শুধু স্কুল-কলেজই বন্ধ!(পাঠকের মতামত)

 

দীর্ঘ প্রায় দু’বছর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে।

পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ কিছু রাজ্য ইতিমধ্যে বিধি-নিষেধ জারি করেছে। পশ্চিমবঙ্গে আপাতত সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। করোনা ভাইরাসের কারণে দীর্ঘ লকডাউনের পর যখন নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি স্কুল ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলে তখন দেখা গেল বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাই সত্যি হল। ড্রপ আউটের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে, পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়েছে বহু ছাত্রছাত্রী, বাইরে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে যুক্ত হয়েছে অনেক অভাবী ঘরের ছাত্ররা, আবার অনেক অভিভাবক কন্যা সন্তানকে বিয়ে দিয়েছেন অভাবের তাড়নায়। ফলে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে অনেক ছাত্রছাত্রী। ২০১৯-২০ সালে মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুটের সংখ্যা বেশি। সম্প্রতি ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিকট ইনফর্মেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন প্লাসের রিপোর্টে উঠে এসেছে গত শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুটের সংখ্যা প্রায় ১৭ শতাংশেরও বেশি। রিপোর্টে আরও একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে, দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ ছাত্র মাধ্যমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়তে যায় না।

তাই লকডাউনের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর স্কুলগুলো খুললেও ছাত্রছাত্রীর অভাবে বহু স্কুল ধুঁকছে। পর্যাপ্ত শিক্ষার্থীর অভাবে বহু স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শিক্ষা একটা জাতির মেরুদণ্ড। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই শিক্ষাকে ব্যবসায়ী কর্পোরেট হাউসের হাতে তুলে দিতে চাইছে। তাই করোনা আবহে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার যথার্থ ব্যবস্থা না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিই বন্ধ করে দিয়েছে। করোনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, অথচ মিটিং-মিছিল নির্বাচন, সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহণ, শিল্প-কারখানা সমস্ত কিছুই খোলা। রেস্তোঁরা, শপিংমল, বাজার, হাট সব খোলা। এমনকি খোলা রয়েছে পানশালাও। ৫০ শতাংশ দর্শক নিয়ে সিনেমা হল, থিয়েটার হল খোলা। গঙ্গাসাগর মেলা হচ্ছে, ভোট হচ্ছে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, গোয়া, মণিপুর, পাঞ্জাবে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। পশ্চিমবঙ্গেও পৌরভোট ঘোষিত হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি নির্বাচন হতে পারে, মেলা হতে পারে তা হলে পরিকল্পনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যেতে পারে না কি?

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে সরকারের গোড়া থেকেই কোনও সদর্থক ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০ কার্যকর করার এক গভীর চক্রান্ত নিহিত রয়েছে। দীর্ঘ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে অনলাইন শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণের পথে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। শিক্ষাকে মুনাফা লাভের বহুমূল্য পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে ‘গ্যাটস চুক্তির’ মধ্য দিয়েই শিক্ষাকে শুধু বাণিজ্যিক পণ্যেতে পরিণত করে দেশি-বিদেশি মালিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল।

করোনার প্রভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। শিশুদের শিক্ষার কাল বিলম্বিত হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের কোনও নির্দিষ্ট চিন্তা-ভাবনা বা পরিকল্পনা নেই। হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টে যে সমস্ত রায় হচ্ছে দেখে মনে হচ্ছে সব জেনে বুঝে এরা চোখ বুজে আছেন। শর্তসাপেক্ষে মেলা করার অনুমতি দিচ্ছে হাইকোর্ট কিন্তু স্কুল খোলা হচ্ছে না। ছাত্রছাত্রীরা মিড ডে মিলের চাল নিতে এলে করোনা ছড়াচ্ছে না, ভর্তি হতে গেলে করোনা ছড়াচ্ছে না, কিন্তু স্কুলে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা নিতে গেলে করোনা হবে। এই ধারণার পেছনে কোনও বৈজ্ঞানিক যুক্তি রয়েছে কি?

শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা যেত। রোটেশন ভিত্তিতে শিক্ষকদের দিয়ে স্কুল পরিচালনা করানো যেত। করোনা অতিমারিতে যখন জনগণের জীবনকে সঙ্কটের মধ্যে ফেলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্যই ভোট হচ্ছে, তখন অতিমারি বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, সব শিক্ষক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন ও চিকিৎসকদের পরামর্শের ভিত্তিতে এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা যায় তা ঠিক করা যেত।

দ্রুততার সাথে সব ছাত্রকে যদি ভ্যাকসিন দেওয়া হত, তাদের স্বাস্থে্যর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হত, তা হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ লকডাউন করার প্রয়োজন হত না। সিলেবাস বিজ্ঞানসম্মতভাবে কমিয়ে বিভিন্ন দিনে পর্যায়ক্রমে সংক্ষিপ্ত সময়ে নির্দিষ্ট কিছু ছাত্রছাত্রী নিয়ে ক্লাস করানো যেত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারিভাবে স্যানিটাইজ করা এবং ছাত্রছাত্রীদের জন্য মাস্ক, স্যানিটাইজার ও গ্লাভসের ব্যবস্থা করা যেত। সরকার এ বিষয়ে নীরব।

বিচারবিভাগ যেন আজ অন্ধ ধৃতরাষ্টে্রর ভূমিকায় অবতীর্ণ। হীরক রাজার মতো বর্তমান কেন্দ্র রাজ্য সরকার জনগণের শিক্ষার অধিকার হরণ করছে। ছাত্রদের জ্ঞানপিপাসু মনকে মেরে দিতে চাইছে। জনগণের অজ্ঞতাই এদের ক্ষমতার উৎস।

‘এরা যত বেশি পড়ে

তত বেশি জানে

তত কম মানে’

এই আশঙ্কা থেকেই শাসকশ্রেণির মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার অধিকার হরণ করা। এতদিন ধরে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ড্রপ আউটের সংখ্যা বহু গুণ বেড়েছে। পুনরায় পড়াশোনায় মন বসার মতো পরিস্থিতি বহু ছাত্র-ছাত্রী থাকছে না। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তাই এই পরিস্থিতিতে তাদের স্কুলমুখী করা অত্যন্ত জরুরি।

শ্যামল দত্ত

রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ২৩ সংখ্যা ২১ জানুয়ারি ২০২২