ইউরোপের দেশে দেশে আন্দোলনে স্বাস্থ্যকর্মীরা

ইউরোপের দেশে দেশে খেটে-খাওয়া মানুষ মূল্যবৃদ্ধির জ্বালায় অতিষ্ঠ। অথচ কোথাও প্রয়োজনমতো বেতন বাড়াতে রাজি নয় কর্তৃপক্ষ। নেই যথাযথ কাজের পরিবেশও। এই অবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে গণবিক্ষোভ। অন্যান্য ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারীদের মতোই এই বিক্ষোভে সামিল ডাক্তার, নার্স সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। সম্প্রতি ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে দাবি আদায়ে আন্দোলনের পথটিকেই বেছে নিয়েছেন তাঁরা।

ইংল্যান্ডঃ বেতন বৃদ্ধি ও হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মী নিয়োগ করে রোগীর যথাযথ নিরাপত্তা বিধানের দাবিতে গত ১০৬ বছরের মধ্যে প্রথমবার ধর্মঘটে সামিল হলেন ব্রিটেনের সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগ ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’-এর নার্সরা, গত ১৫ ডিসেম্বর। সেদিন ব্রিটেনের ৭৬টি হাসপাতালের প্রায় এক লক্ষ নার্স কাজ বয়কট করেন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ক’দিন পর ২০ ডিসেম্বর ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের নার্সরা আবার ধর্মঘট করেন। শুধু নার্সরাই নন, ২১ ডিসেম্বর ধর্মঘটে সামিল হন ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ১০ হাজার অ্যাম্বুলেন্স-কর্মী। স্বাস্থ্যকর্মীরা আবার ধর্মঘটে যান ২৮ ডিসেম্বর।

নার্সদের দাবি, বেতন বাড়াতে হবে মূল্যবৃদ্ধির হারের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি হারে। গত নভেম্বরে দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশে। সুতরাং তাঁদের দাবি, বেতন বাড়াতে হবে ১৯ শতাংশ। কর্মীরা বলছেন, কম বেতনে সংসার চালাতে না পেরে বহু নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যাঁরা থেকে যাচ্ছেন, তাঁদের উপর কাজের মারাত্মক চাপ পড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষে ইংল্যান্ডে সরকারি হাসপাতালগুলিতে নার্সদের শূন্যপদের সংখ্যা পৌঁছেছিল প্রায় সাড়ে ৪৭ হাজারে। কিন্তু এই দাবি মানতে রাজি নয় কর্তৃপক্ষ। তারা বেতন বাড়াতে চায় মাত্র ৪ শতাংশ। এই অবস্থায় কোমর বেঁধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ শুরু করেছেন ইংল্যান্ডের নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। বুঝেছেন, আন্দোলন ছাড়া দাবি আদায়ের পথ নেই।

মাসের পর মাস ধরে স্বাস্থ্য সহ অন্যান্য পরিষেবা পেতে অসুবিধা হলেও দেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু রয়েছেন আন্দোলনকারীদের পাশেই। কারণ দারুণ মূল্যবৃদ্ধির এই সময়ে কম বেতনে সংসার চালানোর যন্ত্রণা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তাঁরাও। ইংল্যান্ডের রেল, নৌ ও সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থার শ্রমিক-কর্মচারী, ডাকবিভাগ ও বিমানবন্দরের কর্মীরাও লাগাতার আন্দোলনে রয়েছেন। তাঁদের সমর্থনে জোর পেয়েছে কর্মচারী সংগঠনগুলি। সরকার দাবি না মানলে জানুয়ারির ১৮ ও ১৯ তারিখে আবার ধর্মঘটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নার্সদের সংগঠন। ওইদিন আরও বেশি নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

স্পেনঃ জিনিসপত্রের আগুন-দামে পুড়ছেন ইউরোপের আরেকটি দেশ স্পেনের বাসিন্দারাও। দাবি আদায়ে আন্দোলন ছাড়া পথ নেই বুঝেছেন সেখানকার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও। তাই নিজেদের নানা দাবিতে দেশ জুড়ে বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন তাঁরা। গত ২৫ অক্টোবর রাজধানী মাদ্রিদে ডাক্তার ও নার্সরা ব্যাপক বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের দাবি, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অবিলম্বে আরও অর্থ বরাদ্দ করতে এবং হাসপাতালগুলিতে কাজের পরিবেশ উন্নত করতে হবে।

আন্দোলন গড়ে তুলছেন ভারতের স্বাস্থ্যকর্মীরাও। সরকারি হাসপাতালের নার্সরা কাজের অমানুষিক চাপে বিপর্যস্ত। শূন্যপদগুলি শূন্য হয়েই পড়ে থাকে, সরকার যথেষ্ট সংখ্যক নার্স নিয়োগে তৎপর নয়। ফলে নিতান্ত প্রয়োজনেও অনেক সময় ছুটি মেলে না কর্মরত নার্সদের। এ দেশের গ্রামীণ অঞ্চলে রোদ-জল অগ্রাহ্য করে ঘরে ঘরে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেন যে আশাকর্মীরা, অমানুষিক পরিশ্রম করে বছরের পর বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে চলা সত্তে্বও আজও তাঁদের সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতি নেই। যৎসামান্য ভাতার বিনিময়ে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির এই সময়ে নিতান্ত দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। সরকারের এই অন্যায্য দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদে এদেশে আশাকর্মীরা লাগাতার আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। ইউরোপের ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের আন্দোলনের এই জোয়ার নিশ্চয়ই তাঁদের প্রেরণা জোগাবে।

ফ্রান্সঃ চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্যকর্মীদের আন্দোলনে উত্তপ্ত ফ্রান্সও। ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক দুরবস্থায় বিপর্যস্ত ফ্রান্সের মানুষও। এই পরিস্থিতিতে ৭ জানুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ ও বেতন বাড়ানোর দাবিতে প্যারিসে বিক্ষোভ দেখান ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। স্টেথোস্কোপ মাটিতে নামিয়ে রেখে এ দিন তাঁরা সরকারি স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ডাক্তাররা ছাড়াও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও ডাক্তারদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে পথে নামেন।

ফ্রান্সে দীর্ঘদিন ধরেই স্বাস্থ্যকর্মীরা আন্দোলনে। গত বছর গ্রীষ্মে জনস্বার্থবিরোধী সরকারি স্বাস্থ্যনীতির প্রতিবাদে ও বেতন বৃদ্ধির দাবিতে গোটা দেশ জুড়ে ধর্মঘটে সামিল হয়েছিলেন তাঁরা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তাঁরা গত ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ধর্মঘট করেন। দাবি আদায় না হওয়ায় ২৬ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেন তাঁরা। ধর্মঘটের মধ্যেই ৫ জানুয়ারি দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখান আন্দোলনকারী ডাক্তাররা।