Breaking News

‘আমরা গণহত্যাকারীদের দোসর হব না’ বলছেন ইউরোপের পরিবহণ শ্রমিকরা

গাজায় ইজরায়েলের লাগাতার নির্মম গণহত্যার বিরুদ্ধে যখন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই নিশ্চুপ, তখন প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছেন ইউরোপের পরিবহণ শ্রমিকরা। অতি সম্প্রতি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিমানবন্দর-কর্মীরা ইজরায়েলে সামরিক পণ্যবাহী বিমান পাঠাতে অস্বীকার করেছেন। দুটি শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে প্রতিবাদরত শ্রমিক-কর্মচারীরা বলেছেন, ‘ইজরায়েলে সামরিক পণ্য পরিবহণ করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে গাজার ওপর চলা অন্যায়ের মাত্রা বাড়াতে আমরা স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করছি।’ শুধু বিমানবন্দর-কর্মীরাই নন, রেল সহ অন্যান্য পরিবহণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত গোটা ফ্রান্সের পরিবহণ-কর্মীরাও আক্রান্ত প্যালেস্টিনীয়দের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধবাজ ইজরায়েলে সামরিক পণ্য পরিবহণ করতে তাঁরা রাজি নন। একটি যুক্ত বিবৃতিতে পরিবহণ ক্ষেত্রের শ্রমিকরা বলেছেন, ‘গোটা একটি জাতির উপরে এই জঘন্য আক্রমণ দেখে আমরা নীরব থাকতে পারি না’।

এই প্রথমবার নয়, গত জুনেও প্যারিস বিমানবন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা ইজরায়েলে সামরিক পণ্য পরিবহণ না করার ডাক দিয়েছিলেন। ফ্রান্সের জলবন্দরের শ্রমিকরাও একই ভাবে ইজরায়েলের গণহত্যার প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট হামলাবাজ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ফুঁসে ওঠা ক্ষোভের চাপে ট্রেড ইউনিয়নগুলির নেতারা প্রকাশ্যে ফ্রান্স সরকারকে ইজরায়েলের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করার অনুরোধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সাম্রাজ্যবাদী লুটের বখরার স্বার্থে ফ্রান্সের ম্যাক্রঁ সরকার সেই অনুরোধে কান দেয়নি। সেখানকার পরিবহণ ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারীরা গণহত্যাকারী ইজরায়েলের প্রতি ফ্রান্স সরকারের মৌন প্রশ্রয়ের তোয়াক্কা না করে ব্যাপক ভাবে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। একটি শ্রমিক সংগঠন বলেছে, ‘গোটা বিশ্বের মানুষ যাকে চরম অন্যায় বা অমানবিক বলে মনে করে, উপরমহলের কোনও চাপ বা কোনও চুক্তির অজুহাতে সেই অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত থাকা যায় না’। দেশের প্রতিটি শ্রমিককে আহ্বান জানিয়ে ওই সংগঠন বলেছে– ‘বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে এই জঘন্য গণহত্যা থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। ইজরায়েলে সামরিক পণ্য পরিবহণের কাজ বয়কট করুন’।

গ্রিসে এথেন্স বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরাও জাহাজ থেকে ইজরায়েলের জন্য পাঠানো মাল খালাস করতে রাজি নন। ইজরায়েলের জন্য সামরিক সরঞ্জামে বোঝাই একটি জাহাজের যেদিন এথেন্স বন্দরে আসার কথা, সে দিন ছাত্রছাত্রী, শ্রমিক সহ সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে বিক্ষোভের পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। উদ্দেশ্য, ওই জাহাজ থেকে মালপত্র খালাসে বাধা দেওয়া, যাতে ওখান থেকে ইজরায়েলে সামরিক সরঞ্জাম পৌঁছাতে না পারে। গাজায় হাসপাতাল, স্কুল সহ নারী-শিশুদের উপর বোমাবর্ষণ করছে যে ইজরায়েল, সেখানে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর কথা ভাবতেই পারছেন না গ্রিসের শ্রমিকরা। তাঁদের সংগঠন মন্তব্য করেছে, ‘আমরা নিরীহ মানুষের রক্তে হাত রাঙাতে, গণহত্যাকারীদের দোসর সাজতে রাজি নই’। দেশের সরকার যা-ই করুক, সুইডেন, ইটালি, ব্রিটেন সহ ইউরোপের দেশে দেশে শ্রমিক-কর্মচারী ও জনসাধারণ গণহত্যাকারী ইজরায়েলে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহণে তীব্র আপত্তি জানাচ্ছেন। ব্রিটেনে বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারীরা ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে ইজরায়েলে অস্ত্র সরবরাহে বাধা দিচ্ছেন। ইতিমধ্যেই সেখানকার সরকার ওই সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সুইডেনের বন্দর-শ্রমিকরাও ইজরায়েলের সঙ্গে পণ্য আদানপ্রদান বন্ধ করার পক্ষে রায় দিয়েছেন। ইটালিতে জেনোয়ার বন্দরশ্রমিকরা সম্প্রতি সংগঠিত হয়ে ব্রেসসিয়া বিমানবন্দরে ইজরায়েলে সামরিক মালবাহী বিমান উড়ানে বাধা দিয়েছেন।

এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে গোটা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া যখন এককাট্টা হয়ে অস্ত্র শানাচ্ছিল, নানা কৌশলের জাল বুনে শিশু সমাজতন্ত্রকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছিল, ইউরোপের শ্রমিকরা আরও একবার রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে। মানুষের উপর মানুষের শোষণ বন্ধ করার মহান লক্ষ্য নিয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের দুর্বার অগ্রগতি অপ্রতিহত রাখতে তাঁরা নিজের নিজের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে অবাধে গাজায় নির্মম গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট ইজরায়েল। দোসর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সরকার শুধু নিশ্চুপ তাই নয়, নিজের নিজের দেশের পুঁজিমালিকদের বিপুল মুনাফা লুটের সুযোগ করে দিতে তারা ইজরায়েলের এই বর্বর হানাদারিতে সব রকমের সহযোগিতা করছে। এই অবস্থায় ইউরোপের দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের পেটোয়া সরকারগুলির বিরুদ্ধে পরিবহণ শ্রমিকদের এই প্রতিবাদী অবস্থানকে বিপুল অভিনন্দন। ‘আমরা নিপীড়িত মানুষের পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নয়’– প্রতিবাদী পরিবহণ শ্রমিকদের এই ঘোষণা আশা জাগায়, একদিন যুদ্ধবাজদের হাতের মুঠো থেকে শোষণ-নিষ্পেষণে জর্জরিত বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মুক্তি ছিনিয়ে আনবে এই শ্রমিক শ্রেণিই।