গরিবের মা

৬ জানুয়ারি, গভীর শীতের রাত। রামপ্রসাদ দেওয়ান ক্রান্তি থেকে ৯০০ টাকা অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া দিয়ে অসুস্থ মাকে নিয়ে পৌঁছলেন জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি সেখানেই মারা যান। অল্প কিছু টাকা রয়েছে হাতে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে বহু অনুনয় করেও শবদেহবাহী গাড়ি পাননি রামপ্রসাদ। অবশেষে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের তিন হাজার টাকার চাহিদা মেটাতে না পেরে কাঁধেই মায়ের দেহ নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেন। সঙ্গে বাবা জয়কৃষ্ণ দেওয়ান। না, রামপ্রসাদকে ওড়িশার কালাহান্ডির বাসিন্দা দানা মাজির মতো কিংবা ছত্তিশগড়ের সরগুজার ঈশ্বর দাসের মতো পুরো রাস্তা প্রিয়জনের দেহ কাঁধে নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে হয়নি। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মাঝরাস্তা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে।

মায়ের দেহ কাঁধে নিয়ে রামপ্রসাদের কি মনে পড়ছিল ছোটবেলায় মা তাকে কী ভাবে কোলে নিয়ে কাজ করতেন! হয়ত মনে পড়েছে, হয়ত পড়েনি। রামপ্রসাদ হয়ত ভাবছিল হাসপাতালে ভাল চিকিৎসা পেলে মার মৃত্যু এড়ানো যেত। সে হয়ত ভাবছিল, তাদের পয়সা থাকলে মাকে এত তাড়াতাড়ি হারাতে হত না, অথবা হারালেও শবদেহ নিয়ে যাওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা হত।

হাসপাতাল সুপার ঘটনাটিকে ‘অমানবিক’ বলেছেন। তিনি বলেছেন, হাসপাতালে রোগী সহায়তা কেন্দ্র ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। তারপরেও কেন এমন ঘটনা ঘটল? এ তো প্রতিটি রোগীর পরিজনেরই প্রশ্ন। হাসপাতালের রোগী কল্যাণ তহবিল সাধারণ মানুষের অর্থেই গড়ে উঠেছে। এই তহবিল রোগীদের কোন কল্যাণ করছে? সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীরাই ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু এটা প্রত্যেকের কম-বেশি অভিজ্ঞতা যে, চিকিৎসা করাতে আসা ব্যক্তির সামাজিক প্রতিপত্তি কতটা, আর্থিক দিক থেকে সে কতটা ওজনদার, তার উপরেই নির্ভর করে পরিষেবা! এর হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া গেল ওই দিনের ঘটনায়। দরিদ্র ঘরের মহিলা মৃত্যুর পরও উপযুক্ত পরিষেবা পেলেন না। শবদেহবাহী গাড়ি পেলেন না পরিজনরা। তাও এ ঘটনা যে-সে সরকারি হাসপাতালের নয়, এ হল মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘সুপার স্পেশালিটি’ হাসপাতালের!

সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের নামে তৃণমূল সরকারের প্রচারে কান ঝালাপালা। অথচ ভুক্তভোগী মানুষ মাত্রেই জানেন, জেলায় জেলায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের নামে নীল-সাদা বিল্ডিং, হাসপাতালের নাম খোদিত সুউচ্চ গেট আর ভেতরে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ছাড়াই মুষ্টিমেয় কয়েকজন ডাক্তার-নার্সের হাতে হাজার হাজার রোগী পরিষেবার ভার দিয়ে সরকারের নাম কেনার পালা চলে। এই অব্যবস্থার ফলে হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢোকার পর থেকে শুরু করে ডাক্তার দেখানো, ভর্তি হওয়া, অপারেশন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অঘোষিত ‘কর্তা’ দালালদের হাতে নিজেদের সঁপে দিতে বাধ্য হন রোগীর অসহায় পরিজনরা। দালালদের পয়সার খাঁই মেটাতে তাঁদের সর্বস্বান্ত হতে হয়। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালকরাও ঝোপ বুঝে কোপ মারেন। সরকারের কি এগুলি অজানা?

স্বাধীনতার ৭৫ বছরে ঘটা করে ‘অমৃত মহোৎসব’ পালন করছেন বিজেপি নেতারা। অথচ ওড়িশা, ছত্তিশগড় বা পশ্চিমবঙ্গের এই মর্মান্তিক ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো একটা জরুরি ক্ষেত্রেও এই চূড়ান্ত গাফিলতি আজ স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত। যেখানে উন্নত মানের চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া দূরের কথা,প্রিয়জনের মৃতদেহ সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাটুকুও হয় না।

হাসপাতালের সুপার কর্মীদের মানবিক মূল্যবোধ শেখানোর কথা বলেছেন। হাসপাতাল কর্মীদের মানবিক হওয়া নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু এটা কি শুধু কর্মীদের মানবিকতার প্রশ্ন? শববাহী গাড়ির ব্যবস্থা না থাকা, কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেও সাড়া না মেলা, বিবৃতি দিয়েই সুপারের দায় সারা– এ সবই আসলে একটা ব্যবস্থার নানা মুখ, যে ব্যবস্থায় রামপ্রসাদের মতো সাধারণ মানুষের মূল্য কানাকড়িও নয়। জনসেবার ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা বড় বড় দলগুলো অনায়াসে নিজেদের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে সেই মানুষকেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে।

রামপ্রসাদের মায়ের বরাতে তবু শেষ অবধি অ্যাম্বুলেন্স জুটেছে, বহু ক্ষেত্রে সেটুকুও জোটে না। এই নিষ্ঠুরতা অমানবিকতার অবসান ঘটাতে পারে জনতাই, লাগাতার প্রতিবাদ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।