শুধু দল বদলে হবে না, রাজনীতি বিচার করা চাই

 

এই নাকি গণতন্ত্রের উৎসব!

কোথায় উৎসব? কোথায় গণতন্ত্র? এ তো গণতন্ত্রের শবযাত্রা! শুধু ভোটের দিনেই ১৮টি প্রাণ বলি হল। পুরো ভোটপর্বে মৃত্যু হল ৪৩ জনের। ফলপ্রকাশ ও বোর্ডগঠন পর্বে আরও কত প্রাণ যাবে, তা কেউ বলতে পারে না। ভোটের সারা দিন ধরে চলল আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ, বুথ দখল, বুথ জ্যাম, ছাপ্পা ভোট, ব্যালট বা’ ছিনতাই। নির্বাচন কমিশনের পাহাড়প্রমাণ নিষ্ক্রিয়তা, পুলিশ-প্রশাসনের চরম দলদাসত্ব, শাসক দলের পরিকল্পিত সন্ত্রাস– সব মিলিয়ে নির্বাচনের নামে একটি প্রহসন হয়ে থাকল ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচন।

এ জিনিস যে হতে চলেছে ভোট ঘোষণার পর থেকেই তা অনুমান করা যাচ্ছিল। কোনও প্রশাসনিক প্রস্তুতি ছাড়াই নির্বাচন কমিশনের আচমকা ভোট ঘোষণা, শুরু থেকেই মনোনয়ন পেশে শাসক দলের বাধা, মনোনয়নপত্র কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলা, মারধর করা, নির্বাচন কমিশনের নির্বিকার মনোভাব, কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইতে গড়িমসি, পুলিশ, প্রশাসনের অসহযোগিতা, রাজ্যপালের অন্তঃসারশূন্য ঢক্কানিনাদ– এই সব কিছুই বলে দিচ্ছিল এবার ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন বা তার আগের নির্বাচনগুলিরই পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে।

অথচ বত্তৃতায় শাসক তৃণমূলের নেতারা বারবার গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ভোটের আশ্বাস দিয়েছিলেন। মনোনয়নে কাউকে বাধা দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা করেছিলেন। সে-সবই যে নিছক কথার কথা ছিল, ভেতরে তাঁরা যে অন্য পরিকল্পনা সাজাচ্ছিলেন, গোটা পর্বে তা স্পষ্ট। কিন্তু রাজ্য সরকারের অজস্র ‘শ্রী’-তে দেদার খয়রাতি, ‘নব জোয়ারের’ ভিড় দেখে নেতাদের মুহূর্মুহূ বিস্মিত হওয়ার পরও শাসক তৃণমূলকে এমন সন্ত্রাসের পথ নিতে হল কেন? তবে কি তাঁরা ভয় পাচ্ছিলেন যে, তাঁদের উঁচু থেকে নিচু তলা পর্যন্ত নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ উঠেছে তাতে তাঁদের বিরুদ্ধে ভোটবাক্সে জনমতের বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে? আর সেই জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্ষমতার দখল নিতেই কি এই সন্ত্রাস, এই দখলদারি?

 এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখিয়ে দিল, সিপিএম আমল থেকে বিরোধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার যে ট্র্যাডিশন শুরু হয়েছে, তা-ই তৃণমূল শাসনে সর্বগ্রাসী হয়ে দেখা দিয়েছে। বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েতের যে সূচনা সিপিএম নেতারা করেছিলেন, যার জন্য বিরোধী প্রার্থীদের হুমকি দেওয়া, মারধর করা, বাড়িতে সাদা থান পাঠানো, ফসল নষ্ট করা, পুকুরে বিষ ঢেলে দেওয়া, ভোটের দিন বুথ জ্যাম, ছাপ্পা, বিরোধী এজেন্টদের বুথ থেকে বের করে দেওয়া, খুন করা– সন্ত্রাস তৈরির সব পদ্ধতিই অনুগত ছাত্রের মতো রপ্ত করে নিয়েছে তৃণমূল। করবে না-ই বা কেন? শাসক তৃণমূলের একটা বড় অংশই তো পূর্বতন শাসক দলের ‘ইলেকশন মেশিনারিতে’ হাত-পাকানো ওস্তাদরা।

বাস্তবিক, গোটা পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্বটিতে জনস্বার্থের দাবিগুলি উপেক্ষিতই থেকে গেল। গ্রামীণ মানুষের ক্ষমতায়নের লক্ষে্য নাকি পঞ্চায়েতের সূচনা হয়েছিল। কোথায় মানুষের ক্ষমতায়ন? প্রাপ্য অধিকার তো বটেই, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাটুকুও আজ শাসকের কবজায়। পঞ্চায়েতগুলি আজ দুর্নীতির এক-একটি আখড়া। যখন যে যেখানে ক্ষমতায় থেকেছে সে-ই দুর্নীতিতে ডুবেছে। দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ টাকা নির্বিচারে আত্মসাৎ করতে এদের কারওরই এতটুকু বাধেনি। নীতিহীন, আদর্শহীন, আত্মসর্বস্ব রাজনীতি আজ পঞ্চায়েতকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। তাই ভোটের প্রচারে তথাকথিত বিরোধীদের মধ্যেও জনস্বার্থের কথা নেই, শাসকের দুর্নীতির বিকল্প কোনও পরিকল্পনা নেই। পরিবর্তে কার দুর্নীতি বেশি, কার দুর্নীতি কম সেই তরজাই প্রধান হয়ে উঠেছে। এর কারণ শাসক-বিরোধী ভোটসর্বস্ব সমস্ত দলগুলির ইতিহাসই কালি মাখানো।

রাজ্যে ‘৭২ সালে কংগ্রেস শাসনে ভোটের নামে প্রহসনের কথা প্রবীণদের এখনও স্মরণে আছে। বামপন্থার ঝান্ডা ওড়ানো সিপিএম শাসনের সন্ত্রাসের কথা মানুষ ভুলতে পারেনি শুধু নয়, একটা বিরাট অংশের মানুষের মনে তা বামপন্থা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করে দিয়েছে। এ বারও কংগ্রেস, বিজেপি, আইএসএফের সঙ্গে ঘোষিত-অঘোষিত নীতিহীন জোট মানুষের মনে তাদের রাজনীতি সম্পর্কে অবিশ্বাসকেই আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ত্রিপুরায় গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএম-তৃণমূলের মতো বিজেপিও বিরোধীদের অংশ নিতেই দেয়নি। রাজ্যের এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাই দেখা গেল, বিরোধীরাও যে যেখানে পেরেছে সেখানেই ছাপ্পা দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই দলগুলির মধ্যে নীতিগত কোনও পার্থক্যই রাজ্যের মানুষ খুঁজে পায়নি।

স্বাভাবিক ভাবেই জনসাধারণের মনে এ প্রশ্ন বারবার ধাক্কা দিচ্ছে যে নির্বাচনের নামে এই নীতিহীন রাজনীতির, সন্ত্রাসের রাজনীতির শেষ কোথায়? একের পর এক নির্বাচন আসবে, সন্ত্রাসের রাজনীতিই কি ক্রমাগত শক্তিশালী হতে থাকবে? দল বদলায়, পতাকার রঙ বদলায়, সন্ত্রাসের রাজনীতি তো কই বদলায় না!

এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে আজ এটা নিঃসংশয়ে বুঝতে হবে যে, তথাকথিত বিরোধী দলগুলি চরিত্রে যেহেতু সবাই কমবেশি একই, সকলেই নীতিহীন, সকলেই দুর্নীতিগ্রস্ত, তাই এই দলগুলির একজনের পরিবর্তে আর একজনকে নির্বাচিত করে এই সন্ত্রাসের রাজনীতিকে পরাস্ত করা যাবে না। ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদ আজ পচে গিয়েছে। চরম নীতিহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সরকারি বা বিরোধী, যে দলই এই দুর্নীতিগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সেবা করবে, তারা নীতিহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত না হয়ে পারে না। তাই নীতিহীনতা, আদর্শহীনতাই আজ এই রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় রাজনীতিতে নীতির চর্চাকে, আদর্শের চর্চাকে শক্তিশালী করা। কিন্তু তা আজ আর এইসব বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া কিংবা বামপন্থার আলখাল্লা গায়ে জড়ানো কোনও দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। তা সম্ভব একমাত্র একটি যথার্থ মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দলের দ্বারা, যে দল দুর্নীতিগ্রস্ত, শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের লক্ষে্য বিরামহীন সংগ্রাম করে চলেছে। ভারতবর্ষে সেই দল একমাত্র এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট), কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় একমাত্র এই দলটিই আজ একমাত্র জনস্বার্থে সংগ্রাম করে চলেছে। এই রাজনীতিই আজ ছাত্র-যুব সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করছে।

নির্বাচন চলে যাবে। অতীতের মতো এবারও নতুন নতুন পঞ্চায়েত বোর্ড গঠিত হবে। আবারও দুর্নীতির স্রোত বইতে থাকবে। পঞ্চায়েত বাবুরা কেউ সাইকেল ছেড়ে বাইক চড়বেন, কারও কুঁড়েঘর জাদুবলে প্রাসাদ বনে যাবে। আরও পিছনে চলে যাবে গ্রামের উন্নয়ন, গ্রামবাসীর জীবিকার সুরক্ষা, দরিদ্র মানুষের আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি। গৃহহীন মানুষের মাথার উপর চালের জোগাড়টুকুর সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হবে। দরিদ্র বিধবা সামান্য ভাতাটুকু থেকে বঞ্চিত হবেন।

মানুষ কাজ খুঁজতে ছুটবেন দূর রাজ্যে। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, অশিক্ষা, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর উদ্বেগ মানুষের উপর আরও জোরে চেপে বসবে। নিরুপায় মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকবে। এই জনস্বার্থহীন রাজনীতির বিকল্প হিসাবেই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) গণআন্দোলনের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ স্পষ্ট দেখিয়েছেন, ভোটে জেতে দল, জনগণ জেতে গণআন্দোলনে। নীতিহীন রাজনীতিকে চিরতরে খতম করতে হলে ভোটসর্বস্ব রাজনীতি বর্জন করে গণআন্দোলনের রাজনীতিকেই শক্তিশালী করতে হবে।