ভোট রাজনীতি কালিয়াগঞ্জের পরিস্থিতিকে বিষাক্ত করে তুলেছে

কালিয়াগঞ্জের ঘটনার প্রতিবাদে ও দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবিতে রায়গঞ্জে মিছিল। ২৯ এপ্রিল

 

উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জে এক নাবালিকার মৃত্যু ও তাকে ঘিরে শাসক তৃণমূল ও বিজেপি নেতৃত্বের ভূমিকা থেকে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠছে। ২১ এপ্রিল কালিয়াগঞ্জের মালগাঁ অঞ্চলের গাঙ্গুয়া গ্রামের ওই কিশোরীর নিথর দেহ পাওয়া যায় ওই গ্রামেরই এক পুকুর ধারে। দেহ পাওয়ার পরই পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁর রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ জানতে, দোষীদের শাস্তি ও ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন গ্রামবাসীরা। ময়না তদন্তের আগেই পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আত্মহত্যার কাহিনি প্রচার করা হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষ পুলিশের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, পুলিশের প্রতি অবিশ্বাসও দানা বাঁধতে থাকে। উচ্চপদস্থ অফিসারদের নির্দেশে ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহ দ্রুত পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার সময় জনতার সঙ্গে পুলিশ বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে যায় এবং হঠাৎ পুলিশ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। পুলিশ লাঠি চালায়, কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটায়। শুধু তাই নয়, জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে, সম্পূর্ণ অমানবিক ভাবে মৃতদেহ টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায়।

এই বর্বরোচিত আচরণ যাঁরা দেখেছেন তাঁরাই শিউরে উঠেছেন। মানুষ হতবাক, ক্রুব্ধ! রাজ্যে প্রশাসনের প্রধান হিসাবে এবং পুলিশমন্ত্রী হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী এর দায় কোনওভাবেই এড়াতে পারেন না। জেলা জুড়ে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই ক্ষোভকে ভোটের বাক্সে কাজে লাগাতে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়ে বিজেপি। তারা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে তোলে, সঙ্গে যোগ দেয় আরএসএস এবং তাদের আইটি সেল। তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে নাটক তৈরি করে সোস্যাল মিডিয়ায়় ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে ক্রমাগত উত্তেজিত করে তোলে হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে। ঠিক একই রকম ভাবে মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরির লক্ষে্য সরকার ও প্রশাসন একে ব্যবহার করেছে। রাজবংশী, তফসিলি ও আদিবাসী সংগঠনের সমন্বয় কমিটির নামে থানা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে বিজেপি ও আরএসএস। কালিয়াগঞ্জ বরাবর শান্তিপ্রিয় শহর। দু-দলের ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির চক্রে পড়ে ভয়াল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। থমথমে পরিবেশের মধ্যে দিনযাপন করতে হচ্ছে কালিয়াগঞ্জবাসীদের। শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অথচ মানুষ এ পরিবেশ চায় না, বিদ্বেষ চায় না, চায় শান্তি। কালিয়াগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক শান্তনু দেবগুপ্ত বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত। এমন ঘটনা কখনওই কাম্য নয়। শান্তির পরিস্থিতি বজায় রাখতে রাজনৈতিক দলগুলির শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া দরকার।’ (আনন্দবাজার -২৬ এপ্রিল’২৩)

ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কুরুচিকর মন্তব্য করায় মানুষ আরও ক্ষিপ্ত। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে প্রশাসনের শীর্ষে থাকা মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে শান্তিপ্রিয় নাগরিকেরা সু-পরামর্শ, গঠনমূলক পদক্ষেপ আশা করেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী, উস্কানিমূলক, প্ররোচনামূলক বক্তব্য রাখলেন, বললেন ‘পুলিশ কি চুড়ি পরেছিল?’ এই বক্তব্যের পরই পুলিশ অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তল্লাসির নাম করে বিয়ে বাড়িতে বেড়াতে আসা মৃত্যুঞ্জয় বর্মনকে (৩৩ বছর) পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করে। এর দায় মুখ্যমন্ত্রী এড়াতে পারেন কি?

উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ স্বভাবগত ভাবেই সহজ সরল। বহু যুগ ধরেই দুই ধর্মের মানুষ পাশাপাশি সহ অবস্থান করছে। একই আঙিনায়–মন্দির-মসজিদ পাশাপাশি রয়েছে। মুসলিমদের ধর্মীয় জলসা কমিটির সম্পাদক হিন্দু যুবক, আবার দুর্গাপূজা, কালীপূজা কমিটির সম্পাদক মুসলিম যুবক। বিয়ে বাড়িগুলোতে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একই সঙ্গে আমন্ত্রিত থাকেন। এ নিয়ে কোনও সমস্যা হয় না। এখানে বহু দিন থেকে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথী। ধর্ম এখানে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে মিশে থাকে, কোনও বাধার কারণ হয় না।

তা হলে এই মানুষগুলিকে কেন বারবার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে? কেন প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ মানুষের? কখনও দাড়িভিটে, কখনও রায়গঞ্জের তাহেরপুরে, কখনও চোপড়ায়, কখনও কালিয়াগঞ্জের মালগাঁ– প্রত্যেকটা ঘটনার তদন্ত করলে, যুক্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ মন নিয়ে বিচার করলে, সঠিক কারণ পরিষ্কার হবে। এই ঘটনা প্রবাহ থেকে যে বিষয়গুলি উঠে এসেছে তা হল–

১) পুলিশের দৈনন্দিন আচরণে অভব্যতা, ঘুষ দুর্নীতির কারণে পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকেছে, ২) মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা, হাতের কাছেই মাদক, মোবাইলের মাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিত পর্নোগ্রাফি কিশোর-কিশোরীদের বিপথগামী করছে, ৩) উত্তরবঙ্গে যে কোনও ভাবে ভোটে জিততে মরিয়া সংসদীয় বিরোধী দল বিজেপি সমাজকে আরও বিষাক্ত করছে, ৪) ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে তৃণমূলও প্রশাসনকে কখনও নিষ্ক্রিয়, কখনও অতিসক্রিয় করছে, ৫) পুলিশকে দলদাস হিসাবে ব্যবহার করার যে ট্র্যাডিশন কংগ্রেস শাসনে, সিপিএম শাসনে ছিল, তৃণমূল শাসনেও তা পুরোমাত্রায় বহাল রয়েছে।

ভোটের স্বার্থে দুই দলের মাধ্যমে এই যে দুষ্ট রাজনীতি কালিয়াগঞ্জে পরিস্থিতি বিষাক্ত করে তুলছে তার বিরুদ্ধে এলাকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।