Breaking News

উদ্ধত শাসককে মাথা নোয়াতে বাধ্য করল ইজরায়েলের মানুষ

লাগাতার গণআন্দোলনের চাপে দেশের বিচারব্যবস্থাকে সরকারের মুঠোয় পুরে ফেলার মতলব থেকে পিছু হটতে বাধ্য হলেন ইজরায়েলের ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিন মাস ধরে চলা দেশজোড়া বিক্ষোভ এবং সর্বাত্মক ধর্মঘটের মুখে পড়ে ২৭ মার্চ নেতানিয়াহু বিচারব্যবস্থা সংস্কারের বিতর্কিত বিলটি স্থগিত করার কথা ঘোষণা করেন। পশ্চিম এশিয়ায় প্রভুত্ব বিস্তারে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত স্যাঙাৎ ইজরায়েলের ফ্যাসিবাদী শাসক নেতানিয়াহুর এই পরাজয় দেখিয়ে দিল, লক্ষ্যে স্থির থাকলে সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলন অতি বড় স্বৈরাচারী শাসকের মাথাও নোয়াতে পারে।

দেশের বিচারবিভাগের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে গোটা ব্যবস্থাটির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। এই উদ্দেশ্যে বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কার ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছিল তাঁর সরকার। যেমন, বর্তমানে ইজরায়েলের সংসদ বা নেসেটের তৈরি আইন, সরকারি সিদ্ধান্ত ও নিয়োগগুলি যুক্তিসঙ্গত কি না, তা বিচার করার ক্ষমতা বর্তমানে ইজরায়েলের সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে। নেতানিয়াহু তা বাতিল করতে চেয়েছেন। এমনকি বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টিও সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান ব্যবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতি, বার অ্যাসোসিয়েশন ও নেসেটের দু’জন করে সদস্য এবং দু’জন মন্ত্রীকে নিয়ে গঠিত নয় সদস্যের কমিটি বিচারপতিদের নির্বাচন করে। প্রস্তাবিত সংস্কারে বার অ্যাসোসিয়েশনের দু’জনকে হঠিয়়ে সরকারের প্রতিনিধি দু’জনকে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। মানে, নির্বাচন কমিটিতে সরকার তথা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কায়েম করতে চেয়েছেন নেতানিয়াহু। এর বিরুদ্ধেই দেশ জুড়ে ফুঁসে উঠেছে জনরোষ। গণতন্ত্রের উপর এই আঘাত রুখতে পথে নেমেছেন ইজরায়েলের লক্ষ লক্ষ মানুষ।

ঘটনার শুরু জানুয়ারি মাসে। গত ডিসেম্বরে দক্ষিণপন্থী লিকুড দলের নেতা নেতানিয়াহু ইজরায়েলে সরকার গড়ে প্রধানমন্ত্রী পদে বসেন। এক মাসের মধ্যেই সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও বিচারমন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিন বিচারব্যবস্থা সংস্কারের একটি বিল সংসদে পেশ করেন। বিলের খবর প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশ জুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। গণতন্ত্র রক্ষায় বিচারবিভাগকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়ার দাবিতে সেই থেকে তিন মাস ধরে তেল আভিভ, জেরুজালেম সহ একশোরও বেশি শহরে লক্ষ লক্ষ আন্দোলনকারী লাগাতার প্রবল বিক্ষোভ দেখান। স্লোগান তোলেন গণতন্ত্র ও বিচারবিভাগের স্বাধীনতার দাবিতে। সংগঠিত, শান্তিপূর্ণ সেই বিক্ষোভে কে না সামিল হয়েছেন! দেশের মহিলা সংগঠনগুলি, বুদ্ধিজীবী ও দেশের শিক্ষিত অংশের মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সৈনিক এমনকি জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড়কর্তারা পর্যন্ত দলে দলে বিক্ষোভ মিছিলে সোচ্চার হয়েছেন।

সমস্ত স্বৈর শাসকের মতোই নেতানিয়াহু যথারীতি গায়ের জোরে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা চালান। চলে পুলিশি হামলা। গ্রেপ্তার হন দেড়শোরও বেশি বিক্ষোভকারী। এদিকে বিচার ব্যবস্থা সংস্কারে সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন স্বয়ং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্ট। অবিলম্বে এই বিল স্থগিত করার দাবি জানান তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিসভা থেকে তাঁকে বরখাস্ত করেন নেতানিয়াহু। এতেই আগুনে ঘি পড়ে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সমর্থনে দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশের পতাকা হাতে ২৫ মার্চ রাতেই রাস্তায় নামেন। পরদিন দেশের প্রধান শহরগুলিতে প্যালেস্তাইনে আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনকারীরা, যাদের মধ্যে ছিলেন ইজরায়েলের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাও, বিশাল বিক্ষোভ মিছিল করেন। জেরুজালেমে নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে নেতানিয়াহুর প্রাসাদের সামনে সমবেত হন হাজার হাজার মানুষ। দেশের প্রধান হাইওয়েটি অবরুদ্ধ হয়। ২৭ মার্চ ধর্মঘটের ডাক দেয় ইজরায়েলের সবচেয়ে বড় শ্রমিক সংগঠন ‘হিস্টাড্রূট’। স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা দেশ। ঝাঁপ ফেলে একমাত্র বিমানবন্দরটিও। দেশে দেশে ইজরায়েলের দূতাবাসগুলির কর্মীরাও সোচ্চার হন প্রতিবাদে। দেশের বাইরে লন্ডনে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে মিছিল হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন অবিলম্বে বিচার ব্যবস্থার সংস্কার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পর্যন্ত ‘গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী’ সেজে তাঁকে সতর্ক করে বলেন, এই বিল স্থগিত না করলে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ইজরায়েলের মর্যাদা গোটা বিশ্বের চোখে খাটো হয়ে যাবে।

শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকারে বাধ্য হন নেতানিয়াহু। আগামী গ্রীষ্ম পর্যন্ত তিনি বিলটি স্থগিত করার কথা ঘোষণা করেন।

কিন্তু কেন বিচারব্যবস্থার উপর এই নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা? এর পিছনে রয়েছে ইজরায়েলের ইহুদিবাদী উগ্র দক্ষিণপন্থী শাসকদের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা। বহু বছর ধরে ইজরায়েলের রাজনীতি চরম দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। দক্ষিণপন্থী লিকুড পার্টি ছাড়াও সেখানকার নেতানিয়াহু সরকারে রয়েছে ইহুদি ধর্মের সমর্থক অতি গোঁড়া রাজনৈতিক দল, ইহুদি রাষ্ট্রবাদী ধর্মীয় দল এবং উগ্র ইহুদিবাদী কয়েকটি শক্তি। বিচারব্যবস্থাকে মুঠোয় নেওয়ার জন্য সরকারের উপর তারা চাপ সৃষ্টি করছে। কারণ, এই দলগুলির মতে, দেশের বিচারবিভাগে উদারবাদী ও বামপন্থীদের যে প্রভাব রয়েছে, তার ফলে ইজরায়েলের প্রকৃত ইহুদিবাদী পরিচিতি বিশ্বের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বাধা হচ্ছে।

এই চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি কারণ। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মাথার উপর ঘুষ, প্রতারণা ও চুক্তিভঙ্গ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মামলা আদালতে ঝুলছে। বিচার ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে এলে সেগুলি থেকে রেহাই পেতে সুবিধা হবে বলে মনে করছে শাসক দল। ইতিমধ্যেই সংসদে এমন একটি আইন নেতানিয়াহু পাশ করিয়ে নিয়েছেন, যাতে সুপ্রিম কোর্ট ‘অনুপযুক্ত’ বলে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারবে না। কিন্তু তাঁদের আশঙ্কা, এই আইন সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে ও তাঁর সরকারে থাকা দক্ষিণপন্থী দলগুলি যে কোনও উপায়ে বিচারব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ এনে খর্ব করতে চাইছে ইজরায়েলে টিকে থাকা গণতন্ত্রের শেষ রেশটুকুও।

শুধু ইজরায়েল নয়। সাম্রাজ্যবাদের স্তরে পৌঁছে সংসদীয় বুর্জোয়া ব্যবস্থা আজ যখন অন্তিম নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন দক্ষিণপন্থী শাসকরা বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের যেটুকু অবশেষ এখনও কোনক্রমে টিকে আছে, তাকে পদদলিত করে শোষণ অবাধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং ভারতে বিচারব্যবস্থার আপেক্ষিক স্বাধীনতা যেটুকু এখনও বজায় আছে, কেন্দ্রের দক্ষিণপন্থী মোদি সরকার সেটুকুও হরণ করার এবং প্রলোভন, ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে বিচারব্যবস্থাকে নিজের কব্জায় রাখার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ধর্মের নামে দাঙ্গা বাধিয়ে তারা শুধু মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে তাই নয়, গণতন্ত্রের সমস্ত রীতিনীতি দু’পায়ে মাড়িয়ে, সংসদের বিতর্ক পর্যন্ত এড়িয়ে গিয়ে, গায়ের জোরে দেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে নানা কালা আইন।

কিন্তু ইজরায়েলের মতোই, ভারত সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন উদারবাদী সাধারণ মানুষ দক্ষিণপন্থী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। প্রতিবাদ জানাচ্ছেন পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে। মানুষ দেখেছে, ভারতের দিল্লি সীমান্তে দীর্ঘ কৃষক আন্দোলন অনেক ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে কীভাবে দাম্ভিক মোদি সরকারকে বাধ্য করেছে সর্বনাশা কৃষি-আইনগুলি বাতিল করতে। এনআরসি, সিএএ-র মতো কালা কানুন জারি করা থেকে উদ্ধত মোদি সরকারকে পিছু হঠতে হয়েছে দেশজোড়া গণআন্দোলনেরই চাপে। ইউরোপ জুড়ে দেশে দেশে আছড়ে পড়ছে গণআন্দোলনের ঢেউ। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি উত্তাল হচ্ছে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির সোচ্চার আন্দোলনে। এই সেদিন শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ সেখানকার আতঙ্কিত অত্যাচারী শাসকদের দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছে। সরকারি ভবন, রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ দখল করে নিয়েছে ভুখা মানুষ। যদিও, দুঃখের হলেও সত্য, সঠিক নেতৃত্বের অভাবে সেই আন্দোলনের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ভুয়ো প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আবার শ্রীলঙ্কায় কায়েম হয়েছে জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্করহিত মালিকি শাসন-শোষণ।

ঠিক এই জায়গায় পৌঁছে আমাদের স্মরণ করতে হবে এ যুগের অন্যতম মহান মাক্সর্বাদী চিন্তানায়ক, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শিবদাস ঘোষের সতর্কবার্তা। তিনি দেখিয়েছেন, শাসকের উৎপীড়ন থেকে মুক্তির আকাঙক্ষা বারবার মেহনতি মানুষের চেতনায় ধাক্কা দেয়। বারবার গমকে গমকে ফেটে পড়ে বিক্ষোভ। বারবার পথে নামে অত্যাচারিত খেটে-খাওয়া মানুষ। তারা রক্ত ঝরায়, প্রাণ দেয়। কিন্তু সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় মুক্তি মেলে না। সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে এই অন্যায় শাসন-শোষণ সমাজ থেকে মুছে ফেলা যায় না।

ইজরায়েলে জনসাধারণের এই ঐতিহাসিক জয় দেখিয়ে গেল, ঘৃণ্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট সে দেশের শাসক শ্রেণি যত বড় উগ্র ইহুদিবাদীই হোক না কেন, শত অপচেষ্টাতেও তারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি মানুষের চেতনা থেকে উদারবাদী সংস্কৃতি, গণতন্ত্রের প্রতি টান, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শোষণের হাত থেকে মুক্তির আকাঙক্ষা মুছে দিতে পারেনি। ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবল ঢেউ ভেঙে দিয়ে গেছে গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরতে চাওয়া দক্ষিণপন্থী শাসকের আধিপত্যবাদী হাতের মুঠো। কিন্তু এখানেই থামলে চলবে না। কারণ, বিচার সংস্কারের বিতর্কিত বিলটি নেতানিয়াহু সরকার আপাতত স্থগিত করেছে মাত্র, বাতিল করেনি। ফলে আগামী দিনে সে যে আবারও দেশের মানুষের উপর এটি চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

এই বিল সম্পূর্ণ বাতিলের দাবিতে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে তাই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করতে হবে সঠিক নেতৃত্বের বিষয়টিকে। সেই সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে বিলটি বাতিল করার ও তার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার সর্বাত্মক প্রয়াস এখন থেকেই চালিয়ে যেতে হবে ইজরায়েলের উদারবাদী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে।