রাষ্ট্র ও বিপ্লব (৪)– লেনিন

শ্রমিক শ্রেণির কাছে রাষ্ট্রের প্রয়োজন কেবলমাত্র শোষকদের প্রতিরোধ দমনের জন্য

এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এবার চতুর্থ কিস্তি।

১৮৪৮-১৮৫১ সালের অভিজ্ঞতা

১। বিপ্লবের প্রাক্কালে

মার্ক্সবাদের প্রথম সুপরিণত রচনা ‘দর্শনের দারিদ্র’ ও ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ গ্রন্থদুটি প্রকাশিত হয় ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে। এই কারণে বই দুটিতে মার্ক্সবাদের সাধারণ মূলনীতিগুলির সঙ্গে সঙ্গে আমরা তখনকার সুনির্দিষ্ট বৈপ্লবিক পরিস্থিতির কিছুটা প্রতিচ্ছবি পাই। তাই এই দুই গ্রন্থের রচয়িতারা ১৮৪৮-১৮৫১ সালের অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত টানার ঠিক আগে রাষ্ট্র সম্পর্কে কী বলছেন সেটা দেখে নেওয়াটা যথাযথ হবে।

‘দর্শনের দারিদ্র’ গ্রন্থে মার্ক্স লিখছেন  ‘… বিকাশের গতিপথে শ্রমিক শ্রেণি পুরনো বুর্জোয়া সমাজের পরিবর্তে এমন এক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে যেখানে শ্রেণি ও শ্রেণি-বিরোধের অবসান ঘটবে। যেখানে কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতাধারী গোষ্ঠী থাকবে না, কেন না রাজনৈতিক ক্ষমতাই হল বুর্জোয়া সমাজের অভ্যন্তরে শ্রেণি বিরোধের সুনির্দিষ্ট অভিব্যক্তি।’ (১৮৮৫ সালের জার্মান সংস্করণ, পৃঃ ১৮২)

শ্রেণি বিলুপ্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রের বিলুপ্তি– এই সাধারণীকৃত তত্তে্বর সাথে এর কয়েক মাস পরে ১৮৪৭-এর নভেম্বরে কমিউনিস্ট ইশতেহারেক্স মার্ক্স-এঙ্গেলস রাষ্ট্র সম্পর্কে যে ব্যখ্যা দিয়েছেন তাকে মিলিয়ে বুঝলে বোঝাটা সঠিক হবে।

‘… সর্বহারা শ্রেণির বিকাশের অত্যন্ত সাধারণ পর্যায়গুলিকে বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা কমবেশি প্রচ্ছন্ন গৃহযুদ্ধের সন্ধান পেয়েছি। বিদ্যমান সমাজের মধ্যে এই সংগ্রাম এমন সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়, যখন তা প্রকাশ্য বিপ্লবের রূপ নেয়। এই স্তরে এসে বলপ্রয়োগের দ্বারা বুর্জোয়া শ্রেণিকে উৎখাত করার মধ্য দিয়ে সর্বহারা শ্রেণিশাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

‘… আমরা আগেই দেখেছি যে, গণতন্ত্রের যুদ্ধে জয়লাভ করতে সর্বহারা শ্রেণিকে শাসক শ্রেণির পর্যায়ে উন্নীত করাই হল শ্রমিক বিপ্লবের প্রথম ধাপ।

‘সর্বহারা শ্রেণি তার রাজনৈতিক আধিপত্যকে কাজে লাগিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণির কাছ থেকে সমস্ত পুঁজি ধাপে ধাপে ছিনিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রের অর্থাৎ, শাসক শ্রেণি রূপে সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণির হাতে ক্রমশ উৎপাদনের সমস্ত উপায়গুলিকে কেন্দ্রীভূত করবে এবং যত দ্রুত সম্ভব সমগ্র উৎপাদন শক্তির ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলবে।’ (১৯০৬ সালের ৭ম জার্মান সংস্করণ, পৃঃ ৩১ ও ৩৭)

এখানে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্ক্সবাদের উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলির একটিকে আমরা পাই– তা হল, ‘সর্বহারার একনায়কত্বক্স সম্পর্কে ধারণা (প্যারিস কমিউনের পর থেকে মার্ক্স ও এঙ্গেলস এ ভাবেই বলতে শুরু করেছিলেন)। তা ছাড়া এর মধ্য দিয়ে মার্ক্সবাদের ‘বিস্মৃত শিক্ষাগুলিরক্স অন্যতম একটিকে আমরা পাচ্ছি, যা রাষ্ট্রের অতি সুন্দর একটি সংজ্ঞা দেয়– ‘রাষ্ট্র, মানে হল শাসক শ্রেণি রূপে সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণি’।

প্রতিষ্ঠিত সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলির প্রচলিত প্রচার ও আন্দোলন সংক্রান্ত লেখাপত্রে রাষ্ট্রের এই সংজ্ঞা কখনওই আলোচিত হয়নি। তার থেকেও বড় কথা হল একে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। কারণ সংস্কারবাদের সঙ্গে তা একেবারেই খাপ খায় না। ‘গণতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ বিকাশ’ নিয়ে প্রচলিত সুবিধাবাদী ঝোঁক ও কূপমণ্ডুক মোহগ্রস্ততার গালে এই কথাগুলো একেবারে কষিয়ে থাপ্পড় বসায়।

সর্বহারা শ্রেণির হাতে রাষ্ট্র দরকার– এ কথা বারবার আওড়ে সমস্ত ধরনের সুবিধাবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও কাউটস্কিপন্থীরা বিশ্বাস করাতে চায় যে এটাই যেন মার্ক্সের শিক্ষা। যদিও তারা যোগ করতে ‘ভুলে যায়ক্স, প্রথমত, মার্ক্সের মতে, সর্বহারা শ্রেণির একমাত্র এমন রাষ্ট্রই দরকার যা ক্রমবিলুপ্তির পথে চলেছে। অর্থাৎ এমনভাবে তা গঠিত যে তৈরি হওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই বিলুপ্তির পথে যেতে থাকে এবং বিলুপ্ত না হয়ে তার আর কোনও উপায় নেই। দ্বিতীয়ত, খেটে খাওয়া মানুষের চাই তেমন একটি ‘রাষ্ট্র, যেখানে সর্বহারা শ্রেণি শাসক শ্রেণি রূপে সংগঠিতক’।

রাষ্ট্র হল বিশেষভাবে সংগঠিত একটি শক্তি, কোনও একটা শ্রেণিকে দমনের জন্য বলপ্রয়োগের সংগঠন। সর্বহারা শ্রেণির কোন শ্রেণিকে দমন করতেই হবে? অবশ্যই শোষক শ্রেণি, অর্থাৎ বুর্জোয়াদের। শ্রমিক শ্রেণির কাছে রাষ্ট্রের প্রয়োজন কেবলমাত্র শোষকদের প্রতিরোধ দমনের জন্য। আর একমাত্র সর্বহারা শ্রেণিই সেই দমনে নেতৃত্ব দিতে ও তা কার্যকর করতে সক্ষম। কারণ, শ্রেণি হিসেবে কেবলমাত্র সর্বহারা শ্রেণিই তার জন্ম থেকে ধারাবাহিকভাবে বিপ্লবী। এটাই একমাত্র শ্রেণি যা বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং তাদের সম্পূর্ণ উৎখাত করার কাজে সমস্ত মেহনতি জনগণ ও শোষিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম।

শোষক শ্রেণিগুলির রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োজন জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বার্থের বিরুদ্ধে নগণ্য অংশের স্বার্থে তাদের শোষণ বজায় রাখার জন্য। শোষিত শ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতা দরকার সমস্ত প্রকার শোষণের সম্পূর্ণ অবসানের স্বার্থে, অর্থাৎ মুষ্টিমেয় আধুনিক দাসপ্রভু– জমিদার ও পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে বিপুল অংশের জনগণের স্বার্থে।

পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রী, মেকি সমাজতন্ত্রীরা শ্রেণি-সংগ্রামের বদলে শ্রেণি-সমঝোতার স্বপ্ন আমদানি করে। এমনকি তারা সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কার্যক্রমকে এমন রঙিন ভাবে দেখায়– যেন তা সম্ভব শোষক শ্রেণির শাসনকে উচ্ছেদ করার মধ্যে দিয়ে নয়, উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন সংখ্যাগুরুর কাছে সংখ্যালঘুর শান্তিপূর্ণ আত্মসমপর্ণের মধ্যে দিয়ে। শ্রেণি-ঊর্ধ্ব রাষ্ট্রের কল্পনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত এই পেটি বুর্জোয়া কাল্পনিক ধারণাটি– কার্যক্ষেত্রে যা পরিণত হয়েছে মেহনতি শ্রেণিগুলির স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতায়– যার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে, ১৮৪৮ ও ১৮৭১-এর ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে, দেখা গেছে উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ায় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি ও অন্যান্য দেশে বুর্জোয়া মন্ত্রিসভায় ‘সমাজতান্ত্রিকক্সদের অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতায়।

মার্ক্স সারা জীবন লড়াই করেছেন এই পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্তে্রর বিরুদ্ধে, যা বর্তমানে রাশিয়ায় আবার মাথাচাড়া দিয়েছে সোসালিস্ট রেভলিউশনারি ও মেনশেভিক পার্টিতে। তিনি তাঁর শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্বকে বিরামহীন ভাবে বিকশিত করার মধ্য দিয়ে রূপ দিয়েছেন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতার তত্ত্বে।

বুর্জোয়াদের শাসন ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে পারে একমাত্র সর্বহারা শ্রেণিই। কারণ, যে অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সে জীবন নির্বাহ করে সেই অবস্থাই তাকে এর জন্য প্রস্তুত করে, এ কাজ করার সুযোগ ও শক্তি জোগায়। বুর্জোয়ারা যখন কৃষক ও সমস্ত পেটি বুর্জোয়া গোষ্ঠীগুলিকে খণ্ডবিখণ্ড ও ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তখন তারা একই সঙ্গে সর্বহারা শ্রেণিকে করে তোলে সংহত, ঐক্যবদ্ধ এবং সংগঠিত। সর্বহারা শ্রেণি বৃহৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে তার জোরে একমাত্র সে-ই পারে সমস্ত মেহনতি ও শোষিত জনগণকে নেতৃত্ব দিতে– যে জনগণের ওপর বুর্জোয়ারা শোষণ, পীড়ন, নির্যাতন চালায়, সর্বহারা শ্রেণির ওপর চালানো শোষণের চেয়ে তা কম কিছু নয় বরং প্রায়শই আরও বেশি। কিন্তু এই অংশের জনগণ নিজেদের মুক্তির জন্য স্বাধীন ভাবে সংগ্রাম চালাতে অক্ষম।

রাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রশ্নে মার্ক্স শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব যে ভাবে প্রয়োগ করেছেন, তাতে অনিবার্যভাবেই সর্বহারা শ্রেণির রাজনৈতিক আধিপত্য, তার একনায়কত্ব অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে এবং জনগণের সশস্ত্র শক্তির জোরে তা অবিভাজ্য শক্তিতে পরিণত হয়। বুর্জোয়া শ্রেণিকে উৎখাত করা সম্ভব একমাত্র তখনই যখন সর্বহারা শ্রেণি শাসক শ্রেণিতে পরিণত হবে এবং বুর্জোয়াদের অবশ্যম্ভাবী মরিয়া প্রতিরোধকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সমস্ত মেহনতি শোষিত জনগণকে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপযোগী করে সংগঠিত করতে সক্ষম হবে।

ক্ষমতার এক কেন্দ্রীভূত সংগঠন, বলপ্রয়োগের এক সশস্ত্র সংগঠন হিসাবে সর্বহারা শ্রেণির রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োজন একদিকে শোষকদের প্রতিরোধকে চূর্ণ করার জন্য, অন্য দিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করার কাজে জনগণের বিপুল অংশকে– কৃষক, পেটিবুর্জোয়া, আধা-সর্বহারা শ্রেণিকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজনে।

শ্রমিক শ্রেণির পার্টিকে শিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে মার্ক্সবাদ শিক্ষিত করে তুলছে সর্বহারা শ্রেণির অগ্রগামী বাহিনীকে। এই অগ্রগামী বাহিনীই ক্ষমতা দখল করে সমস্ত জনগণকে সমাজতন্ত্রের দিকে পরিচালিত করতে, নতুন ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্তে্রর প্রবর্তন করতে ও তাকে সংগঠিত করতে সক্ষম। বুর্জোয়াদের ছাড়াই এবং তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই সর্বহারা শ্রেণি মেহনতি ও শোষিত জনগণের সামাজিক জীবন গড়ে তোলার কাজে শোষিত জনগণের শিক্ষক, পথপ্রদর্শক ও নেতা হতে সক্ষম। বিপরীতে বিদ্যমান সুবিধাবাদ শ্রমিক শ্রেণির পার্টির ভেতর থেকে গড়ে তুলছে এমন সব লোক যারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, মোটা বেতনের শ্রমিকদের প্রতিনিধি, যারা পুঁজিবাদের আমলে ভাল রকম ‘গুছিয়ে নিয়েছেক্স, তুচ্ছ স্বার্থের লোভে যারা নিজেদের জন্মগত অধিকারকেই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত– এক কথায়, এরা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে জনগণের বিপ্লবী নেতা হিসাবে নিজেদের ভূমিকা বিসর্জন দিতেও রাজি।

‘রাষ্ট্র মানে শাসক শ্রেণি রূপে সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণিক্স– মার্ক্সের এই তত্ত্বটি ইতিহাসে সর্বহারা শ্রেণির বৈপ্লবিক ভূমিকা নিয়ে তাঁর সামগ্রিক মতবাদের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সেই শাসনের পূর্ণ পরিণতি হল সর্বহারার একনায়কত্ব, সর্বহারা শ্রেণি হিসাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগ।

কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের বিশেষ সংগঠন হিসেবে যদি সর্বহারা শ্রেণির রাষ্ট্রকে দরকার হয়, তা হলে তা থেকে এই স্বাভাবিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, যে-রাষ্ট্রযন্ত্রটা বুর্জোয়ারা নিজেদের জন্য গড়েছিল, আগে তাকে চূর্ণ না করে, ধবংস না করে কি তেমন আর একটা সংগঠন গড়ার কথা ভাবা যায়? ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারক্স সোজাসুজি এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছে এবং ১৮৪৮-১৮৫১ সালের বিপ্লবের অভিজ্ঞতার সারমর্ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্ক্স ঠিক এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন। (চলবে)