ফ্রান্সঃ গণবিক্ষোভের শিকড় অনেক গভীরে

পেনশন সংস্কার নিয়ে দেশজোড়া তুমুল আন্দোলনের রেশ মেলাতে না মেলাতেই এক অশ্বেতাঙ্গ কিশোরের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আবার উত্তাল ফ্রান্স। শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি হাজারো দমন-পীড়ন চালিয়েও খেটে-খাওয়া মানুষের বুকে জ্বলতে থাকা ক্ষোভের আগুন যে কোনও মতেই নেভাতে পারছে না, এই বিক্ষোভ তা দেখিয়ে দিয়ে গেল।

প্যারিসের শহরতলি ন্যান্তেরে ২৭ জুন পুলিশ খুব কাছ থেকে গুলি করে খুন করে নাহেল এম নামে আলজেরীয় বংশোদ্ভূত ১৭ বছরের এক কিশোরকে। অজুহাত দেয়, নাহেল তাদের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এক পথচারীর ছড়িয়ে দেওয়া ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেলে পুলিশের মিথ্যাচার ধরা পড়ে যায়। প্রচণ্ড ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ফ্রান্সের মানুষ। গোটা দেশের শহর নগর ভেসে যায় বিক্ষোভের ঢেউয়ে। ক্রোধে উন্মত্ত বিক্ষোভকারীরা নানা সরকারি দফতর, টাউন হল, স্কুল সহ গাড়িতে আগুন লাগায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পথে নামানো হয় ৫০ হাজার পুলিশ। হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে তারা গ্রেফতার করে। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছয় প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁকে বিদেশে বৈঠক বাতিল করে তড়িঘড়ি ফ্রান্সে ফিরে আসতে হয়।

কেন ফ্রান্সে আবার এই সর্বব্যাপক বিক্ষোভ? প্রেসিডেন্ট মাকরঁ বলেছেন, এ প্রশ্নের উত্তর ব্যাখ্যার অতীত। কিন্তু সেটা যে সত্য নয়, নাহেলের মায়ের মন্তব্যে তা স্পষ্ট। সদ্যকিশোর পুত্রের মৃত্যুতে শোকার্ত মা বলেছেন, ‘পুলিশ দেখল একটা অশ্বেতাঙ্গ (আরবি) বাচ্চা ছেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে খুন করতে ইচ্ছা হল তাদের’।

নাহেলের মৃত্যুতে এত বড় বিক্ষোভের শিকড় আসলে রয়েছে অনেক গভীরে– বুর্জোয়া বিপ্লবের ফ্রান্স, ‘সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা’র স্লোগানে এক সময়ে সোচ্চার ফ্রান্সের সমাজ-মানসিকতার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা বর্ণবিদ্বেষের মধ্যে।

ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে ফ্রান্সেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি জাতি-উপজাতিগত বৈচিত্র্য। ২০২২-এর একটি সরকারি সমীক্ষা দেখাচ্ছে, সে দেশের ৬০ বছরের কম বয়সী অধিবাসীদের অন্তত ৩২ শতাংশের পূর্বপুরুষ বাইরে থেকে এসেছেন। আর ১৮ বছরের কম বয়সী মানুষের ৮৩ শতাংশেরই হয় বাবা নয়ত মা ছিলেন উত্তর আফ্রিকা, আলজেরিয়া কিংবা আফ্রিকার কোনও না কোনও দেশের অধিবাসী। নামে প্রজাতান্ত্রিক হলেও এবং আইনের খাতায় নাগরিকদের মধ্যে কোনও বৈষম্য না থাকলেও কার্যত ফ্রান্সের সমাজ জুড়ে ভাল মতোই রয়ে গেছে অশ্বেতাঙ্গ-বিদ্বেষ। নাহেলের মৃত্যুতে এই জনবিক্ষোভের পিছনে সেই বিদ্বেষের বিরুদ্ধে গরিব খেটে-খাওয়া মানুষের ক্ষোভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত বিশ্বের বহু জায়গাতেই, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশে দেশে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। সেখানকার প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদ লুট করে সমৃদ্ধ হয়েছে ফ্রান্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধীরে ধীরে সেইসব দেশ ঔপনিবেশিক শাসন উচ্ছেদ করে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আজও আফ্রিকার নানা দেশে ফ্রান্সের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। ফ্রান্সের একচেটিয়া পুঁজি আজও নানা কৌশলে পূর্বতন উপনিবেশগুলির সম্পদ পরোক্ষ ভাবে লুট করে নিজেদের মুনাফার ভাণ্ডার ভরিয়ে চলেছে। সেই উপনিবেশের দিনগুলি থেকেই ফ্রান্সে নানা কারণে বসতি তৈরি করেছে অন্য দেশের মানুষ। তাদের শ্রমে সমৃদ্ধ হয়েছে ফ্রান্স। আজও একটু বেশি মজুরি, আরও একটু সুযোগসুবিধার আশায় বিভিন্ন দেশ থেকে, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলি থেকে অশ্বেতাঙ্গ গরিব মানুষ ফ্রান্সে পাড়ি জমায়। কম মজুরিতে তাদের দিয়ে কাজ করানো যায় বলে ফ্রান্সও আশ্রয় দেয় তাদের। ফলে সেখানকার নাগরিকদের একটি বড় অংশ অধিকার করে রেখেছে কালো মানুষরা। এই কালো মানুষগুলি সাধারণত বাস করেন ফ্রান্সের শহরতলি অঞ্চলে। এঁদের অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় আর্থিক ভাবে পিছিয়ে-পড়া। দেশের দরিদ্রতম নাগরিক হলেন এই অভিবাসী মানুষরা। পড়াশোনার দিক দিয়েও শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় এঁরা পিছিয়ে। বেকারত্বও এঁদের মধ্যে তুলনায় অনেক বেশি।

ফ্রান্সের শ্বেতাঙ্গ বাসিন্দাদের একটি বড় অংশের ভিতরে থেকে যাওয়া অশ্বেতাঙ্গদের ‘অপর’ ভাবার মানসিকতার ফলে খাতায়-কলমে যতই সমতার কথা বলা থাক, পুলিস-প্রশাসনের সন্দেহ, নজরদারি ও রোষের মুখে সবচেয়ে বেশি পড়তে হয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা এইসব অশ্বেতাঙ্গ মানুষদেরই। ২০১৭ সালে ফ্রান্স সরকার একটি আইন পাশ করেছে। সেখানে ট্রাফিক আইন না মানলে পুলিশকে গুলি চালানোর অধিকার দেওয়া হয়েছে। সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ থেকে এই আইনের বলি হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশই অশ্বেতাঙ্গ, আফ্রিকা বা আরব বংশোদ্ভূত মানুষ।

পুঁজিবাদী ফ্রান্সের শাসক শ্রেণি, তাদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার ও সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের শোষণের স্বার্থেই সমাজ থেকে এই অশ্বেতাঙ্গ-বিদ্বেষ দূর করার কোনও চেষ্টা করে না। শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিজস্ব নিয়মে দেশে অনিবার্য ভাবে বেকারি, দারিদ্রের মতো মূল সমস্যাগুলির কারণ হিসাবে তারা অভিযোগের কৌশলী আঙুল তোলে অশ্বেতাঙ্গদের দিকে। এই অশ্বেতাঙ্গরাও যে ঘাম ঝরিয়ে পরিশ্রম করে দেশের সম্পদ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন, সে সব চাপা দিয়ে সমাজ-মননে বর্ণবিদ্বেষের বিষ ফেনিয়ে তোলে শাসকরা। ঠিক যেমন করে ভারতের সাম্প্রদায়িক স্বৈরাচারী শাসক সমস্ত সমস্যার মূল কারণ হিসেবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দিকে আঙুল তোলে।

এইভাবে দেশের নাগরিক হওয়া সত্তে্বও শ্বেতাঙ্গ সমাজের চোখে নিম্ন শ্রেণির মানুষ হিসেবে গণ্য হওয়ার যে যন্ত্রণা বছরের পর বছর সহ্য করে আসছেন ফ্রান্সের অশ্বেতাঙ্গ মানুষ, নাহেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাদের সেই জমে থাকা ক্ষোভ আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুঁজিবাদী শোষণের কবলে পড়ে সাধারণ মানুষের ক্রমাগত দুর্বিষহ হয়ে ওঠা জীবন। এর বিরুদ্ধে ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক পেনশন সংস্কার বিরোধী আন্দোলনে বারবার উত্তাল হয়েছে দেশ। গণদাবীর পাতায় আমরা বহু বার দেখিয়েছি, এই বিক্ষোভগুলির পিছনে আসলে রয়েছে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে জমে ওঠা ক্রোধ। গরিবি, বেকারি, শিক্ষাহীনতা, চিকিৎসা না পাওয়ার ক্ষোভের বারুদে আগুন দেয় কোনও না কোনও ঘটনা। ক্ষোভের সেই আগুন এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ফ্রান্সের গরিব অশ্বেতাঙ্গ বঞ্চিত মানুষের বুকে। নাহেলের মৃত্যুতে সেই ক্ষোভেরই উদগীরণ হল আরও একবার।

কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য, ফ্রান্সের মানুষ বারবার সরকার বিরোধী বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও সঠিক নেতৃত্বের অভাবে তাদের আন্দোলনগুলি যথার্থ পরিণতিতে পৌঁছতে পারেনি, পারছে না। কিছু দিন চলার পর স্বাভাবিক নিয়মে বিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে এলে শাসকরা আগামী দিনে আন্দোলন দমন করার লক্ষ্যে আরও কঠোর আইন তৈরি করে। পুলিশ-মিলিটারির হাতে তুলে দেয় অত্যাচারের আরও অবাধ ক্ষমতা। ঠিক যেমন নাহেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জ্বলে ওঠা বিক্ষোভের আগুন একটু নিভে আসতেই, সন্দেহভাজনদের উপর পুলিশ যাতে অবাধে নজরদারি চালাতে পারে, ইতিমধ্যেই ফ্রান্স সরকার সেই সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়ন করে ফেলেছে। ফলে আজ শুধু ফ্রান্স নয়, শ্রেণিবিভক্ত সমস্ত দেশেরই খেটে-খাওয়া বঞ্চিত-অত্যাচারিত মানুষের প্রয়োজন একটি সঠিক মার্ক্সবাদী দল, যার নেতৃত্বে শাসকের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলার পথে ধরে ধীরে ধীরে শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকেই উচ্ছেদের লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে।