Breaking News

মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধি বলতে কী বোঝায় — শিবদাস ঘোষ

‘‘মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধি কথাটার মানে কী? এই ‘প্রকৃত’ বলতে আমরা কী বুঝি? যুক্তিসম্মত আলোচনায় পাওয়া যাবে যে, মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদ প্রকৃত উপলব্ধি কথাটার যথার্থ মানে হচ্ছে, সঠিক বিজ্ঞানসম্মত বিচারপদ্ধতি, অর্থাৎ বিজ্ঞানসম্মত দ্বন্দ্বমূলক বিচারপদ্ধতি৷ এই সঠিক বিচারপদ্ধতি বাদ দিয়ে কোনও একটা বিষয়ে আলোচনায় যদি মনে হয়, এটাই ‘প্রকৃত’ এবং তাকে কেন্দ্র করে ঐক্যও হয়, তবে তাতে লাভ হয় না৷ আজ যেটা মনে হল প্রকৃত, কালই আবার একটা ঘটনায় দেখা যাবে, সমস্তটাই গোলমাল হয়ে গেল৷ এতে যেটা হয়, তা হচ্ছে সাময়িক ঐক্য৷ এর নামই হল সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছানো৷

কিন্তু এ ঘটনা তো দুটো সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ চিন্তাপদ্ধতির লোকের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে৷ তারাও তো অনেক সময় অনেক ইস্যুতে আপাতদৃষ্টিতে উপর উপর সাধারণ ঐক্যে আসে৷ একেবারে দুই বিপরীত মেরুর দর্শনের ব্যক্তিরাও একটা সাধারণ ইস্যুর উপর একটা মোটামুটি বিচারধারায় ঐক্যবদ্ধ হয়, একত্রে কাজ করে৷ না হলে, বিভিন্ন দল ও শক্তির যুক্তফ্রন্ট হয় কী করে? এইভাবে কোনও একটা সাধারণ ইস্যুর উপর ঐক্য করাটাই তো যুক্তফ্রন্ট রাজনীতির মূল কথা৷ কিন্তু, এই মাপকাঠিতে তো একটা পার্টি প্রকৃতই মার্কসবাদী–লেনিনবাদী পার্টি কি না, তার বিচার হয় না৷ একটা পার্টি প্রকৃতই মার্ক্সবাদী–লেনিনবাদী পার্টি কি না, তার মার্ক্সসবাদ–লেনিনবাদের উপলব্ধিটা সঠিক কি না, তা যদি আমরা বোঝার চেষ্টা করি, তা হলে সেই পার্টির বিচারপদ্ধতি কী, চিন্তাপ্রক্রিয়া কী রকম, অর্থাৎ সেটা সঠিক মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদী বিচারপদ্ধতি এবং চিন্তাপ্রক্রিয়া কি না, সেইটা বোঝা অত্যন্ত জরুরি৷ অথচ এই ব্যাপারটা আমাদের দেশে মার্ক্সসবাদী–লেনিনবাদী আন্দোলনে পরিষ্কার হয়নি৷ আমাদের দেশে প্রথমে সি পি আই, তারপর তা ভেঙে সি পি আই (এম), সেটাও ভেঙে পরে সি পি আই (এমএল) হল৷ অবশ্য, সি পি আই (এমএল) দ্রুত ভেঙে শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ সি পি আই এবং সি পি আই (এম) এই যে একই পার্টি ভেঙে দুটো পার্টি আমাদের দেশে মার্কসবাদ–লেনিনবাদী নাম নিয়ে দাঁড়াল, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের স্বীকৃতি ও গৌরবকে ভিত্তি করে বড় পার্টি হয়ে গেল, তাদের মার্কসবাদ–লেনিনবাদ সম্পর্কে উপলব্ধি কী? এই আসল জায়গাটাই কেউ বিচার করে পরিষ্কার করে নিতে চায় না৷ তাদের রাজনৈতিক প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তগুলো বিচার করতে গিয়েও আমরা প্রতিপদেই দেখছি যে, ছোটখাটো দু’চারটে বিষয় ছাড়া মূল বক্তব্য, রাজনৈতিক বক্তব্য তাদের আগাগোড়াই ভুল৷ ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিপ্লবের স্তর, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী নেতৃত্ব সম্পর্কে ধারণা ইত্যাদি যে কোনও মূল বিষয়ে বিচার করলেই দেখা যাবে, এ সম্পর্কে সি পি আই, সি পি আই (এম)-এর বক্তব্য, বিশ্লেষণ, তত্ত্ব সবই ভুল৷

কিন্তু আমি এর চেয়েও আর একটা মূল বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই৷ কারণ, মার্কসবাদী–লেনিনবাদী সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব বলতে কেবল বিপ্লবের স্তর নির্ধারণটা সাধারণভাবে সঠিক হওয়াই বোঝায় না৷ যদিও বিপ্লবের স্তরটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে যে দলকে জনগণের মধ্যে গিয়ে কাজ করতে হয়, জনগণকে সংগঠিত করতে হয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে টেনে আনতে হয়, তার কাছে রাষ্ট্রের চরিত্র কী, বিপ্লবের স্তর কী, কোন শ্রেণিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে কোন কোন শ্রেণি মিলে উচ্ছেদ করবে– এই প্রশ্নগুলো অত্যন্ত জরুরি, এগুলো অন্যতম মূল বিষয়৷ এগুলো ছাড়া একটা রাজনৈতিক আন্দোলন দাঁড়াতেই পারে না৷ এগুলো হল একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের সামনে বিপ্লবী তত্ত্বের বিশেষীকৃত রূপ৷ কিন্তু আমি বলতে চাইছি, এই জায়গায় যদি দুটো রাজনৈতিক দলের মিল হয়ে যায়, তা হলেই কি বলা যাবে, তত্ত্বের মিল হয়ে গেল? অনেকে বলবেন, মিল হল৷ আমি মনে করি, না৷ শুধু এই দিয়ে মিল হয় না৷ যেমন, আমরা এস ইউ সি আই বলি যে, ভারতবর্ষ একটি পুঁজিবাদী দেশ এবং এখানে  বিপ্লবটা হবে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷ এই কথাটা আমাদের দেশে আরএসপি বলে, ওয়ার্কার্স পার্টি বলে, আরসিপিআই-ও বলে থাকে৷ এমন ব্যক্তিও দেশে পাওয়া যাবে, তত্ত্ব বোঝেন বলে যাঁদের অহমিকা আছে, তাঁদের প্রশ্ন করা হলে তাঁরাও বলে দেবেন, ভারতবর্ষ একটি পুজিবাদী রাষ্ট্র, এখানে ক্ষমতায় আছে বুর্জোয়াশ্রেণি, তাদের উচ্ছেদ করবে শ্রমিক-চাষি-নিম্নবিত্ত, নেতৃত্ব দেবে সর্বহারা, বিপ্লবটা এখানে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷ ব্যস, তা হলেই কি এসব দল ও ব্যক্তির সাথে এস ইউ সি আই-এর মূল বক্তব্য মিলে গেল, তত্ত্ব মিলে গেল, এ কথা বলা যায়? না, বলা যায় না৷ এই মিল আছে কি না দেখতে গেলে দেখতে হবে, প্রত্যেকের বিচারপদ্ধতি, চিন্তাপ্রক্রিয়া, মার্ক্সসবাদী–লেনিনবাদী মূল নীতিগুলোর সর্বব্যাপক ক্ষেত্রে উপলব্ধি, যৌথ চিন্তা বা যৌথ নেতৃত্ব এবং তার বিশেষীকৃত প্রকাশ– এইসব মূলগত বিষয়ে চিন্তাগত ভিত্তি এক কি না, অর্থাৎ মার্ক্সসবাদ–লেনিনবাদ সম্পর্কে ধ্যানধারণাগুলো মূল যে চিন্তাগত ভিত্তি থেকে জন্ম নিচ্ছে, সেই ভিত্তিটা এক কি না৷

এখন, মার্কসবাদ–লেনিনবাদের এই যে প্রকৃত উপলব্ধি, অর্থাৎ সঠিক মেথডলজি (বিচারপদ্ধতি), এটা মার্ক্স–এঙ্গেলস–লেনিন-এর বই মুখস্থ করে আয়ত্ত করা যায় না৷ রাশিয়াতেও অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি মার্ক্স–এঙ্গেলসের কোটেশন আউড়ে রাশিয়ার সমাজ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাশিয়ার বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি৷ তাঁরাও মুখে বলেছিলেন, মার্ক্সবাদ একটা ডগমা (সূত্রবাদ) নয়, কিন্তু বাস্তব বক্তব্যে ও কার্যকলাপে তাঁরা তাকে সূত্রবাদেই পরিণত করেছিলেন৷ মার্ক্স তাঁর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভেবেছিলেন যে, সর্বহারা বিপ্লব প্রথমে অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলিতেই হবে৷ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার তখনকার উদারনৈতিক পরিবেশ দেখে মার্ক্স এমন কথাও বলেছিলেন যে, ওই সব দেশে বিপ্লব শান্তিপূর্ণ উপায়ে হবে৷ রাশিয়াতে অনেক মার্ক্সবাদী পণ্ডিত মার্ক্সের ওই কথাগুলো আউড়ে বিপ্লব বোঝার চেষ্টা করেছিলেন৷ এঁদের সঙ্গে লেনিনকে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রামে নামতে হয়েছিল৷ লেনিন বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী যুগের সঙ্গে মার্কসের যুগের পার্থক্য কী, এবং সেই পার্থক্য অনুযায়ী কেন এযুগে বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোর বদলে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের সবচেয়ে দুর্বল স্থানগুলিতে এসে যাবে এবং সেখানেই বিপ্লব হবে, তা দেখালেন৷ লেনিন তত্ত্বগতভাবে এও দেখালেন যে, আজকের যুগে বুর্জোয়ারা যখন গণতন্ত্রের চেয়ে সামরিকবাদ ও আমলাতন্ত্রের দিকেই বেশি ঝুঁকেছে, তখন প্রতিটি দেশে বিপ্লব সশস্ত্র হতে বাধ্য৷ এসব বিষয় ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র ও রূপ, কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন, তার গণতন্ত্রের ধারণা, সর্বহারা একনায়কত্ব, সর্বহারা বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা চাষির ভূমিকা, ইত্যাদি নানা মূল বিষয়ে প্লেখানভ, ট্রটস্কি, কাউটস্কি ও অন্যান্যদের সঙ্গে লেনিনের তীব্র বিতর্ক হয়৷ এই বিতর্ক কেন হল? সকলেরই তো মার্ক্স-এঙ্গেলস-এর বইগুলো কণ্ঠস্থ ছিল, তা হলে বিতর্ক হল কেন? কারণ, একদল কেবল মার্ক্স-এঙ্গেলসের বাণীগুলোকে, সিদ্ধান্তগুলোকেই তত্ত্ব বলে ধরে নিয়েছেন৷ আর, লেনিন মার্ক্সবাদের তত্ত্ব বলতে মার্ক্স–এঙ্গেলসের কথাগুলো, বা তাঁদের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে সিদ্ধান্তগুলো তাঁরা করেছিলেন, শুধু সেগুলোকে মনে করেননি৷ তিনি ধরেছেন– যে বিজ্ঞানটাকে, যে বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতিকে প্রয়োগ করে মার্ক্স একটা সময়ে সিদ্ধান্তগুলো করেছিলেন, সেই বৈজ্ঞানিক বিচার–বিশ্লেষণ পদ্ধতিটাই হল মার্ক্সবাদ৷ যেমন, মার্ক্স নিজে ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখে সর্বহারা বিপ্লব গণতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণ পথে হবে বলে যে সিদ্ধান্ত করেছিলেন, প্যারি কমিউনের ঘটনার পর সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মার্ক্স তাঁর একই বক্তব্যের উপর নিজেই ‘গোথা প্রোগ্রামে’ সংশোধনী এনেছিলেন৷  দু’য়ের মধ্যে সময়েরও খুব পার্থক্য ছিল না৷ বুর্জোয়া রাষ্ট্রের আগ্রাসী রূপটা না দেখে মার্ক্স এক রকম সিদ্ধান্ত করেছিলেন, পরে প্যারি কমিউন তাঁকে শুধরে দিয়েছে৷ আজও যাঁরা মার্ক্সের কোনও কথা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, এই কথাটা মার্ক্স বলেছিলেন, যা ইতিহাসে ফলেনি, ঐ কথাটা ফলেছে, তাঁরা কি মার্ক্সবাদী? তাঁরা মার্ক্সবাদ বোঝেনইনি৷ লেনিন ঠিকই ধরেছিলেন যে, এগুলো মার্ক্সবাদ নয়, এভাবে মার্ক্সবাদ বোঝা যাবে না, তাকে প্রয়োগ করা যাবে না৷

একই ভাবে লেনিন কোথায় কী বলেছেন, তা লেনিনবাদ নয়৷ লেনিন যে বিজ্ঞানটিকে প্রয়োগ করলেন, যে কায়দায় যেভাবে করলেন এবং তা করতে গিয়ে আবার ঐ বিজ্ঞানকে, ঐ বিচারবিশ্লেষণ পদ্ধতিকে তিনি যতটা উন্নত  করলেন এবং তার ভিত্তিতে একটা বিশেষ অবস্থায় যেমূল নীতিগুলো নির্ধারণ করলেন, সেই মূল নীতিগুলো হল মূল বুনিয়াদ, আর সেই বিচারবিশ্লেষণ পদ্ধতিটি হল লেনিনবাদ৷ সেটি আয়ত্ত করতে না পারলে, শুধু লেনিনের কথাগুলো মুখস্থ করে আওড়ালে কিছুই হবে না, শুধু নকলনবিশি করা হবে৷ তাই লেনিনের সময় পার্টি গঠন, আর আজকের সময়ে ভারতবর্ষের জমিতে পার্টি গঠনের পদ্ধতি হুবহু এক হতে পারে না– বিশেষ করে বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদ আজ যে রূপ নিয়ে দেখা দিচ্ছে, তা লেনিনের সময় এই রূপ নিয়ে ছিল না৷

(‘বৈজ্ঞানিক দ্বন্দ্বমূলক বিচারপদ্ধতিই মার্কসবাদী বিজ্ঞান’ বই থেকে)