রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচয় দিয়ে গেলেন অমিত শাহ

ফাইল চিত্র

গত ৯ মে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কলকাতার সায়েন্স সিটিতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর নাম করে বলে গেলেন, ‘গুরুদেবের ভাবনা থেকে প্রেরণা নিয়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি এসেছে। … গুরুদেবের ভাবনা থেকেই এই শিক্ষানীতি আনা হয়েছে–এটা আজকের শিক্ষাবিদদের বুঝতে হবে। গুরুদেব বলতেন, বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগান করা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়।’

যাদের সামনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই কথাগুলি বললেন তারা ভুল করেও প্রশ্ন করেননি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোন লেখায় এ কথা বলেছেন। করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছা খুলে যেত। যাদের সামনে এ কথা বলেছেন তারা কারা? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে ঢোকার সময় হল-ভরানো সেই শ্রোতাদের কণ্ঠে ‘জয় রবীন্দ্রনাথ’ ধ্বনি শোনা যায়নি। বরং শোনা গিয়েছে, ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। এতেই বোঝা যায় শ্রোতারা রবীন্দ্র-অনুরাগী নন, একান্তই অমিত শাহ তথা বিজেপি-অনুরাগী!

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা সম্পর্কে অমিত শাহ সেদিন যা বলেছেন, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার আদৌ কোনও মিল নেই, বরং জাতীয় শিক্ষানীতির ছত্রে ছত্রে রয়েছে রবীন্দ্র ভাবনা-বিরোধী নানা পদক্ষেপ।

অতীতেই সকল ঐশ্বর্য– রবীন্দ্রনাথ এই বস্তাপচা ভাবনার বিরোধী

জাতীয় শিক্ষানীতির ভূমিকাতেই বলা হয়েছে, ‘‘প্রাচীন ও সনাতন ভারতীয় জ্ঞান ও বিচারে সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের আলোকে এই নীতি তৈরি করা হয়েছে।” অর্থাৎ স্পষ্ট বলে দেওয়া হল– আধুনিক জ্ঞান ও বিচারের আলোকে এই শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়নি। তা হলে এই শিক্ষানীতিকে প্রগতিশীল বলা যাবে কীভাবে?

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষাবিধি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমাদের সমাজ আমাদের কালের উপযোগী শিক্ষা আমাদিগকে দিতেছে না, আমাদিগকে দুই-চারি হাজার বৎসর পূর্বকালের শিক্ষা দিতেছে। অতএব মানুষ করিয়া তুলিবার পক্ষে সকলের চেয়ে বড় যে বিদ্যালয়, সেটা আমাদের বন্ধ।’ অন্য একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যে জাতি মনে করে বসে আছে যে অতীতের ভাণ্ডারের মধ্যেই তার সকল ঐশ্বর্য, সেই ঐশ্বর্যকে অর্জন করার জন্য তার স্বকীয় উদ্ভাবনার কোনও অপেক্ষা নেই, তা পূর্বযুগের ঋষিদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়ে চিরকালের মতো সংস্কৃত ভাষায় পুঁথির শ্লোকে সঞ্চিত হয়ে আছে, সে জাতির বুদ্ধির অবনতি হয়েছে, শক্তির অধঃপতন হয়েছে। … …যে জাতি অতীতের মধ্যেই তার গৌরব স্থির করেছে, ইতিহাসে তার বিজয়যাত্রা স্তব্ধ হয়ে গেছে, সে জাতি শিল্পে সাহিত্যে বিজ্ঞানে কর্মে শক্তিহীন ও নিষ্ফল হয়ে গেছে।’

ভারতীয় নৈতিকতাকে যুগের প্রেক্ষিতে বুঝতে হবে

বিজেপির জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি এরকম একটি ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে যার ভিত্তি সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত থাকবে ভারতীয় নৈতিকতার উপর।’ এই নৈতিকতা কথাটি সঠিকভাবে বোঝা উচিত। কারণ, কোনও যুগ বা কালের উল্লেখ না করে ‘ভারতীয় নৈতিকতা’ বলার কোনও অর্থই হয় না। অথচ ‘ভারতীয় নৈতিকতা’ বলে অমিত শাহর দল বাস্তবে প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী নৈতিকতাকেই ভারতীয় নৈতিকতা বলে চালাতে চাইছে। যেহেতু সাধারণ মানুষ দেশকে ভালোবাসেন, তাই দেশের নাম যুক্ত করে ভারতীয় নৈতিকতা বললে অনেকেই মনে করবেন, এতে আপত্তি কীসের? কিন্তু একটু খুঁটিয়ে বিচার করলেই ধরা পড়বে যে আধুনিক যুগে পিতৃ-প্রতিজ্ঞা রক্ষায় পুত্রের ১৪ বছর বনবাস, স্বামীর আদেশে স্ত্রীর অগ্নিপরীক্ষা, পাশা খেলায় স্ত্রীকে বাজি ধরা, ‘নিম্নবর্ণে’র মানুষকে বেদ পড়তে না দেওয়া, জাতি-বর্ণ ভিত্তিক পেশা প্রভৃতি যে নৈতিকতার কথা ভারতীয় সাহিত্যে ও শাস্ত্রে রয়েছে সেগুলিই বিজেপি বর্ণিত ‘ভারতীয় নৈতিকতা’। অথচ আমাদের দেশে নবজাগরণের কালে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে, রবীন্দ্রনাথ, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র, শরৎচন্দ্র, নজরুল, মেঘনাদ সাহা প্রভৃতি মনীষীরা যে উন্নত ও গণতান্ত্রিক নৈতিকতার কথা বলে গিয়েছেন সেইটি তো আজকের দিনের ভারতীয় নৈতিকতা! এই নৈতিকতা বিজেপির পছন্দ নয়। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ … একদিন আমাদের ইতিহাসের একটা বিশেষ অবস্থায় আমাদের সমাজ মানুষের কাহাকেও ব্রাহ্মণ, কাহাকেও ক্ষত্রিয়, কাহাকেও বৈশ্য বা শূদ্র হইতে বলিয়াছিল। … এখনও সে বলিতেছে, ‘ব্রাহ্মণ হও, শূদ্র হও।’ প্রাচীনপন্থাকে তীব্র কষাঘাত করে ‘বিদ্যাসাগর’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, ‘তিনি দেশাচারের দুর্গে আঘাত করেছিলেন।’ বলেছেন, ‘তিনি যা কিছু পাশ্চাত্য তাকে অশুচি বলে অপমান করেননি। তিনি জানতেন, বিদ্যার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমের দিকবিরোধ নেই।’ অথচ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অমিত শাহরা পশ্চিমের জ্ঞানকে হয় উপেক্ষা করছেন, নতুবা সেই জ্ঞান বেদে ছিল বলে দাবি করে মিথ্যা গর্ব করছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সমস্ত রসদ পরিপূর্ণ উপভোগ করে আজ নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা পাশ্চাত্যবিদ্যার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন। জাতীয় শিক্ষানীতিতে তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবিতকালে একদল লোকের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখে লিখেছিলেন, ‘একদিকে মোটর-রেল-টেলিগ্রাফকে জীবনযাত্রার নিত্যসহচর করেছি, আবার অন্যদিকে বলছি যে বিজ্ঞান আমাদের সর্বনাশ করল, পাশ্চাত্য বিদ্যা আমাদের সইবে না।’

মেকি সায়েন্সের মন্ত্রে অন্ধ কুসংস্কারের আবাহনের বিরোধী রবীন্দ্রনাথ

ভারতের জ্ঞান কী সে সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে ‘ভারতের জ্ঞান-এর অন্তর্গত হল প্রাচীন ভারতের জ্ঞান এবং আধুনিক ভারতে তার অবদান।’ এই প্রাচীন ভারতের জ্ঞানকেই ভারতীয় জ্ঞানব্যবস্থা বা ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম বলা হচ্ছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ভারতের নবজাগরণের যুগের ও আধুনিক ভারতের শিল্প ও সাহিত্য সঙ্গীত কলা বিজ্ঞান দর্শন স্থাপত্য বিষয়ক জ্ঞানগুলিকে জাতীয় শিক্ষানীতিতে ভারতের জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম-এর নামেই মোদিজি অমিত শাহরা গণিত জ্যোতির্বিদ্যা দর্শন অর্থনীতি স্থাপত্যবিদ্যা, ঔষধি কৃষিবিদ্যা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে পৌরাণিক যুগের কাল্পনিক কাহিনি ও নানা বিষয়ে জ্ঞান সম্পর্কে প্রাচীন ধারণাকেই তুলে ধরছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যুগে এমন কয়েক জনকে পেয়েছিলেন, যাদের সাথে মোদি-অমিত শাহদের ভাবনার প্রবল মিল রয়েছে।

তাই নরেন্দ্র মোদিকে বলতে শোনা গিয়েছে, প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারি ছিল। যদি না থাকে তা হলে গণেশের ঘাড়ে হাতির মাথা জুড়লো কেমন করে? প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক খোদ সংসদে বললেন, জ্যোতিষশাস্ত্রের কাছে আধুনিক বিজ্ঞান তো শিশু! তাদেরই আরেক নেতা পূর্বতন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং গর্বে বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন ‘ডারউইনের তত্ত্ব ভুল। কারণ, কেউ কখনও কোনও বানরকে লেজ খসে মানুষ হতে দেখেনি।’ তাকে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার পরেও তিনি গর্ব করে বলেছিলেন, ‘আমি সায়েন্সের ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষ। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়েছি।’ বিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের জ্ঞানের বহর এমন সেই মন্ত্রীরাই কিন্তু তাদের মন্ত্রিসভায় জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছেন। সম্ভবত এদের সম্পর্কেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সায়েন্সে ডিগ্রিধারী পন্ডিত এ দেশে বিস্তর আছে, যাদের মনের মধ্যে সায়েন্সের জমিনটা তলতলে। তাড়াতাড়ি যা–তা বিশ্বাস করতে তাদের অসাধারণ আগ্রহ। মেকি সায়েন্সের মন্ত্র পড়িয়ে অন্ধসংস্কারকে তারা সায়েন্সের জাতে তুলতে কুণ্ঠিত হয় না।’ রবীন্দ্রনাথের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকলে অমিত শাহদের ভণ্ডামির তীব্র নিন্দা না করে কেউ পারবে?

যাদের মাতৃভাষার লিপি নেই তারা শিখবে কোন ভাষায়

অমিত শাহ সেদিন মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষা সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িয়ে নিজের মতো করে বেশ কিছু কথা বলেছেন। আমরা সকলেই জানি রবীন্দ্রনাথ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা চেয়েছিলেন। কিন্তু যাদের মাতৃভাষার লিপি নেই, পুস্তক নেই, তাদের কীভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া হবে? তাদের কি উন্নত জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার জন্য কোনও উন্নত ভাষা শেখার ব্যবস্থা থাকবে না? সেই ভাষাটি কি সমস্ত দিক থেকে বিশ্বের জ্ঞানের আলো প্রবেশের পথ খুলে দেবে –এমন একটি ভাষা হবে না? যদি তা হয় তাহলে নিশ্চিত ভাবে সেই ভাষাটি হওয়া উচিত ইংরেজি ভাষা। সেই জন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও বাংলা ভাষার ধারা যদি গঙ্গা-যমুনার মতো মিলিয়া যায় তবে বাঙালি শিক্ষার্থীর পক্ষে এটা একটা তীর্থস্থান হইবে। দুই স্রোতের সাদা এবং কালো রেখার বিভাগ থাকিবে বটে কিন্তু তারা একসঙ্গে বহিয়া চলিবে। ইহাতেই দেশের শিক্ষা যথার্থ বিস্তীর্ণ হইবে, গভীর হইবে, সত্য হইয়া উঠিবে।’ এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষানীতি ঠিক উল্টো কথাটি বলেছে। জাতীয় শিক্ষানীতির ৪.১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘পরিবারের কথিত ভাষাই হচ্ছে মাতৃভাষা অর্থাৎ সেই ভাষা যে ভাষায় কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সম্প্রদায়ের লোক কথা বলে। … …যেখানে গৃহে ব্যবহৃত ভাষা বা মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক লভ্য নয় সেই সব ক্ষেত্রেও শিক্ষাদানের মাধ্যম হবে মাতৃভাষা।” এসব কথাই অমিত শাহরা আজ রবীন্দ্রনাথের ভাবনা বলে চালিয়ে দিতে চাইছেন।

অনলাইন নয়– রবীন্দ্র শিক্ষাচিন্তা ছাত্রশিক্ষক সম্পর্কের ভিত্তিতে

সকলেই জানেন, মোদিজির জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষাকে অনলাইন নির্ভর করে তোলার প্রবল প্রচেষ্টা রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে কোনও সম্পর্ক থাকবে না। জাতীয় শিক্ষানীতি রূপায়ণের নাম করে ইউজিসি ‘ব্লেন্ডেড মোড’ চালুর যে নির্দেশনামা জারি করেছেন তাতে বলা হয়েছে, অন্ততপক্ষে ৪০ শতাংশ পঠনপাঠন অনলাইনে হবে যা সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। শুধু তাই নয়, সেই নির্দেশনামায় অনলাইন শিক্ষা ‘সিংক্রোনাস’ বা ‘অ্যাসিংক্রোনাস’ করার কথাও বলা হয়েছে, যেখানে ‘অ্যাসিংক্রোনাস’ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের মধ্যে কোনও রকম যোগাযোগ বা সম্পর্ক তৈরি হবে না। অর্থাৎ শিক্ষকের লেকচার ভিডিও করে আপলোড করে দেওয়া হবে এবং শিক্ষার্থী সময় সুযোগ মতো তা শুনে বা দেখে নেবে। এটা মোদিজির ভাবনা। রবীন্দ্রনাথের ভাবনাটা এর ঠিক বিপরীত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তি-স্নেহের সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে তাহলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারাও হতভাগ্য।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘মানুষ মানুষের কাছ হইতেই শিখিতে পারে যেমন জলের দ্বারাই জলাশয় পূর্ণ হয়, শিখার দ্বারাই শিখা জ্বলিয়া ওঠে, প্রাণের দ্বারাই প্রাণ সঞ্চারিত হইয়া থাকে। … গুরু শিষ্যের পরিপূর্ণ আত্মীয়তার সম্বন্ধের ভিতর দিয়াই শিক্ষা কার্য সজীব দেহের শোণিত স্রোতের মতো চলাচল করিতে পারে।’

‘এক দেশ এক শিক্ষা’ এ হেন ছাঁচে ঢালা চিন্তার বিরোধী রবীন্দ্রনাথ

নরেন্দ্র মোদি যে শিক্ষানীতি দেশ জুড়ে রূপায়ণ করবার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছেন তাতে জাতীয় গৌরবের নামে সারা দেশে এক প্রশাসনিক কর্তৃত্ব, এক ভাষা, এক প্রবেশিকা পরীক্ষা, এক শিক্ষা কাঠামো, এক সিলেবাসের কথা বলা হয়েছে, যেখানে ভারতবর্ষের মতো এমন সুবিশাল বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক পরিবেশে শিক্ষায় বৈচিত্রে্যর কোনও স্থান নেই। বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা যা ছিল অমিত শাহরা তার বিপরীতে পথে চলছে। ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে কবিগুরু লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় গণ্ডি-দেবতার যারা পূজারী, তারা শিক্ষার ভেতর দিয়া নানা ছুতোয়় জাতীয় আত্মম্ভরিতার চর্চা করাকে কর্তব্য মনে করে। জার্মানি একদা শিক্ষাব্যবস্থাকে তার রাষ্ট্রনৈতিক ভেদবুদ্ধির ক্রীতদাসী করেছিল বলে পশ্চিমের অন্যান্য নেশন তার নিন্দা করেছে। … স্বাজাত্যের অহমিকা থেকে মুক্তি দান করার শিক্ষাই আজকের দিনে প্রধান শিক্ষা।’ ‘শিক্ষাবিধি’ প্রবন্ধটি পড়লে অমিত শাহ বুঝতেন, চালাকি করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি ধরা পড়ে গিয়েছেন। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘দেশের সমস্ত শিক্ষাবিধিকে সে এক ছাঁচে শক্ত করিয়া জমাইয়া দিবে, ইহাই তাহার একমাত্র চেষ্টা। …দেশের মনঃপ্রকৃতিতে একাধিপত্য বিস্তার করিয়া সে আপনার আইন খাটাইবে, ইহাই তাহার মতলব।’ স্বৈরাচারী শাসকদের মতলব কী হতে পারে তা বুঝে এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জনগণের কর্তব্যও নির্ধারণ করে দিয়ে গিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘যেমন করিয়া হউক, আমাদের দেশে বিদ্যার ক্ষেত্রকে প্রাচীর মুক্ত করিতেই হইবে। …সেই শক্তিকে ও উদ্যমকে সফলতার পথে প্রবাহিত করিয়া স্বাধীনভাবে দেশকে শিক্ষাদানের ভার আমাদের নিজেকে লইতে হইবে। দেশের কাজে যাঁহারা আত্মসমর্পণ করিতে চান এইটেই তাঁহাদের সবচেয়ে প্রধান কাজ।

… ‘জাতীয়’ নামের দ্বারা চিহ্নিত করিয়া আমরা কোনও একটা বিশেষ শিক্ষাবিধিকে উদ্ভাবিত করিয়া তুলিতে পারি না। যে শিক্ষা স্বজাতির নানা লোকের নানা চেষ্টার দ্বারা নানাভাবে চালিত হইতেছে, তাহাকেই ‘জাতীয়’ বলিতে পারি। স্বজাতীয়ের শাসনেই হউক, আর বিজাতীয়ের শাসনেই হউক, যখন কোনও-একটা বিশেষ শিক্ষাবিধি সমস্ত দেশকে একটা কোনও ধ্রুব আদর্শে বাঁধিয়া ফেলিতে চায়, তখন তাহাকে ‘জাতীয়’ বলিতে পারিব না। তাহা সাম্প্রদায়িক, অতএব জাতির পক্ষে তাহা সাংঘাতিক।’

এরপরেও কি বুঝতে অসুবিধা হয় যে, অমিত শাহদের প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ নন, তা হল বিজেপি আর এস এসের সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি আর একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের টাকার থলি, যারা শিক্ষার সর্বনাশ করে শিক্ষার পূর্ণ ব্যবসায়ীকরণ চাইছে।