সাম্যবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ কার্ল মার্কস

কেন্দ্রীয় অফিস

১৪ মার্চ মহান কার্ল মার্কসের প্রয়াণ দিবস৷ গভীর শ্রদ্ধায় এই দিনটিকে দুনিয়ার সমস্ত নিপীড়িত শোষিত মানুষের সাথে আমরাও পালন করছি৷

১৮৮৩ সালের ১৪ই মার্চ এই মহান চিন্তানায়ক প্রয়াত হন৷ তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী দার্শনিক– যিনিই প্রথম দর্শন ও ইতিহাসকে বিজ্ঞান–নির্ভর করে গড়ে তুলেছিলেন৷ তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস যে দর্শনের জন্ম দিয়েছিলেন তা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নামে খ্যাত৷ সমাজজীবন ও ইতিহাসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী ব্যাখ্যাই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ৷ মার্কসই প্রথম দেখান, চিন্তা সমাজ বাস্তবতাকে নির্ধারণ করে না, বরং বিপরীতে সমাজ বাস্তবতাই চিন্তার নির্ধারক৷ চিন্তার উৎস সম্পর্কে মার্কসের এই ব্যাখ্যা ভাববাদী দর্শনের মূলে এক চরম কুঠারাঘাত– এতে কোনও সন্দেহ নেই৷

মুনাফার উৎস কী– এই প্রশ্নে অতীতের সমস্ত অর্থনীতিবিদেরা যখন অন্ধকারে পথ হাতড়েছেন তখন মার্কস দেখালেন শ্রমিকের শ্রমশক্তি শোষণ করেই মালিকের মুনাফার পাহাড় সৃষ্টি হয়৷ মার্কসের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার, উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেয়, শোষিত মানুষের পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রামের পথকে আলোকিত করে৷

আশুতোষ কলেজ হল, কলকাতা

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী বিজ্ঞানের মানদণ্ডে মার্কস দেখালেন জগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল, সব কিছুরই জন্ম, বিকাশ ও মৃত্যু আছে৷ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাও চিরস্থায়ী নয়৷ পুঁজিবাদ তার সাথেই নিয়ে এসেছে আধুনিক শিল্প এবং শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক শ্রেণিকে৷ এই সর্বহারা শ্রেণি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির আধারে নিজেকে শিক্ষিত করবে, সর্বহারা সংস্কৃতির জন্ম দেবে, শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলবে এবং বুর্জোয়া শ্রেণিকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠা করবে সমাজতন্ত্র ও সর্বহারা একনায়কত্ব, যা সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অন্তর্বর্তী স্তর৷ এইভাবে মহান মার্কস সমাজতন্ত্রের ধারণাকে কল্পনাবিলাসের হাত থেকে মুক্ত করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিলেন, এর মধ্যে দিয়েই ঘটল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আবিষ্কার৷ মার্কস দেখালেন, সাম্যবাদী ব্যবস্থা কারও শুভ ইচ্ছার ফল নয়, তা সমাজবিকাশের ঐতিহাসিক নিয়মেরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি৷ এর অন্যথা হওয়ার কোনও উপায় নেই৷

পুদুচেরি

এঙ্গেলসের ভাষায়, মার্কস বিজ্ঞানকে দেখেছেন এক ঐতিহাসিক, গতিশীল বিপ্লবী শক্তি হিসেবে৷ বিজ্ঞানের যে কোনও তত্ত্বগত আবিষ্কারকে তিনি গভীর আনন্দে স্বাগত জানাতেন৷ কিন্তু তাঁর আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যেত যদি সেই আবিষ্কার শিল্পে ও ইতিহাসের ধারায় কোনও আশু বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসত৷ মার্কস ছিলেন সর্বোপরি একজন সমাজবিপ্লবী৷ তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল পুঁজিবাদী সমাজকে উৎখাত করা৷ বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষকে তিনিই প্রথম পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করেন এবং নিজেই শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন৷ তিনিই প্রথম আওয়াজ তুললেন, ‘‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’’৷ দেখালেন বিশ্বের সমস্ত নিপীড়িত শোষিত মানুষের স্বার্থ এক৷ ‘কমিউনিস্ট লিগে’র মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে মার্কস–এঙ্গেলস রচনা করলেন কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার৷ বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি পেল তাদের মুক্তি সংগ্রামের দিশা৷ মহান মার্কসের বিজ্ঞানভিত্তিক এই পথনির্দেশ ও দ্বান্দ্বিক বিচারধারাকে প্রয়োগ করেই তাঁর সুযোগ্য উত্তরসাধক মহান লেনিন রাশিয়ায় ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন৷ ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই আমরা সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান পথিকৃৎ কার্ল মার্কসকে স্মরণ করছি এবং তাঁর  শিক্ষাগুলি ও বিচারধারাকে অনুশীলন করার অঙ্গীকার করছি৷

আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আপসহীন বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বসু গভীর শ্রদ্ধায় বলেছিলেন, ‘‘ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানি মার্কসবাদী দর্শনের মধ্য দিয়ে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে৷ আর বিংশ শতাব্দীতে রাশিয়া সর্বহারা বিপ্লব, সর্বহারা রাষ্ট্র ও সর্বহারা সংস্কৃতি অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে৷’’ এঙ্গেলস বলেছিলেন, সংগ্রামই ছিল মার্কসের যথার্থ পরিচয়৷ যে গভীর আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও সাফল্যের সাথে তিনি সংগ্রাম করেছেন তার তুলনা মেলা ভার৷ কোনও বাধাকেই তিনি বাধা বলে মনে করেননি, কোনও সমস্যাই তাঁর এগিয়ে যাবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি৷ অনাহার, প্রিয়তম সন্তানের অসহায় মৃত্যু, পাওনাদারদের নির্মম আক্রমণ– এসব তাঁকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি৷ শত্রুপক্ষের চরম অবজ্ঞা ও কুৎসার জাল ছিন্ন করে তিনি সবলে এগিয়ে গিয়েছেন, মেহনতি মানুষের মুক্তি আন্দোলনের দিশা দেখিয়েছেন৷ তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু মহান এঙ্গেলস নিজেকে বড়জোর মেধাবী বলে আখ্যায়িত করে মার্কসকে বলেছেন, ‘জিনিয়াস’ অর্থাৎ ‘প্রতিভাধর’৷ মার্কস মেহনতি মানুষের অন্তরে বেঁচে আছেন, চিরদিন বেঁচে থাকবেন৷ বিশ্বপুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা যে গভীর সংকটে নিমজ্জিত, তার কারণ মার্কসবাদ দেখিয়েছে শুধু নয়, এই শোষণমূলক ব্যবস্থা থেকে মুক্তির পথনির্দেশও দিয়েছে৷ তাই মার্কস–এই নাম আজও দুনিয়ার শোষকদের বুকে কাঁপন ধরায়৷ অন্য দিকে শোষিত নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ে মার্কস– এই নাম অনন্য প্রেরণার উৎস হিসেবে বিরাজ করবে৷ আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে এই মহান যুগস্রষ্টার স্মৃতির প্রতি আমরা বিপ্লবী শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি৷

(মহান মার্কসের স্মরণ দিবসে দলের উদ্যোগে রাজ্য জুড়ে গ্রামে–গঞ্জে, রাস্তার মোড়ে, স্টেশনে, বাজারে সর্বত্র মার্কসের ছবিতে মাল্যদান করা হয় ও এই শ্রদ্ধার্ঘ্যটি পাঠ করা হয়৷)