল ওএমআর শিট মূল্যায়নের জন্য। দেখা গেছে তাদের সার্ভারে প্রাপ্ত নম্বর আর এসএসসির সার্ভারে প্রাপ্ত নম্বরে বিস্তর গরমিল। এনওয়াইএসএ-র সার্ভারে প্রাপ্ত নম্বর শূন্য, এইরকম অনেক প্রার্থী এসএসসির সার্ভারে অনায়াসে ৫৭, ৫৩, ৫৮ নম্বর পেয়ে উপরের দিকে র্যাঙ্ক করেছে। যাদের চাকরি গেছে, দেখা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা, কর্মী বা মন্ত্রীদের ঘরের লোকজন।

প্রবল চাপের মুখে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্ররা সেই পুরনো কথাই শোনাচ্ছেন– আইন আইনের পথে চলবে। কেউ কেউ বলছেন ভোটের জন্য বিরোধীরা নাকি ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন, চাকরিই তো গিয়েছে, ব্যাপমের মত খুন তো হয়নি। এ কথা ঠিক, ভোটবাজ কিছু দল ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে। বিগত সিপিএম শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও খাদ্য দপ্তরের নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ হয়েছে। পাশের রাজ্য ত্রিপুরায় বিগত সিপিএম সরকারের আমলে বাঁকা পথে চাকরি পাওয়ার জন্য ১০ হাজারের বেশি শিক্ষকের চাকরি হাইকোর্ট বাতিল করেছে। মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট সহ বিজেপি শাসিত ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যে আরও ব্যাপকভাবে নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু তার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের বর্তমান অনাচারের, অপরাধের মাত্রা কোনও অংশে কমে না।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে হবু শিক্ষকদের এই আন্দোলন সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে যে লড়াই গড়ে তুলতে পেরেছে তাতে আজ তাঁরা দাবি আদায়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। এটাই সঙ্ঘবদ্ধ জনতার শক্তি। খুব সম্প্রতি দিল্লির বুকে দেশের কৃষক সমাজের এমনই এক শক্তির পরিচয় আমরা পেয়েছি, যা কেন্দ্রের প্রবল শক্তিশালী সরকার তো বটেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করেও অনড় লড়াই চালিয়ে দাবি আদায় করেছে। প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলি দেশসেবার নামে আত্মসেবা আর দেশবাসীর স্বার্থরক্ষার নামে কতিপয় পুঁজিপতি ও তার তোষামোদকারী আর নিজেদের আত্মীয় পরিবার-পরিজনদের স্বার্থ রক্ষা করছে।

বিপরীতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি মানুষকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে অন্যায়, অত্যাচার, বঞ্চনার, দারিদ্রের অতল গহ্বরে। প্রচলিত এই বুর্জোয়া ব্যবস্থায় প্রশাসন এমনকি বিচারব্যবস্থাও ক্রমাগত শক্তি দেয় অত্যাচারী পুঁজি-মালিকদের আর জনগণকে করে শক্তিহীন। প্রতিদিন জনগণের অধিকারগুলিকে তারা কেড়ে নিতে উদ্যত। একে যদি রুখতে হয়, নিজেদের অধিকারগুলোকে যদি রক্ষা করতে হয়, বেঁচে থাকার নূ্যনতম দাবি যদি আদায় করতে হয়– তা হলে প্রয়োজন শোষিত জনগণের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তোলা। যা এক বিকল্প শক্তির জন্ম দেবে, যে শক্তিকে ভয় পায় সকল শাসক। এই শক্তির জোরেই জনগণ দীর্ঘ ১৯ বছর লড়াই করে প্রাথমিকে ইংরেজি ফিরিয়ে আনতে পেরেছে, সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের আন্দোলন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, দিল্লির কৃষক আন্দোলন জয়যুক্ত হতে পেরেছে। বর্তমান হবু শিক্ষকদের আন্দোলন এই শক্তির জোরেই দাবি আদায়ের পথে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে। ভোটে সরকার পরিবর্তনের রাজনীতি নয়, জনগণের এই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেওয়া আজ অত্যন্ত প্রয়োজন।