কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার আলোকে সর্বদা নিজেকে বিচার করা দরকার– কমরেড মানিক মুখার্জী স্মরণসভায় কমরেড প্রভাস ঘোষ

দলের পলিটবুরোর প্রবীণ সদস্য কমরেড মানিক মুখার্জীর স্মরণে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে  ২৬ অক্টোবর মহাজাতি সদনে এক সভা হয়। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন কমরেড অসিত ভট্টাচার্য। প্রধান বক্তা ছিলেন কমরেড প্রভাস ঘোষ।

 

কমরেড সভাপতি ও কমরেডস,

আপনারা জানেন, আমরা যখন কোনও স্মরণসভা করি, তা আমাদের কাছে নিছক কোনও অনুষ্ঠান নয়। মাল্যদান, শোকপ্রস্তাব, বক্তব্য– এগুলির কোনওটিই শুধু আনুষ্ঠানিক নয়। যিনি প্রয়াত, দলের নেতাই হোন আর কর্মীই হোন, তাঁকে তো আমাদের দেওয়ার কিছু নেই। তিনি নেওয়া-দেওয়ার বাইরে। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনে কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র হিসাবে কী ভাবে কতটা সংগ্রাম করেছেন, কী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁর সেই সংগ্রামী জীবন থেকে আমরা কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, তাঁর গুণাবলি থেকে কতটা আহরণ করতে পারি– এটাই এই স্মরণসভার একমাত্র তাৎপর্য।

আমাদের দলে আমরা প্রথম মৃত্যুজনিত বেদনার সম্মুখীন হই ১৯৭৪ সালে, যখন তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, জননেতা, প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের শ্রমমন্ত্রী কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী প্রয়াত হন। সেই সময়ে এই হলেই আমাদের মহান শিক্ষক, মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। কী ভাবে শোককে, ব্যথা-বেদনাকে দেখতে হয় সেই বিষয়ে আমাদের সামনে একটা গাইডলাইন উপস্থিত করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ভবিষ্যতে তাঁর নিজের মৃত্যুজনিত ব্যথা আমাদের যখন আঘাত করবে, সেই অবস্থাতেও আমরা যাতে শক্ত হয়ে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়াতে পারি, পরবর্তীকালে এই ধরনের আরও মৃত্যুজনিত ব্যথা-বেদনার সামনে যাতে দাঁড়াতে পারি, সেই সম্পর্কে একটি শিক্ষা রেখে যাওয়া। ওই সময়েই তাঁর বিখ্যাত উক্তি ‘বিপ্লবী রাজনীতি উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি’। এখানেই তিনি বলেছেন, নিছক শোকপ্রকাশের, শুধুমাত্র হৃদয়াবেগের কোনও মানে নেই, যদি বিপ্লবী না বোঝে, যে ঘটনায় সে ব্যথা পেল, তার তাৎপর্য তাকে কী করতে বলে। এই কথাটাই হচ্ছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মহান স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে মহান মাও সে তুং-এর উক্তি স্মরণীয়। বলেছিলেন, শোককে শক্তিতে পরিণত করো। এরপর মৃত্যু ঘটেছে কমরেড নীহার মুখার্জী সহ আরও অনেক নেতা-কর্মীর। এখন তো প্রতি সংখ্যা গণদাবীতে দুটো-একটা মৃত্যুর খবর থাকে। তাঁদের কাউকে চিনি, কাউকে চিনি না। কিন্তু বুঝতে পারি, এঁরা সকলেই কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা নিয়ে লড়াই করে গেছেন। এঁরা আমাদের সঙ্গে একই সাথে ২৪ এপ্রিলের মিটিংয়ে সামিল হয়েছেন। আরও বহু মিছিলে সামিল হয়েছেন। এমনকি গত ৫ আগস্ট ব্রিগেডে মিটিং শুনে গেছেন, এমন কমরেডেরও মৃত্যু ঘটেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষভাবে আমাদের দলে যাঁরা গত ৮-১০ বছরের মধ্যে যুক্ত হয়েছেন, যাঁরা কমরেড মানিক মুখার্জীকে প্রত্যক্ষভাবে দেখার বা চেনার সুযোগ পাননি, এমন বেশ কিছু নতুন ছাত্র-যুবক– তাঁদের জানার জন্য আমি কিছু কথা বলব। শোকপ্রস্তাবে সংক্ষিপ্তভাবে আছে, আমি কিছুটা ব্যাখ্যা করব এবং তাঁর চরিত্রের যেসব বৈশিষ্ট্য আমাকে আকৃষ্ট করেছে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা সৃষ্টি করেছে, সেগুলি আপনাদের কাছে রাখব।

শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন কমরেড প্রভাস ঘোষ

কমরেড মানিক মুখার্জী বয়সে আমার থেকে খানিকটা এগিয়ে। আমি, কমরেড মানিক মুখার্জী, কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, আমরা সকলেই কাছাকাছি বয়সের। কেউ একটু এগিয়ে, কেউ পিছিয়ে খানিকটা। কমরেড হিসাবেও আমরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। এটা পুরানো কমরেডরা জানেন। এই প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, আমাদের দলে কমরেডশিপটাও একটা কথার কথা নয়। মহান মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিকতাবাদকে সামনে রেখে ব্যক্তিগত স্বার্থ, ঈর্ষা, দ্বেষ-বিদ্বেষ মুক্ত সর্বহারা সংস্কৃতির ভিত্তিতে একটা আন্তরিক সম্পর্ক– এটাই কমরেডশিপ। এই কমরেডশিপ শুধু একটা দেশের মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যেও এই সম্পর্ক আমাদের মধ্যে থাকে, গড়ে ওঠে, এর ভিত্তিতে আমরা লড়াই করি দেশে দেশে। ফলে যখন কমরেড বলি, সেটা শুধু একটা কথার-কথা নয়।

কমরেড শিবদাস ঘোষের সঙ্গে কমরেড মানিক মুখার্জীর পরিচয় আমার আগে। শোকপ্রস্তাবে আপনারা শুনেছেন, ঢাকায় তিনি কমরেড শিবদাস ঘোষকে দেখেছেন দেশভাগের আগে। কিন্তু বোঝার মতো বয়স তখন তাঁর নয়। এখানেও পার্টির সাথে যুক্ত হয়েছেন– আমার ধারণা, আমার আগে। আমি ১৯৫০ সালে যখন যুক্ত হই, তখন তাঁকে পার্টিতে দেখি। এটাও আপনারা শুনেছেন, প্রথমেই পার্টি তাঁকে দায়িত্ব দেয় কমরেড শিবদাস ঘোষের গাইডেন্সে আমাদের দলের কিশোর সংগঠন ‘কমসোমল’ গড়ে তোলার। এই কমসোমলের সদস্য ছিলেন কমরেড প্রতিভা মুখার্জীও। কমরেড বাদল পাল, কমরেড ব্রজগোপাল সাহা– এঁরা সকলেই প্রয়াত, অনেকেই এঁদের নাম জানেন না, কিন্তু এঁরা একসময় খুবই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে গেছেন। এঁদের ইনচার্জ হিসাবে মানিক মুখার্জী কাজ করেছিলেন। ডিএসও গঠনের যে প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেখানে আমার সাথে যুক্ত কনভেনর ছিলেন কমরেড মানিক মুখার্জী। কিন্তু তিনি পরপর দু’বার টিবিতে ও একবার জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে কিছু দিন প্রত্যক্ষভাবে কাজ করতে পারেননি। তখন টিবির চিকিৎসাও খুব ভাল ছিল না। প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ ননী গুহ আমাদের পার্টিকে খুব ভালবাসতেন, কমরেড শিবদাস ঘোষকে খুব শ্রদ্ধা করতেন, তাঁরই চিকিৎসা আর কমরেড শিবদাস ঘোষের সেবাযত্ন– সবকিছু মিলিয়ে উনি সুস্থ হন।

আরেকটা কথা আমি বলব, প্রথম যুগে আমারও একটা লিমিটেশন ছিল, মেলামেশায় একটা আড়ষ্টতা ছিল। কমরেড মানিক মুখার্জীও মেলামেশার সুযোগ পাননি, তাঁরও একটা আড়ষ্টতা ছিল। কিন্তু যখন কমরেড শিবদাস ঘোষ দায়িত্ব দিলেন বুদ্ধিজীবী সংগঠন গড়ার, তিনি বিনা দ্বিধায় দায়িত্ব নিলেন। আমাদের দলে প্রথম দিকে কয়েকজন বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এসেছিলেন। কিন্তু তখন কমরেড শিবদাস ঘোষ পার্টি গড়ার কাজে এত ব্যস্ত ছিলেন যে, এটাকে ভিত্তি করে কোনও সংগঠন গড়ার কথা তখন ভাবতে পারেননি। ১৯৬৩ সালে কিছু অধ্যাপক, সরকারি কর্মচারী এবং কিছু ইঞ্জিনিয়ার পার্টির সাথে যুক্ত হন। সেই সময়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ কমরেড মানিক মুখার্জীকে দায়িত্ব দেন, এঁদের নিয়ে একটা বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন গড়ে তোলার। এটা শুধু একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন– এভাবে বললে আংশিক বলা হবে। এঁদের মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞানের তত্ত্বগত চর্চা, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হত এবং প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে তিনি আলোচনা করে আসতেন, যা নিয়ে ওই বৈঠকে আলোচনা চলত, সকলে মতামত দিতেন। আবার তিনি কমরেড শিবদাস ঘোষকে সেগুলি রিপোর্ট করতেন। আবার কমরেড শিবদাস ঘোষ সেই আলোচনাকে গাইড করার জন্য তাঁকে গাইড করতেন। এইভাবে বুদ্ধিজীবীদের একটা সংগঠন গড়ে ওঠে যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা চর্চা হত। কিন্তু তা একটা বিশুদ্ধ বুদ্ধিজীবী সংগঠন ছিল না। এঁরা পার্টির অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন। এঁরা পার্টির প্রোগ্রামে অংশ নিতেন। এঁদের মধ্যে একদল পার্টির ইংরেজি মুখপত্র ‘প্রলেটারিয়ান এরা’তে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। অন্যান্যরা অধ্যাপক আন্দোলনে থাকতেন। এই সংগঠনটা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কমরেড মানিক মুখার্জীর কর্মক্ষমতা, দক্ষতা বিকাশের সূচনা ঘটে যেটা আমি লক্ষ করেছি। ‘পথিকৃৎ’-এর উদ্যোগে শরৎসাহিত্য চর্চার একটা আন্দোলন গড়ে ওঠে। শরৎচন্দ্র এ দেশের ঘরে ঘরে খুবই আদৃত ছিলেন। একটা সময়ে শরৎ-সাহিত্য পড়েনি এমন লোক ভারতবর্ষে ছিল না বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ যাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, সাহিত্যিক হিসাবে শরৎচন্দ্র মানুষের অন্তরে যতটা প্রবেশ করেছেন, এর আগে কেউ এতটা পারেননি। তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের গভীর প্রশংসা আছে। কিন্তু একদল বুদ্ধিজীবী, এর মধ্যে তথাকথিত কমিউনিস্টরাও আছেন, যাঁরা বিদ্যাসাগরের অবমূল্যায়ন করেছেন, শরৎচন্দ্রের অবমূল্যায়ন করেছেন। ‘শরৎচন্দ্র দরদি কথাসাহিত্যিক’, ‘শরৎচন্দ্রের মধ্যে সমস্যা আছে সমাধান নেই’, ‘তিনি মধ্যবিত্ত দোদুল্যমানতার শিকার ছিলেন’, ‘তিনি বিচ্ছেদ দেখিয়েছেন, মিলন করাতে তাঁর সাহস ছিল না’, ‘তিনি রসস্রষ্টা, কিন্তু তিনি তত্ত্বজ্ঞানী ছিলেন না, তত্ত্বব্যাখ্যাতা ছিলেন না’– এইরকম নানা মন্তব্য তাঁরা করেছেন। এর বিরুদ্ধে কমরেড শিবদাস ঘোষ শরৎচন্দ্রের যথার্থ চরিত্র ও তাৎপর্য কী, তা উপস্থিত করলেন ভারতবর্ষের সামনে, বিশ্বের সামনে। তিনি দেখালেন শরৎচন্দ্র দর্শনের ক্ষেত্রে বস্তুবাদী এবং তিনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। শরৎচন্দ্র সেইযুগে গান্ধীজির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের পক্ষে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র ধর্মীয় চিন্তা, শাশ্বত ঐতিহ্যবাদকে ফাইট করেছেন। নীতিনৈতিকতার মান কী ভাবে অর্জন করতে হয় তা দেখিয়েছেন শরৎচন্দ্র। তিনি দেখিয়েছেন এথিক্যাল মাদারহুড, এথিক্যাল ব্রাদারহুড কাকে বলে। শরৎচন্দ্র সেই যুগের বিপ্লবীদের সামনে শ্রমিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা উত্থাপন করেছেন। শরৎ সাহিত্য কনটেন্টে, ফর্মে, শিল্পনৈপুণ্যে বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ– কমরেড শিবদাস ঘোষ এটা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ নিয়ে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত কমরেড শিবদাস ঘোষের ছ’টি ভাষণ আয়োজন করেছিল পথিকৃৎ। যেটা আগে সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি সংকলন হিসাবে (‘শরৎ মূল্যায়ন প্রসঙ্গে’) বেরিয়েছিল, সম্প্রতি ‘শরৎচন্দ্রের চিন্তা ও সাহিত্য’ নামে পুস্তক আকারে বেরিয়েছে। এই আলোচনা একটা মূল্যবান সম্পদ শুধু সাহিত্যের অর্থেই নয়, দর্শন, জ্ঞানবিজ্ঞান, সর্বহারা সংস্কৃতি ইত্যাদি বহু বিষয়ে তিনি এখানে আলোচনা করেছেন। শরৎচন্দ্র সম্পর্কে কমরেড শিবদাস ঘোষের যে ব্যাখ্যা, বক্তব্য তা এই রাজ্যের জেলায় জেলায়, ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তে প্রচারের ক্ষেত্রে কমরেড মানিক মুখার্জী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এটা এখানে উল্লেখ করা দরকার। বহু জায়গায় বহু আলোচনা তিনি করেছেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্যকে তিনি নিয়ে গেছেন বিভিন্ন স্থানে।

তাঁর সাথে হিন্দি সাহিত্যিক বিষ্ণু প্রভাকরের যোগাযোগ ঘটে প্রেমচন্দের শতবার্ষিকী করতে গিয়ে। বিষ্ণু প্রভাকর তাঁর কাছ থেকে শরৎচন্দ্র সম্পর্কে শোনেন। শুনে তিনি আকৃষ্ট হন। বিষ্ণু প্রভাকর শরৎচন্দ্রের জীবনী লিখেছিলেন। তিনি বললেন, এই বক্তব্য তো আগে আমি জানতাম না। তা হলে তো আমার পক্ষে শরৎচন্দ্রকে নতুন ভাবে চেনার সুযোগ হত। বিষ্ণু প্রভাকর এই বক্তব্য একটা রেডিও ভাষণে রেখেছিলেন শিবদাস ঘোষের কথা উল্লেখ করে। কমরেড মানিক মুখার্জী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন কমরেড শিবদাস ঘোষের শরৎচন্দ্র সম্পর্কে এই ব্যাখ্যা উপস্থিত করার ক্ষেত্রে। তিনি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে, শরৎচন্দ্র সম্পর্কে গোল্ডেন বুক তো বের করেই ছিলেন। পার্টির অন্য বক্তারাও শরৎচন্দ্র সম্পর্কে বত্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু এখানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন কমরেড মানিক মুখার্জী। ১৯৭৫ সালে আমাদের উদ্যোগে শরৎচন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হয় সমগ্র দেশে। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল), সম্পাদক ছিলেন মানিক মুখোপাধ্যায়। দেশব্যাপী এই অনুষ্ঠান হয়।

এখানে আমি আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। ১৯৭৭ সালে সিপিএম সরকার ঘোষণা করে প্রাইমারিতে ইংরেজি ও পাশ-ফেল তুলে দেবে। আমাদের দল এর প্রতিবাদ জানায়। ১৯৭৮ সালে ওই সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বাধিকার হরণ করে। এর প্রতিবাদে ‘শিক্ষাসংকোচনবিরোধী ও স্বাধিকার রক্ষা কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটিতে মানিক মুখার্জী সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন। সভাপতি হন সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। এই সময়েই পার্টি তাঁকে দায়িত্ব দেয় এই আন্দোলনে সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীদের সামিল করার। আর আমার উপর দায়িত্ব পড়ে জেলায় জেলায় গিয়ে কর্মীদের আন্দোলনে নামানো– সেটা এখানে উল্লেখযোগ্য নয়। এই সময়ে কমরেড মানিক মুখার্জী শুধু ভারতবর্ষেরই নয়, এশিয়ার প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডঃ সুকুমার সেন, প্রমথনাথ বিশী, সন্তোষ ঘোষ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অরবিন্দ বসু, মনোজ বসু, রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্ত, প্রতুল গুপ্ত, ডঃ নীহাররঞ্জন রায়, নীহার মুন্সি– এরকম বহু বুদ্ধিজীবীদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন এবং এই আন্দোলনের গুরুত্ব বোঝাতে থাকেন। এটা সহজ কাজ ছিল না। মানিক মুখার্জীকে তখন কে চিনত, কে জানত? তখন তাঁর এ রকম পরিচিতি ছিল না। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে পার্টির বক্তব্য জানা এবং উত্থাপন করা এক নয়। বক্তব্যকে কতটা বুঝতে পেরেছি এবং সেটা সঠিকভাবে উত্থাপন করে অপরকে কনভিন্স করতে পেরেছি, এ অনেক বড় কাজ এবং এই ধরনের সব প্রতিষ্ঠিত মানুষদের কনভিন্স করার চেষ্টা খুব কঠিন ছিল। তখন সিপিএম সরকার খুব শক্তিশালী ছিল। তাদের অধীনেও অনেক শিক্ষাবিদ ছিলেন। আমরা যেমন বোঝাচ্ছি, তাঁরাও বোঝাচ্ছেন। তার মধ্যেই বুঝিয়ে এঁদের এই আন্দোলনের পক্ষে টানার মতো দুরূহ কাজটাই কিন্তু তখন কমরেড মানিক মুখার্জী করেছিলেন। দিনের পর দিন এঁদের কাছে যেতেন, কথা বলতেন, আলোচনা করতেন। বয়সে এঁদের সকলের থেকেই ছোট ছিলেন। এঁনারা প্রতিষ্ঠিত, তিনি প্রতিষ্ঠিত নন। সেই অবস্থায় তাঁদের বোঝানো, তাঁদের জয় করা, তাঁদের ভালবাসা-স্নেহ অর্জন করা, তাঁদের আস্থা অর্জন করা একটা কঠিন সংগ্রাম ছিল। এই সংগ্রামটা তিনি সফলভাবে করেছিলেন এবং এঁরা সকলেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।

১৯৭৮ সালে একটা কনভেনশন হয়। তাতে প্রথম কমিটি তৈরি হয়। এরপরে ১৯৭৯ সালের ১৫ জুন আমরা পার্টির উদ্যোগে একটি ঐতিহাসিক আইন অমান্য আন্দোলন করি– সিপিএম সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রত্যক্ষ আন্দোলন। রাজভবনের সামনে লাঠির আক্রমণে বহু মানুষ আহত হন, রক্তাক্ত হন। গোটা রাজ্যেই তার একটা বিরাট প্রভাব পড়েছিল। এখানেও অন্যান্য দাবির সাথে পার্টির পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছিল, ইংরেজি ও পাশফেল প্রথা পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে। এরপরে ১৯৮১ সালের ৮ জানুয়ারি ডঃ সুকুমার সেন সহ বুদ্ধিজীবীরা রাজভবনের সামনে অবস্থান করেন। ২৭ জানুয়ারি একটা বড় সম্মেলন হয়। ২ ফেব্রুয়ারি মহাকরণ অভিযান হয়। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে ১৬ থেকে ২১ পর্যন্ত একটা অভাবনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। প্রথম দিন বুদ্ধিজীবীদের আইন অমান্য, তাতে ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ও ছিলেন। শুধু সুকুমার সেন যেহেতু হাঁটাহাঁটি করতে পারতেন না, তিনি আসেননি, বাকি সকলেই ছিলেন। হাঁটতে অসুবিধা হত গৌরী আইয়ুব নামের একজন বুদ্ধিজীবীর, তবুও তিনি ছিলেন। তারপর মহিলাদের আইন অমান্য, তারপর শিক্ষকদের আইন অমান্য, তারপর কৃষক-শ্রমিকদের আইনঅমান্য, সবশেষে ছাত্রদের আইন অমান্য। এটা পরপর পশ্চিমবাংলায় ঘটেছিল। গোটা রাজ্যেই শুধু নয়, এই কর্মসূচি ভারতবর্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপরেও নানা মুভমেন্ট, প্রোগ্রাম চলতে থাকে। ১৯৯৬ সালে ১৭ ডিসেম্বর এক কোটি মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আমাদের দলের তরফ থেকে দাবিপত্র জমা দিই। ১৯৯৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পার্টির থেকে আমরা বাংলা বনধ ডাকি। শিক্ষার দাবিতে সফল বনধ হয়। ওই বছরেই ২১ ডিসেম্বর সিপিএম সরকার ঘোষণা করতে বাধ্য হয় প্রাথমিকে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা চালু করবে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উত্তাল জনমতের চাপে দাবি মানতে বাধ্য হয়। কিন্তু পাশফেল প্রথা তারা চালু করেনি। ফলে আজও বেসরকারিভাবে বৃত্তি পরীক্ষা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করছে।

এই যে বুদ্ধিজীবীদের সামিল করানো, আন্দোলনে নামানো, এঁরা অনেকেই কোনও আন্দোলনেই কোনও দিন নামেননি। স্বাধীনতা আন্দোলনে থাকতে পারেন, পরবর্তীকালে নয়। তাঁদের বুঝিয়ে নামানো, আইন অমান্য করানো প্রত্যক্ষভাবে, যেটা আমি আগেই বলেছি এবং এটা করতে গিয়ে তাঁদের মধ্যেও খানিকটা পার্টির প্রভাব, বক্তব্যের প্রভাব কমরেড মানিক মুখার্জী ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে সাহিত্যিক-সাংবাদিক সন্তোষ ঘোষের কথা আমি বলব। তিনি কমিউনিস্ট বিরোধী ছিলেন। কিন্তু মানিক মুখার্জীর সাথে ঘনিষ্ঠতার ফলে বহু আলাপ-আলোচনার পর এমন কথাও বলেছেন যে, আমি আমার যৌবনে যদি আপনাদের মতো কমিউনিস্টদের দেখা পেতাম তাহলে আমার বিভ্রান্তি হত না। তিনি রাবীন্দ্রিক স্কুলের মানুষ ছিলেন। শরৎচন্দ্রকে তিনি উচ্চ আসন দিতেন না, বলতেন, শরৎচন্দ্রের মধ্যে হৃদয়বৃত্তি আছে, বুদ্ধিবৃত্তি নেই– এইসব। কিন্তু কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য যখন কমরেড মানিক মুখার্জী তাঁর কাছে উপস্থিত করলেন, তিনি তা গ্রহণ করলেন। এই মহাজাতি সদনেই একটা সভায় তিনি বললেন, শরৎচন্দ্র সম্পর্কে আমার আগের চিন্তা ভুল ছিল। আমাদের ধারণাটাই তিনি উপস্থিত করলেন। এই সন্তোষ ঘোষের সাথে আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষের বিরোধ পর্যন্ত সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। সন্তোষ ঘোষ ভাষা আন্দোলনের পক্ষে এডিটোরিয়াল (সম্পাদকীয় কলাম) লিখছেন। আনন্দবাজারকে বস্তুত সন্তোষ ঘোষই জনপ্রিয় করেছিলেন। তখন মালিক অশোক সরকার জীবিত। তিনি এর জন্য সন্তোষ ঘোষের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর ছেলে অভীক সরকার সন্তোষ ঘোষকে কাকা ডাকত। কিন্তু এই অভীক সরকার আমাদের দলের প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন। ব্যঙ্গ করে বলতেন, কাকা তো এসইউসি-র লোক হয়ে গেলেন। আপনি কি এবার এসইউসি-র পক্ষে লিখবেন? সন্তোষ ঘোষ বিরক্ত হয়ে দু’বার রিজাইন করতে গিয়েছিলেন। অশোক সরকার গিয়ে তাঁকে নিবৃত্ত করেন, কারণ আনন্দবাজারের অ্যাসেট ছিলেন সন্তোষ ঘোষ। ডঃ সুকুমার সেন বলেছিলেন, আমি স্বদেশি আন্দোলনেও ছিলাম না। শিক্ষাই আমার রাজনীতি, তাই আমি এসেছি। সেই সুকুমার সেনকে তাঁর এক ছাত্র– সিপিএমের সাথে যুক্ত এক অধ্যাপক– বললেন, ‘স্যার আপনি শেষপর্যন্ত এসইউসি-র ছাতার তলায় গেলেন! ডঃ সেন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওঁরা তো আমার মাথায় ছাতা ধরেছে, লাঠি তো মারেনি’। তিনি মানিক মুখার্জীকে একদিন বলছেন, ‘আপনাদের দলের ছেলেরা চাঁদা তুলছে রাস্তায় রাস্তায়, কই আপনি তো আমাদের কাছে চান না!’ মানিক মুখার্জী বললেন যে, আপনার কথা ভাবতে পারিনি। তখন তিনি পাঁচশো টাকা চাঁদা দিলেন দলকে। তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন, বলছেন আমি আচার-বিচার মানি না, আমার ছেলে মানে। কিছু ব্রাহ্মণকে খাওয়াতে হবে, আপনি তো মুখার্জী, আপনিও মানেন না, কিন্তু আপনি আসবেন। মানে ঘনিষ্ঠতার সম্পর্কটা এমন হয়ে গিয়েছিল। প্রমথনাথ বিশী আমাদের প্রয়াত কমরেড অধ্যাপক সুবীর বসুরায়কে বলেছিলেন, আপনাদের দলের ছেলেমেয়েদের দেখে আমাদের ছোটবেলার স্বদেশি আন্দোলনের কথা মনে পড়ে। তিনি প্রস্তাব দেন, আপনারা প্রাথমিক ছাত্রদের নিয়ে একটা অবস্থান করুন। এটা আমরা করেছিলাম। গোটা রাজ্যের সমস্ত জেলা থেকে দলে দলে প্রাথমিক ছাত্রছাত্রী এনে আমরা অবস্থান করিয়েছিলাম। প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ অরবিন্দ নাথ বসু তো আমাদের দলের খুবই কাছাকাছি এসে গিয়েছিলেন। ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রদের প্রোগ্রাম হচ্ছে, তখন ছাত্রদের পক্ষ থেকে ছাত্রসংগ্রাম কমিটি হয়েছিল। তারাও আন্দোলন করেছে পাশাপাশি। ডঃ নীহাররঞ্জন রায় ছাত্রদের সেই অবস্থানে চলে গেলেন। বলছেন, আমার যৌবনের দিনের কথা মনে পড়ছে। এই যে সমস্ত কর্মকাণ্ড হয়েছে, এ ক্ষেত্রে কমরেড মানিক মুখার্জীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলেই আমি ঘটনাগুলি আপনাদের সামনে রাখলাম।

তারপর অল ইন্ডিয়া কমিটি হল। অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির সভাপতি হলেন জাস্টিস ভি আর কৃষ্ণ আইয়ার। জেনারেল সেক্রেটারি হলেন সুশীল কুমার মুখোপাধ্যায়। কমরেড মানিক মুখার্জী ছিলেন সহসভাপতি। বাস্তবিক তিনিই এই কমিটির কাজকর্ম দেখতেন। তারই ধারাবাহিকতায় এখন তো সেভ এডুকেশন কমিটির নামে এখন মুভমেন্ট হচ্ছে।

এরপরে কমরেড নীহার মুখার্জী তাঁকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেন। বাংলাদেশে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীও দায়িত্ব নিয়েছেন। দু’জনেরই যুক্ত ভূমিকা আছে এখানে। এর আগে লন্ডনে কমরেড মানিক মুখার্জী শরৎ সাহিত্য নিয়ে একটা আলোচনায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। বিবিসি বাংলায় সেটা ব্রডকাস্ট করেছিল। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস-এ মে দিবস উপলক্ষে সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাদের কমিউনিস্ট পার্টি মনে করত, তাদের ডাকত। এ দেশ থেকে আমাদের এবং নকশালপন্থীদের ডাকত। এর অধিকাংশ মিটিংয়ে কমরেড মানিক মুখার্জী যোগ দিয়েছেন। কমরেড মানিক মুখার্জী জার্মানিতে গিয়ে সেখানে আগেকার যারা কমিউনিস্ট ছিলেন পূর্ব জার্মানির, তাঁদের সাথে যোগাযোগ করে কথাবার্তা বলেছেন। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডেও তিনি গেছেন। ১৯৯৫ সালে কলকাতায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সম্মেলন হয়েছিল, বিদেশ থেকে বহু প্রতিনিধি এসেছিলেন। তাতে জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ার সভাপতিত্ব করেছিলেন। ২০০৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল ব়্যামসে ক্লার্ক– তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিলেন– তিনি কলকাতার সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। সেইসময়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলছে। সেখানেও তিনি গিয়েছিলেন। নেপালে রাজতন্ত্রের অবসানের পর যখন প্রথম নির্বাচন হয়, নেপালের মাওবাদী পার্টি কমরেড মানিক মুখার্জীকে অনুরোধ করে যাতে ব়্যামসে ক্লার্ক সেই ইলেকশনের তদারকি করার জন্য যান। কমরেড মানিক মুখার্জীর অনুরোধে ব়্যামসে ক্লার্ক নেপালে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক আক্রমণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে, এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ফোরামের পক্ষ থেকে কমরেড মানিক মুখার্জী তখন বাগদাদ গিয়েছিলেন। সেখানকার যুদ্ধবিরোধী সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। লেবাননের বেইরুটে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। এই সমস্ত সম্মেলনে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরাক, সুদান, সিরিয়া, আমেরিকা, কিউবা, বাংলাদেশ সহ আরও কিছু দেশ অংশগ্রহণ করে। লেবাননের সম্মেলনে হিজবুল্লা সংগঠনও ছিল। তাদের প্রতিনিধিদল কলকাতাতেও এসেছিলেন। ওদের এক নেতার এক সন্তান ইজরায়েলের আক্রমণে মারা গিয়েছিল। সন্তানের সেই রক্তাক্ত কাপড় তিনি এখানে দেখিয়েছিলেন। হিজবুল্লার প্রধান কমরেড মানিক মুখার্জীর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। কমরেড মানিক মুখার্জী সুদান, সিরিয়া, তুরস্ক, কানাডা, কিউবা, ভেনেজুয়েলার বিভিন্ন সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছেন। কিম ইল সুং-এর জন্মশতবার্ষিকীতে আমন্ত্রিত হয়ে উত্তর কোরিয়ায় গিয়েছিলেন। সমস্ত জায়গাতেই এক দিকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের বার্তা, অন্য দিকে মার্ক্সবাদে কমরেড শিবদাস ঘোষের অমূল্য অবদানগুলি তিনি উপস্থিত করেছেন। অনেকেই সেই সব পুস্তক সংগ্রহ করেছেন। আরও সংগ্রহ করতে চেয়েছেন। তাঁদের সাথে আলোচনা হয়েছে। এই ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই যে এত দেশে যাওয়া, বিভিন্ন দলের সাথে সংযোগ স্থাপন, তাদের নেতাদের সাথে বৈঠক, তাঁদের আকৃষ্ট করা, তাঁদের প্রোগ্রামে সামিল করানো, তাঁদের মধ্যে আমাদের দল সম্পর্কে আকর্ষণ সৃষ্টি করা, কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা সম্পর্কে আকর্ষণ সৃষ্টি করা– এইসব ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য।

তিনি পার্টির কলকাতা জেলা সম্পাদক ছিলেন বহুদিন। রাজ্য পার্টির তরফ থেকে সেক্রেটারিয়েট মেম্বার হিসাবে মুর্শিদাবাদ জেলার দায়িত্বে ছিলেন অনেক দিন। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটির তরফ থেকে অল ইন্ডিয়া ডিওয়াইওকে তিনি গাইড করেছেন। আরও বহু আন্দোলনে বহু জায়গায় তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। আমি এখানে একটি কথা বলতে চাই। এই যে তাঁর ভূমিকা, কাজ, তা নিয়ে এতটুকু আত্মপ্রচার, আমি এই এই করেছি বলে নিজেকে জাহির করা, এতটুকু অহঙ্কার, দম্ভ– কোনও কিছু আমি তাঁর মধ্যে কোনও দিন খুঁজে পাইনি, যেটা খুবই শিক্ষণীয়। আমরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমি যে ঘটনাগুলো বলেছি, বহু কমরেডই তা জানেন, যদিও সেইসময় জানতেন না। একত্রে কথা হত, গল্প হত। তখন শুনতাম কাজকর্ম নিয়ে। আমি স্টেট সেক্রেটারি, উনি ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি। কোথাও গেলে কী হল, না হল জিজ্ঞাসা করতাম। এইভাবেই কিছু কিছু জেনেছি। কিন্তু তাঁর আচরণে আত্মপ্রচার, অহঙ্কার, দম্ভ এতটুকুও ছিল না। তিনি আমার আগেই পার্টির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন। এই সুযোগ আমরা কেউই পাইনি। যদিও এই নিয়ে তাঁর দুঃখ ছিল। আমি তাঁর কিছু কথা পড়ে শোনাব। কিন্তু আমি রাজ্য কমিটির সেক্রেটারিয়েট মেম্বার, তখনও তিনি সেক্রেটারিয়েটে ছিলেন না। পার্টির প্রথম কংগ্রেসে বয়সেও তাঁর থেকে ছোট, রাজনীতিতেও জুনিয়ার, তাঁরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হলেন। কিন্তু কমরেড মানিক মুখার্জী নেই। এই নিয়ে এতটুকু তাঁর প্রশ্ন, ক্ষোভ, দুঃখ– আমি কেন নেই, ও কেন আছে, আমি তো ওর থেকে অনেক সিনিয়ার, আমি তো এই করেছি, ওই করেছি, এসব বলা তো দূরের কথা, তাঁর ভাবনার মধ্যেও এ সবের স্থান ছিল না। এগুলি আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, আমি নিজে একবার কলকাতার কর্মীসভায় তাঁর কিছু ত্রুটি নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিলাম। ভালোবাসতাম বলেই তো সমালোচনা করেছিলাম। আরেকবার এই মহাজাতি সদনে পশ্চিমবাংলার জেনারেল বডির মিটিংয়ে সমালোচনা করেছিলাম। তারপরেই কিন্তু আমরা একত্রে চা খেয়েছি, গল্প করেছি। তাঁর মধ্যে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার এতটুকু প্রভাব ছিল না। শুধু আমার বলার মধ্যে একটা ইনফর্মেশনের ভুল ছিল, সেটা কারেক্ট করে দিয়েছিলেন। কেন বললে, কেন এরকম করলে, একটু মুখভার হওয়া এসব ছিল না। এসব জিনিস খুবই শিক্ষণীয়।

আজকে এখানে বহু কমরেড আছেন, যদিও রাজ্যের সকলে আসতে পারেননি আমি জানি, না হলে এই হলে স্থান সঙ্কুলান হত না। হলের বাইরে বসে এবং অনলাইনে অনেকে শুনছেন।

তরুণ কর্মীদের উদ্দেশে আমি বলছি, যে গুণগুলির উল্লেখ আমি করলাম সেগুলো আমাদের কাছে শিক্ষণীয়, আপনাদের কাছেও শিক্ষণীয়। আরও একটা কথা আমি উল্লেখ করব। কমরেড শিবদাস ঘোষের মৃত্যুর পর কমরেড নীহার মুখার্জী যখন অসুস্থ, প্রায় মৃত্যুশয্যায়, তখন পার্টির অভ্যন্তরে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময় সেই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কমরেড মানিক মুখার্জীকে আমি পাশে পেয়েছিলাম। আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু সেই স্বীকৃতিই আমি আজ এখানে দিতে চাই। আর একটা গুণ, কমরেড মানিক মুখার্জী যে-কোনও কমিটি মিটিংয়ে থাকলে খুব সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য, মূল কথাটা রাখতেন, অল্প কথায় বলতেন। যদি তাঁর কথা অন্য কেউ বলত, তা হলে বলতেন, ‘‘ওই কথাটাই আমার কথা, আমি আর আলাদা করে বলতে চাই না।’’ অনেকের ক্ষেত্রে হয়, তাঁর কথাটা কেউ বলার পরও বক্তা আবার একই কথা বলতে থাকেন। অনাবশ্যক কথা বলার অভ্যাস তাঁর ছিল না। নিজের কথা অল্প কথায় বলতেন, মূল কথাটা সহজ ভাষায় বলতেন। কমরেডরা ভুল করলে, অন্যান্যরা সাধারণত রাগারাগি বা বকাবকি করতেন, তিনি সহজে সেই কমরেডদের ত্রুটি ধরিয়ে দিতে পারতেন। তিনি খুব অ্যাপ্রোচেবল ছিলেন, যে কোনও কর্মী তাঁর কাছে নির্দ্বিধায় যে কোনও বক্তব্য, যে কোনও সমালোচনা এমনকি তাঁর সম্পর্কেও সমালোচনা ব্যক্ত করতে পারতেন।

আমি, কমরেড মানিক মুখার্জী ও কমরেড মুবিনুল হায়দার, বয়সে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও প্রথম দিকে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। পরে কর্মসূত্রে সবাই আলাদা হয়ে গেলাম। ৪৮ লেনিন সরণির অফিসে কমরেড শিবদাস ঘোষ একটার পর একটা নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। আমরা তখন ছোট। আমরা অনুপ্রাণিত হতাম। অফিস থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসপ্ল্যানেডের ট্রাম ডিপোর ওখানে যেতাম। বাদাম কিনে বসতাম আর ওই বয়সে রোম্যান্টিক স্বপ্ন দেখতাম যে, আমরা ভবিষ্যতে পার্টির জন্য কে কী করব। এরপর কমরেড হায়দার খিদিরপুরের দিকে চলে যেতেন লাস্ট ট্রামে, আমি দক্ষিণ কলকাতা চলে যেতাম, কমরেড মানিক মুখার্জীও উত্তর কলকাতা চলে যেতেন। আবার আমি, কমরেড মানিক মুখার্জী ও কমরেড হায়দার শেষবারের মতো একত্রে মিলিত হয়েছিলাম সল্টলেকে। যখন তিনি পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত। ২০১১ সাল থেকে এই রোগে তিনি আক্রান্ত, যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত কমরেড মানিক মুখার্জি পাবলিক প্লেসে বক্তব্য রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর বক্তব্য অনেকের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি করত। ২০১৬ সালে এআইডিওয়াইও-র একটা প্রোগ্রাম এবং ২০১৭ সালে পথিকৃৎ অথবা অন্য কোনও একটি সংগঠনের প্রোগ্রামে অসুস্থতাজনিত কারণে তাঁর স্মৃতি ভাল কাজ করছিল না, একই কথার পুনরাবৃত্তি করছিলেন। এরপর আর পাবলিক প্লেসে তিনি বলতে পারেননি। ২০১৫ সাল পর্যন্তই তিনি সাবলীল ভাবে বক্তব্য রাখতে পেরেছিলেন। কয়েক বছর আগে কমরেড হায়দারকে নিয়ে যখন ওনার সাথে দেখা করতে গেলাম তখন উনি অসুস্থ। উনি বললেন, ‘‘পার্টি আমাকে দেখছে, খরচ করছে, ওষুধপত্র দিচ্ছে, দেখাশোনা করার লোক দিচ্ছে, কিন্তু কিছুই তো আমি করতে পারছি না। এইভাবে বেঁচে থেকে লাভ কী’?’ আক্ষেপ করেছিলেন। আমাদের যা বলার আমরা বলেছিলাম। বাস্তবিকই, যে মানুষ কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা বহন করে পুরো বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন, শেষদিকে সেই মানুষকে বাথরুম যেতে, স্নান করতে, খেতে, সমস্ত নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ করতে, উঠতে-বসতে অন্যের সাহায্য নিতে হত। পরবর্তীতে ডিমেনসিয়া রোগেও আক্রান্ত হলেন। স্মৃতি ঠিক মতো কাজ করছিল না। মাথার কিছু সেল নষ্ট হল। আকস্মিক কিছু অস্বাভাবিক ও অসংযত আচরণ করে ফেলতেন। চলতি বছর ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হন। সে বারেই আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিয়ে কোনও ক্রমে বাঁচানো সম্ভব হয়। পরের বার আর বাঁচানো গেল না। সুগার ফল করল। রক্তে শর্করার মাত্রা পঞ্চাশের নিচে চলে গিয়েছিল, তার সাথে ভীষণ শ্বাসকষ্ট ছিল। অতি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই হার্ট ফেল করে মারা গেলেন।

এখন কমরেড মানিক মুখার্জী কমরেড শিবদাস ঘোষ সম্পর্কে ২০১৫ সালে যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তার কিছু আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি– ‘‘কমরেড শিবদাস ঘোষের সান্নিধ্যে আমরা যে থেকেছি, কতটুকু তাঁকে বুঝতে পেরেছি, জানতে পেরেছি! আজকে ভাবি, বহু সময় ওনার সাথে থেকেছি, আরও বহু কিছু জানতে পারতাম। কিন্তু সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছি। ভাল করে জানতে পারিনি। খুবই ছোট বয়স থেকে আমরা কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে একত্রে থেকেছি। দুপুরবেলায় সেন্টারে, কমিউনে মাদুর বা পাটি পেতে শোওয়া হত। ভাল বিছানা ছিল না। যে ভাবে উনি থাকতেন আপনারা আজ কল্পনা করতেও পারবেন না। একটা মাদুর বা পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকতেন। আমরা এসেছি, বলতেন, ‘পাশে শোও’। বালিশ ছিল না, পাশবালিশটা লম্বা করে ওনার পাশে শুয়ে পড়তাম। এইভাবে ঘনিষ্ঠভাবে জানা, বোঝা, থাকা, খাওয়া, ওঠা-বসা-শোওয়া সবই করেছি, কিন্তু চেনার ক্ষেত্রে একটা বিরাট গ্যাপ থেকেই গেছে। ওনাকে কি ঠিক বুঝতে পেরেছি? কতটা বুঝতে পেরেছি? কমরেড ঘোষ যখন পরবর্তীকালে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, কমিউনে তখন খাওয়া-দাওয়া অতি সাধারণ। ওনার জন্য কোনও ভাল ডায়েট, পুষ্টিকর খাদ্য আমরা তখন সংগ্রহ করতে পারিনি। ডাল-ভাত যা হয়েছে তিনি আমাদের সাথে খেয়েছেন হাসিমুখে, গল্প করে, আনন্দে। এইভাবে আমরা একত্রে থেকেছি।

কমরেড ঘোষ যে কথাটা বারবার বলতেন, “দেখো আমরা স্বেচ্ছায় একটা জীবন বেছে নিয়েছি– বিপ্লবী রাজনীতির জীবন। এই জীবন মানেই কৃচ্ছসাধন করব, এটা আমাদের ফিলজফি নয়। যদি জোটে ভাল খাব, যদি না জোটে আলুসিদ্ধ ভাতটাই খাব। কিন্তু এই যে পেলাম না, আলুসিদ্ধ খেলাম, এটার জন্য যেন আমাদের কোনও মনস্তাপ না থাকে যে, আমরা এটা খেতে পাইনি। বিপ্লবীদের খাবার জুটতে পারে, নাও জুটতে পারে। যদি ভালো খাবার জোটে, তৃপ্তি সহকারে খাব। আর যদি না জোটে, আলুভাতে-ভাত তৃপ্তি সহকারে খাবো।’ একটা বিরাট সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। কমরেড ঘোষ আমাদের কাছে একজন বিশাল মাপের মানুষ ছিলেন, এটা আপনারা বুঝতেই পারেন। কিন্তু এত সহজে এমনভাবে আমাদের সাথে মেলামেশা করতেন যে কোনও দিন মনেই হয়নি উনি একজন বড় মানুষ, আমাদের থেকে অনেকটা স্বতন্ত্র, আলাদা। এটা কখনও বুঝতে পারিনি। বারবার এ কথাটা আমার মনে হয়েছে– তাঁকে বুঝেছি কতটুকু? বাইরে থেকে দেখা আর সত্যিকারের বোঝা আলাদা। গভীরে গিয়ে দেখা, গভীরে গিয়ে জ্ঞানের নিরিখে বোঝা– এই জায়গাটা খুব একটা আমরা করতে পারিনি। বাইরে যাওয়ার আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাতে দেখেছি, শিবদাস ঘোষের এসব বই পড়ে অনেকে আমাকে অভিযোগ করেছেন যে, ‘এগুলো আপনারা আগে নিয়ে আসেননি কেন? ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ডে, বিদেশে কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্যের পরিচিতি করাননি কেন? আমরা তো জানতাম না এত বড় চিন্তানায়ক ছিলেন তিনি’– এই অভিযোগ শুনতে হয়েছে, এই অভিযোগ মাথা পেতে নিতে হয়েছে। আমরা তাঁর খুব কাছেই ছিলাম। আজ আপনারা এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই করতে পারেন যে কতটুকু তাঁর থেকে নিতে পেরেছি? প্র্যাকটিক্যালি বিশেষ কিছু নিতে পারিনি। তাঁর জীবন থেকে খুব বিশেষ কিছু শিখেছি এ রকম মনে হয় না। আজ বয়স হয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি, এই যে তিনি সারা জীবন একটা ব্যাচ অফ রেভেলিউশনারি তৈরি করার জন্য প্রাণপাত করে গেলেন, পরবর্তীকালে স্বাস্থ্য ভেঙে গেলেও এই যে চেষ্টা করে গেলেন, আমরা তার থেকে কতটুকু নিলাম? কতটুকু নিজেদের তৈরি করতে পারলাম?’’

এই ব্যথা, এই আক্ষেপ ২০১৫ সালে কমরেড মানিক মুখার্জী ব্যক্ত করেছেন। এখানে উল্লেখ করা নেই এ রকম একটি ঘটনাও আপনাদের কাছে বলতে চাই। এতে কমরেড শিবদাস ঘোষের একটি দিকের পরিচয় আপনারা পাবেন। যখন কমরেড মানিক মুখার্জীর জন্ডিস হয়েছিল, সেই সময় একদিন পার্টির একটি কালেকশনের প্রোগ্রাম (অর্থসাহায্য সংগ্রহের কর্মসূচি) পড়েছিল। সমস্ত কমরেডদের কালেকশনে চলে যেতে হবে। সেই সময় অসুস্থ মানিক মুখার্জীকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর শরবত করে খাওয়াতে হত। কমরেড শিবদাস ঘোষ বললেন ‘তোমরা যাও’। কমরেডরা প্রশ্ন করল, কমরেড মানিক মুখার্জীকে কে দেখবে? উনি বললেন, ‘ও একদিন শরবত না খেলেও চলবে, তোমরা যাও।’ কমরেডদের পাঠিয়ে দিলেন। তারপর কমরেড মানিক মুখার্জী দেখছেন কমরেড শিবদাস ঘোষ শরবত তৈরি করে তাঁর জন্য নিয়ে আসছেন। এইসময় সবার জন্য যে রান্না হত সেটা কমরেড মানিক মুখার্জীর স্বাস্থ্যের পক্ষে ঠিক ছিল না। সব্জি কেটে রান্না করে কমরেড ঘোষ নিয়ে আসতেন। এই ছিলেন কমরেড শিবদাস ঘোষ। শুধু ওখানকার কমরেডদের প্রতিই নয়, সকল কমরেডের প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা ছিল।

কর্মীদের সবার ঘরে একটা ছবি আছে। কমরেড শিবদাস ঘোষ সহ সাত জন নেতার ছবি। এঁরা পার্টির প্রথম ব্যাচ, এঁরা প্রত্যেকেই প্রয়াত। দ্বিতীয় ব্যাচ কমরেড তাপস দত্ত, কমরেড আশুতোষ ব্যানার্জী, কমরেড সুকোমল দাশগুপ্ত, কমরেড শীতেশ দাশগুপ্ত, কমরেড অনিল সেন, কমরেড অমৃতেশ্বর চক্রবর্তী, কমরেড বাদশা খান, এঁরাও প্রয়াত। তৃতীয় ব্যাচ বলতে কমরেড মানিক মুখার্জী, কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরি এবং আমি। দু’জন প্রয়াত, আমি এখনও আছি। আমার কাছাকাছি কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, মাত্র দু’বছর পিছনে আছেন। তিনিও এই তৃতীয় ব্যাচের মধ্যেই পড়তে পারেন। আর এখানে যাঁরা আছেন পলিটবুরো সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য– বেশিরভাগই আশির কাছাকাছি, মিড সেভেন্টি-মিড সিক্সিটি। ফলে দলের যারা যুবকর্মী, ছাত্রকর্মী তাদের উদ্দেশে আমি বলছি, গত ৫ আগস্ট যা বলার আমি বলেছি, কমরেড শিবদাস ঘোষের উক্তি পড়ে শুনিয়েছি, কী ভাবে এই পার্টিটা গড়ে উঠেছে। আজ পার্টির ব্যাপ্তি বিরাট। ভারতের ২৬টি রাজ্যে আমরা ছড়িয়ে পড়েছি এবং খুব বিনয়ের সঙ্গে আমরা বলতে পারি পার্টির শক্তিতে সিপিএমের ঠিক পরেই আমরা। একমাত্র লিবারেশন আরজেডির হেল্প নিয়ে বিহারে খানিকটা শক্তি রাখে। সিপিএমের লোক বেশি, কিন্তু অধিকাংশই নিষ্ক্রিয়, হতাশাছন্ন। সিপিএম, সিপিআই নির্বাচনী রাজনীতির গড্ডলিকা স্রোতে ভাসতে ভাসতে লেফট লাইনটাও ছেড়ে দিয়ে আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এখন কংগ্রেসের সঙ্গে চলে গেছে। এ আপনারা জানেন। ভারতবর্ষের লেফট মাইন্ডেড পিপল, সৎ বাম-মনস্ক মানুষ, প্রো-কমিউনিস্ট মাইন্ডেড পিপল যাঁরা এবং যাঁরা অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট পিপল, লিবারেল পিপল তাঁরা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। যে নেতাদের কথা বললাম তাঁদের বয়স অনেক। প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরাও একদিন থাকবেন না। ইয়ং কমরেডরা যদি না দাঁড়ান, নিজেদের তৈরি না করেন, আদর্শগত ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারার চর্চা ও তা আয়ত্ত করার সংগ্রাম না করেন তা হলে সমূহ বিপদ।

আমি শেষ মিটিংয়ে বলেছি, বিপ্লবীরা উদ্দেশ্যহীনভাবে কোনও কাজ করে না। খাওয়া, শোয়া, গান, বৈঠক, গল্প, দলের কাজ, সিনেমা দেখা, নাটক দেখা সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা উদ্দেশ্য থাকবে। লক্ষ্যহীন কোনও কাজ, বিপ্লবের স্বার্থের প্রয়োজনীয় কোনও কাজ ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা, কোনও কাজ করবে না। মোবাইল দেখাটাও যদি বিপ্লবের কাজের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয় তবেই দেখবে। পড়াশোনার চর্চা গোটা দেশে মরে গেছে, জ্ঞানের স্পৃহা মরে গেছে। এই চর্চার মনকে পুঁজিবাদ ধ্বংস করেছে, এই পার্টিগুলি ধ্বংস করেছে ব্লাইন্ডনেস ডেভেলপ করার জন্য (অন্ধতা বাড়িয়ে তোলার জন্য)। এর বিরুদ্ধে আমাদের কমরেডদের স্ট্রাগল করতে হবে। আমাদের যে নতুন ছেলেমেয়েরা, কর্মীরা আসছে তাদের সততা, নিষ্ঠা আছে। কিন্তু আবার তাদের উপর পরিবেশের প্রভাব আছে। ফলে প্রতিদিন পড়াশোনা করা, জানা, বোঝা দরকার। শুধু পড়া মুখস্থ করা নয়, আত্মস্থ করা, নিজের জীবনে তাকে প্রয়োগ করা, জীবনকে পাল্টে ফেলার সংগ্রাম করা– এসব অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমরা বেশিরভাগই পেটিবুর্জোয়া পরিবার থেকে এসেছি। পেটিবুর্জোয়া চরিত্র নিয়ে বিপ্লবের ঝান্ডা বহন করা চলে না। ফলে আমাদের জীবন যাপনে, আচরণে কোথায় কেমন করে বুর্জোয়া চরিত্র, পেটিবুর্জোয়া চরিত্র কাজ করছে সবসময় দেখা দরকার। কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার আলোকে সবসময় নিজেকে বিচার করা দরকার। ক্রমাগত নিজেকে পাল্টানো, ক্রমাগত নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই স্ট্রাগল আমাদের করা দরকার।

আমাদের দেশে তো এই অবস্থা। বিশ্ব কমিউনিস্ট মুভমেন্টেও চূড়ান্ত সংকট চলছে। আমাদের কাছে সব খবর নেই, কোথাও কেউ হয়ত আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে। সোভিয়েতের পতন, চিনের পতনের পর অন্যান্য পার্টিগুলো ভেঙে তছনছ হয়ে গেল, কিন্তু আমরা ভাঙিনি। আমরা দুঃখ পেয়েছি, কিন্তু আমাদের হতাশা আসেনি। কারণ কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত করে গেছেন। ফলে ভারতবর্ষে বিপ্লব করাই শুধু আমাদের একমাত্র দায়িত্ব নয়, আন্তর্জাতিক বিপ্লবও আমাদের দায়িত্ব। আমরা যারা এখানে আছি, হয়ত কেউ থাকব না, কিন্তু যারা এখানে ইয়ঙ্গার জেনারেশন (তরুণ প্রজন্ম) ‘কমসোমল’ যারা আছে, ছাত্রসংগঠন ও যুবসংগঠনের যারা আছে, আরও বেশি করে আগামী দিনে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই পার্টিকেও পুঁজিবাদ আক্রমণ করছে। পুঁজিবাদ শুধু গোলাগুলি লাঠি দিয়ে আক্রমণ করে না। পুঁজিবাদী ভাবধারা, সংস্কৃতি, আর্থিক লোভ, সম্পত্তির লোভ, টাকা-পয়সার লোভ, আরামপ্রিয়তা, আরামে থাকার মানসিকতা, সন্তানের প্রতি দুর্বলতা, স্ত্রীর প্রতি দুর্বলতা, স্বামীর প্রতি দুর্বলতা– এ রকম নানা ভাবে অতি সূক্ষ্ম আক্রমণ করে। কমরেড শিবদাস ঘোষ এ সম্পর্কে বারবার সতর্ক করে গেছেন।

কমরেড মানিক মুখার্জী তাঁর উপর অর্পিত সমস্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন, সংগ্রাম করে গেছেন। আজ কমরেড মানিক মুখার্জীকে স্মরণ করতে গিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে গিয়ে এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে যাতে আমরা কমরেড শিবদাস ঘোষের যথার্থ ছাত্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারি, নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারি এবং তাঁর আচরণ দ্বারা যেসব শিক্ষাগুলি আমাদের সামনে তিনি রেখেছেন সেগুলিও যেন আমাদের জীবনে আমরা রক্ষা করতে পারি। এটা হবে তাঁর প্রতি আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।

এখানে আর একটি কথা আমি আপনাদের বলতে চাই। কাছে থাকা এবং চেনা আলাদা। মার্ক্স-এঙ্গেলস কাছাকাছি ছিলেন। দুজনেই দুজনকে চিনেছিলেন জ্ঞানের চোখে। যদিও এঙ্গেলসের এ নিয়ে বক্তব্য আছে। এঙ্গেলসকে বলা হয়েছিল, ‘আপনি তো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নিয়ে অনেক বই লিখেছেন, তা হলে আপনি মার্ক্সবাদ বলছেন কেন’? এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘মার্ক্স অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেতেন। আমরা অত দূর পর্যন্ত দেখতে পেতাম না। আমি যা লিখেছি দু-একটা সায়েন্সের বই বাদ দিলে মার্ক্স সবই লিখতে পারতেন, কিন্তু মার্ক্স যা লিখেছেন, আমি পারতাম না।’

এঙ্গেলস বলেছেন, ‘‘হি ওয়াজ জিনিয়াস, উই আর অ্যাট বেস্ট ট্যালেন্টেড’’। এঙ্গেলস কয়েকবার এ কথা বলে গেছেন। এই ভাবেই এঙ্গেলস মার্ক্সকে ঠিক চিনেছেন। আবার মার্ক্স-এঙ্গেলসকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নেতারা ঠিক চিনতে পারেননি। চিনেছেন লেনিন। লেনিনের সাথে মার্ক্স-এঙ্গেলসের দেখা হয়নি। আবার লেনিনের আশপাশে যাঁরা ছিলেন– কামেনেভ, জিনোভিয়েভ, ট্রটস্কি– তাঁরা লেনিনকে চিনতে পারেননি, চিনতে পেরেছিলেন স্ট্যালিন। স্ট্যালিন থাকতেন সাইবেরিয়ায়, নির্বাসনে। স্ট্যালিনের সাথে লেনিনের প্রত্যক্ষ পরিচয় হয় বিপ্লবের সময়। তার আগে প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। কিন্তু স্ট্যালিন সঠিক ভাবে চিনতে পেরেছিলেন লেনিনকে। আবার কমরেড শিবদাস ঘোষ চিনেছেন মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সে তুং-কে। কাছে থাকা বা দূরে থাকা– এটা বিষয় নয়। কাছে থাকলেই সবটা চেনা যাবে ব্যাপারটা এ রকম নয়। চেনার জন্য চাই জ্ঞানের চোখ। এক্সটারনাল কন্ট্রাডিকশন, ইন্টারনাল কন্ট্রাডিকশন দুটোই চেঞ্জের একটা ফ্যাক্টর। এক্সটারনাল কন্ট্রাডিকশন কন্ডিশন ফর চেঞ্জ, ইন্টারনাল কন্ট্রাডিকশন বেসিস ফর চেঞ্জ। কিন্তু বস্তুজগতে যেমন করে ঘটে, প্রকৃতিজগতে যেমন করে ঘটে, মানুষের ক্ষেত্রে কিন্তু তা ঘটে না। মানুষের ক্ষেত্রে মানুষের মন কাজ করে। এক্সটারনাল থেকে আমি কী নেব আর নেব না, সেটা মন ডিসাইড করে। কতটা নেব, কতদূর নেব এটা কাছে থাকা, দূরে থাকার উপর নির্ভরশীল নয়। একটা মানুষ তার এক্সটারনাল পরিবেশ পরিবর্তন করতে পারে। এখানে আমার স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে, অন্য জায়গায় স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য চলে যাচ্ছি। এক্সটারনাল পরিবেশ আমি পাল্টে দিলাম স্বাস্থ্যের জন্য। তাই কত দিন পার্টিতে আছি, কত দিন কাছে ছিলাম, কার কাছে ছিলাম– এর উপরে পারা, না-পারা নির্ভর করে না। কী ভাবে নিচ্ছি, আমার মন কী ভাবে নিচ্ছে, নেওয়ার জন্য কী সংগ্রাম করছি, কী পদ্ধতিতে সংগ্রাম করছি, এর উপর নির্ভর করে। এর দ্বারা এ কথা আমি বলছি না যে, কমরেড মানিক মুখার্জী কিছু নিতে পারেননি। কিছু যদি নাই নিতে পারতেন, তা হলে এ ভূমিকা পালন করতে পারলেন কী করে? আবার এই আক্ষেপটা থাকাও স্বাভাবিক। কমরেড শিবদাস ঘোষের যে বিশালতা, গভীরতা, ব্যাপকতা, তার কাছে পৌঁছনো অনেক কঠিন ছিল। এই সংগ্রামে তিনিও লিপ্ত ছিলেন, আমরাও লিপ্ত আছি, আপনারাও লিপ্ত আছেন। এরই উপর নির্ভর করছে কে কতটা এগোতে পারব। ফলে তাঁর এই বক্তব্য অত্যন্ত শিক্ষণীয়।

কমরেড মানিক মুখার্জীর এই বিশাল কর্মকাণ্ড আপনারা শুনলেন, অথচ তাঁর দিক থেকে তিনি কী আক্ষেপটাই রেখে গেছেন! এই আক্ষেপটাই আবার এগিয়ে চলার সোপান। শিবদাস ঘোষকে জানতে হবে, বুঝতে হবে, আরও জানতে হবে, আরও বুঝতে হবে। স্ট্যালিনকে জানতে হবে, মাও সে তুংকে জানতে হবে, লেনিনকে জানতে হবে, মার্ক্স-এঙ্গেলসকে জানতে হবে। এই জানা, বোঝা এটাই তো আমাদের অগ্রগতির সংগ্রাম। সেই শিক্ষাটাও কমরেড মানিক মুখার্জী এখানে রেখে গেছেন। এখানেই শেষ করলাম।