পাঠকের মতামতঃ দুঃসময়

একটা খুব জটিল এবং কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ৭৫ বছরের ইতিহাসে এমন কঠিন সময় খুব একটা আসেনি।

আমি রাজনৈতিক দুর্নীতি, নেতাদের জেলে যাওয়া, রোজ কারও না কারও বাড়িতে সিবিআই হানা দেওয়ার কথা বলছি না। কোনও রাজনৈতিক শত্রুতার কথাও বলছি না, রাজনৈতিক বিদ্বেষের জন্য বুদ্ধিজীবীদের জেলে পোরার মতো ঘটনার কথাও উল্লেখ করছি না। কারণ ভারতের সাধারণ মানুষ কখনও রাজনীতি, প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা করেননি। কোনও রাজতন্ত্র শাসনযন্ত্র প্রশাসনকে পরোয়া করেননি। তাঁরা নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছেন। এই বাঁচাটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সৌহার্দ্যের সঙ্গে বাঁচা।

মানুষের মধ্যে নানা পার্থক্য আছে– ধর্মের পার্থক্য, চিন্তাভাবনার পার্থক্য, পোশাক ও রুচির পার্থক্য। এই পার্থক্য সত্ত্বেও একটা আত্মীয়তার বন্ধনও সমাজে তৈরি হয়েছিল।

আজকের ভারতবর্ষে কিন্তু ঠিক বিপরীত জিনিসটাই চলছে। তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে মানুষে মানুষে বিভেদ। বিভেদকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বড় করা হচ্ছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্পর্ককে বৈরিতা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।এ কথাটি ঠিক যে, ইসলামের চিন্তাভাবনা, ধর্ম-সংস্কৃতি ভারতের বাইরে থেকে আসা।কিন্তু এটাও স্বীকার করে নিতে হবে মুসলমানদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হিন্দু, বিদেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা নয়।

আর একটা বড় কথা ইসলামি সংস্কৃতি বলতে আমরা এখন যেটাকে বুঝি, খেয়াল করলে দেখা যাবে, তার একটি আলাদা রকমের ভারতীয়করণ হয়েছে।এখানকার ইসলাম সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান প্রধান দেশগুলির সঙ্গে কিন্তু অনেকটাই মেলে না। সেটা ভাষা হতে পারে, শিল্প-সংস্কৃতি হতে পারে, সঙ্গীত চর্চা হতে পারে, এমনকি ধর্মও হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলির সঙ্গে তার বহু পার্থক্য পাওয়া যায়।

খুব স্বাভাবিক একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছে যে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল। মুসলমান মানেই পাকিস্তানপন্থী এবং ভারতের শত্রু। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, মুসলিম মানেই পাকিস্তানপন্থী কেন হবে? দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইসলাম মানেই সন্ত্রাসবাদী।

সব মুসলমানই যে সন্ত্রাসবাদী এই দাগিয়ে দেওয়াটা বিদ্বেষপ্রসূত। তাহলে তো নাথুরাম গডসের ব্যাপারটা ওঠে এবং সব হিন্দুদের ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে দেওয়া যায়। সেটা কে মানবে? একটা কল্পিত প্রাচীন ভারতের ম্যাপকে তুলে ধরে বলা হচ্ছে এটাই বৃহত্তর ভারত। বাস্তব হল এরকম বৃহত্তর ভারত কখনওই ছিল না। প্রাচীন যুগে ভারতবর্ষের ষোড়শ মহাজনের পদের হদিশ পাওয়া যায় বৃহৎ রাজ্যের যাত্রাপথে। অর্থাৎ ১৬টি বড় বড় রাজ্য ছিল। সেখান থেকে বড় রাজ্য গড়ার প্রয়াস করেন মহাপদ্ম নন্দ, এর পর অশোকের রাজত্ব। কিন্তু ত্রিপুরা সহ বাংলাদেশের পূর্ব অংশ এর বাইরে ছিল। দাক্ষিণাত্যের বিরাট একটি অংশও এর বাইরে ছিল। হুন আমলে এই রাজ্য অনেকটাই বিস্তারিত হয়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে কনিষ্ক তথাকথিত ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গীভূত নন, বহিরাগত।

সমুদ্রগুপ্তের আমলে গুপ্তরাজ্য বা পরে বিক্রমাদিত্যের আমলেও গোটা ভারতবর্ষের যে ছবিটা তুলে ধরা হয়, তা থেকে বৃহত্তর ভারতের ধারণাকে সত্য প্রমাণ করা যাবে না। কারণ দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ জায়গাতেই আলাদা রাজা ছিল এবং তাদের শিল্প সংস্কৃতি আলাদা ছিল। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা রাজনৈতিক দিক দিয়ে এসব রাজারা কেউই নিজেদের ভারতবর্ষের রাজা বলে ঘোষণা করেননি।এমনকি ব্রিটিশদের থেকে যখন আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিলাম তখনও দেখেছি ব্রিটিশ ভারত ছাড়াও শ’খানেক দেশীয় রাজ্য আছে।তাদের মধ্যে কেউ পাকিস্তানে যেতে চায় তো কেউ স্বাধীন থাকতে চায়।

কিছুদিন আগে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের সময় দেখা গেল অনেক সাধু সন্ন্যাসীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু যেভাবে অন্য প্রধান ধর্মগুলোকে চেপে দেওয়া হচ্ছিল তাতে ভয় লাগছিল এটা হিন্দু ধর্মের রূপ নয়। এখানে অনেক উপজাতি রয়েছে চাঁদ, সূর্য, পৃথিবী তাদের দেবতা তারা কোথায়? উত্তর-পূর্বে যে উপজাতিরা রয়েছে তাদের দেবতারা কোথায়? সংখ্যার গুরুভারকে গুরুত্ব দিয়ে চেপে দেওয়া হচ্ছে সংখ্যালঘুদের।

যারা প্রাচীন ভারতের জয়গাথার কথা বলেন তারা ভুলে যান, প্রাচীন ভারতে প্রধান হিন্দু ধর্মের মধ্যেই অনেক মত।এই পরিসরের বাইরে ছিল আরও অসংখ্য মত ও ধর্ম। দর্শনের দিক দিয়ে ভারত ছিল বহুধা বিভক্ত, সেখানে এমনকি নাস্তিকরাও সসম্মানে ছিলেন। হিন্দু ধর্মের একটি প্রতিবাদী রূপ ছিল আজীবক জৈন এবং বৌদ্ধরা।ইতিহাসে পাওয়া যায় একই সময়ে একই গ্রামে বৌদ্ধ, জৈন এবং আজীবকেরা ধর্ম প্রচার করছেন, কিন্তু কোনও সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে না। দাঙ্গা হাঙ্গামা হচ্ছে না।

আসলে যারা প্রাচীন ভারতের গৌরবের কথা তোলেন তারা এই তথ্যগুলো আমাদের সামনে তুলতে ভুলে যান, কারণ তারা জানেন তাতে তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি হবে না।আসলে আমরা খালি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য খুঁজিনি।ঐক্যের মধ্যে যে বৈচিত্র্য থাকতে পারে তাকে স্বীকার করতে শিখেছি।ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন সেই শেখাকেই তছনছ করতে চায়।

রবিব্রত ঘোষ, দুর্গাপুর