শিবদাস ঘোষের চিন্তাই আমাদের টেনে এনেছে

 

৪ আগস্ট এর বিকেল। কলকাতার পোস্তা-বড়বাজার অঞ্চলের বিনানি ধর্মশালার গেট দিয়ে ঢুকেই দেখা গেল, মধ্যপ্রদেশ এর কিছু কমরেড দুপুরের খাওয়া সারছেন। কিছুক্ষণ আগেই এসে পৌঁছেছেন ওরা। পাশের একটি ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন উত্তরপ্রদেশের কয়েক জন। অনেকে এসেছেন পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকেও। সন্ধ্যের ট্রেনে, রাতের ট্রেনে আসবেন আরও কয়েকশো মানুষ। কলকাতার, রাজ্যের অন্যান্য জেলার স্বেচ্ছাসেবকদের নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই, তারা সর্বক্ষণ ছুটছেন সবকিছুর ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে করার জন্য, অন্য রাজ্য থেকে আসা সাথীদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেদিকে সতর্ক নজর রাখছেন। সব মিলিয়ে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ।

নানা রাজ্যের নানা বয়সের এত মানুষ এই জল-কাদা-বৃষ্টি উজিয়ে এসেছেন, ৫ আগস্ট কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে যাবেন বলে। এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের প্রতিষ্ঠাতা মার্কসবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন তাঁরা। এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল দিল্লিতে, গত বছরের ৫ আগস্ট। এ বছর সমাপনী অনুষ্ঠান হবে কলকাতায়। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েক মাস গোটা দেশ জুড়ে কর্মীরা প্রচারের ঢেউ তুলেছেন, শহর-গ্রাম-প্রান্তর সেজে উঠেছে সংগ্রামী লাল পতাকায়। এই মহান মানুষটির জীবনসংগ্রাম ও চিন্তা ছড়িয়ে গেছে ভারতবর্ষের প্রান্তে-প্রত্যন্তে। সেই উত্তাপ বুকে নিয়েই দেশের ছাব্বিশটি রাজ্য থেকে প্রতিনিধিরা এসেছেন এই আনন্দযজ্ঞে সামিল হতে।

ব্রিগেডে আসার জন্য ট্রেনে উঠছেন কর্মী-সমর্থকরা। ওড়িশার কটক স্টেশন

মধ্যপ্রদেশে শাসক বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়ছেন দলের কর্মীরা। মধ্যপ্রদেশের নেতৃস্থানীয় কমরেড সুনীল গোপাল বললেন, ‘আমরা এই জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে মোট ৪০-৪২টি জেলায় গেছি। কিছু জেলায় আমাদের আগেই কাজ ছিল, এবার নতুন করে যাওয়া হল চব্বিশটি জেলায়। মানুষের থেকে সাড়া পাচ্ছি শুধু নয়, বিজেপি এবং তাদের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র গুন্ডামির বিরুদ্ধে মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ যেটা, ও রাজ্যের বামপন্থী মানুষ আমাদের মধ্যেই আশার আলো, বামপন্থার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন। অন্যান্য বাম দলগুলো এবিভিপি-র সন্ত্রাসের ভয়ে ভীত, তারা লড়াই-আন্দোলনের ময়দানে নেই। মানুষ দেখছে আন্দোলনের ময়দানে এই একটি দলই আছে। বহু বামপন্থী শিক্ষক, অধ্যাপক এবার আমাদের এই অনুষ্ঠানে অর্থসাহায্য করেছেন, চেয়েছেন আমরা সফল হই। কমরেড ঘোষের চিন্তা আমরা যেটুকু নিয়ে যেতে পেরেছি, মানুষ তার দ্বারা খুবই প্রভাবিত হয়েছেন। মানুষ বলেছেন, কমিউনিজম সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। নীতি-আদর্শ ভিত্তিক লড়াই এর কথা, জীবনের রোজকার সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে গণআন্দোলনে সামিল হওয়ার কথা আমাদের এমন করে কেউ বলেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীদের ধারা যে আজ এই দলই বহন করছে, কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার আলোতেই যে আজকের সমাজবিপ্লব সফল হবে, এটা মানুষ বুঝতে শুরু করেছেন। সারা ভারত মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রচনা আগরওয়াল বললেন, আমরা প্রথমে একটু দ্বিধায় ছিলাম যে, রোজকার রুজিরুটির সমস্যা, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি এ সবের বাইরে একজন মার্কসবাদী দার্শনিকের চিন্তাধারা নিয়ে বলতে গেলে সাধারণ মানুষ কতটা শুনবে বা সাড়া দেবে। কিন্তু কাজে নেমে আমাদের সেই ভুল ভেঙে গেছে। এতদূরে আমরা এতজনকে নিয়ে এসেছি এই প্রথম, মধ্যপ্রদেশের ৩৫০ জনেরও বেশি মহিলা যোগ দেবেন কালকের কর্মসূচিতে। বহু নতুন জায়গায় মানুষ আমাদের সাহায্য করেছেন, এখানে অনেক নতুন মানুষ এসেছেন এটা জেনেই যে, পথে কষ্ট হবে, বিশ্রাম কম হবে। কিন্তু সারা ভারত জুড়ে পার্টির এই যে শক্তিবৃদ্ধি, এটাও সবাই দেখতে চায়, কাছ থেকে এর স্পর্শ নিতে চায়।

 

উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার সঙ্গীতা শর্মা শারীরিক প্রতিবন্ধী, চলতে কষ্ট হয়। কিন্তু সে কষ্টকে পরোয়া না করে জনগণের মুক্তিসংগ্রামে সামিল হওয়ার আনন্দ খেলা করে তাঁর চোখেমুখে। পাশে বসা সঙ্গীতার বৌদি বলেন, আসতে তো হবেই আমাদের, শিবদাস ঘোষ আমাদের মতো সাধারণ মেয়েদেরও লড়াই আন্দোলনে নামার কথা বলেছেন। বুঝেছি, বাঁচতে হলে এটাই পথ। ক্লাস টু-এর ছোট্ট অনিকেত শর্মাও এসেছে বাবা, পিসি আর জেঠিমার সাথে। অনিকেতের বাবা রোজ প্রচার থেকে ফিরে ছেলেকে দিনের অভিজ্ঞতা বলতেন, সেই জন্মশতবর্ষ কেমন হবে, দেখতে এসেছে অনিকেত। ঘটনাচক্রে অনিকেতেরও জন্মদিন কাল, ৫ আগস্ট। পিসি সঙ্গীতা তাকে বলেছেন– তোমার এবারের জন্মদিনটা একেবারে অন্যরকম হবে, সারা জীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে।

কর্ণাটকের ধারওয়াড় স্টেশনে ব্রিগেডে আসার জন্য অপেক্ষারত কর্মী-সমর্থকরা

‘আসলে, শিবদাস ঘোষের চিন্তাই এখানে টেনে এনেছে আমাদের। খুব দুঃখ হয় এটাভেবে যে, নিজের চোখে এই মানুষটিকে একবার দেখতে পেলাম না। এই জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে থেকে সেই দুঃখ কিছুটা ভুলতে চাই। আমি পার্টিতে এসেছি যখন, কমরেড নীহার মুখার্জী ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। তাঁকেও সামনে দেখার সুযোগ হয়নি। ৫ আগস্টের এই কর্মসূচিতে না এলে সারাজীবন মনে খেদ থেকে যেত।’– মধ্যপ্রদেশের গুনা থেকে আসা এক মহিলা বলছিলেন তার অনুভূতির কথা। তিনি সরকারি স্বাস্থ্যদপ্তরে কাজ করেন, মেয়ে পড়ে ক্লাস টুতে। মেয়েকে নিয়েই এসেছেন, সাথে ছিলেন প্রৌঢ়া মা-ও। ‘এতটা ট্রেনে আসার ধকল, কাল আবার ব্রিগেড যাবেন, কষ্ট হবে তো?’ বলিরেখা ভরা মুখে একগাল হাসেন তিনি– ‘তা তো হবেই, পায়ে তো ব্যথা। তবে এখানে সবার মধ্যে এসে খুব ভালো লাগছে।’ এ এক অন্য জাতের ভালোলাগা। এই দলের রাজনীতি এমন করে জীবনবোধকে পাল্টে দেয়, এই অন্ধকার সময়ে মর্যাদা নিয়ে বাঁচার পথ দেখায়, সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মন একসূত্রে গাঁথা হয়ে যায় সেই আদর্শের সুতোয়। ভোটসর্বস্ব দলগুলো কোটি কোটি টাকা ঢেলেও এই একসাথে লড়ার আনন্দ, এই কমরেডশিপের নাগাল পায় না।

হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র জেলা থেকে আসা কৃষকরা বললেন, ‘এই ব্রিগেডে পুরো হরিয়ানা থেকে হাজার লোক আসছেন। বিগত কৃষক বিদ্রোহের সময় তেরো মাস আমরা আন্দোলনের ময়দানে ছিলাম। আমাদের এ আই কে কে এম এস এই আন্দোলনে যে ভূমিকা পালন করেছে, তার ফলে বহু নতুন মানুষকে আমরা সাথে পেয়েছি, পার্টির বক্তব্য তাদের মধ্যে নিয়ে গেছি। এখানেও এসেছেন অনেকে।’ পাশে বসেছিলেন যোগীন্দ্র কুমার, মধ্যবয়স্ক হাসিখুশি মানুষ। বললেন, ‘জানেন, আমি অনেক বড় বড় লোকের বই পড়েছি, অনেক ধর্মগুরুর বক্তব্যও পড়েছি। কিন্তু শিবদাস ঘোষের বই পড়ে যে আনন্দ পেলাম, যেভাবে পথ খুঁজে পেলাম, এমনটা আর কোথাও পাইনি। গত বছর ৫ আগস্ট দিল্লির অনুষ্ঠানে গেছিলাম, সেই আমার প্রথম দিল্লি যাওয়া। কলকাতাতেও জীবনে এই প্রথম এলাম, ৫ আগস্ট দেখব বলেই।’

সুন্দরবনের গোসাবা থেকে জলপথে ব্রিগেডের দিকে কর্মীরা

‘আন্দোলনের সংবাদ’-এর এক প্রতিনিধি এসেছেন গীতাঞ্জলি স্টেডিয়াম হয়ে, বললেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। কসবার এই স্টেডিয়ামে বিহার থেকে প্রতিনিধিরা এসেছেন, আর এসেছেন কিশোর সংগঠন কমসোমল-এর সদস্যরা। বিহারের মজফফরপুর জেলার থেকে স্পেশাল ট্রেন আসার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করেছে রেল। তবু তাদের আসতেই হবে। তাই ২ তারিখের মধ্যেই পৌঁছে গেছেন। বহু মহিলাও এসেছেন। এতগুলো দিন ঘরছাড়া, অসুবিধা হবে না? নির্দ্বিধায় উত্তর দিচ্ছেন– হবে, কিন্তু তার জন্য কি ঘরে বসে থাকতে হবে? এসেছেন মিড ডে মিল কর্মী, আশা কর্মীরাও। কাজ চলে যেতে পারে জেনেও এসেছেন ক্যাজুয়াল কর্মীরা। দলটা তাঁদের নাড়িতে মিশে– পিছুটানের সাধ্য কী ঘরে রাখার!

দেখা হল পাঞ্জাবের এক দল যুবকের সাথে, যুব সংগঠন এআইডিওয়াইও-র সদস্য তারা। তাদেরই একজন, অখিলেশ বললেন, ‘পাঞ্জাবে আমাদের সংগঠন ছোট, কোনও প্রচারও নেই। কিন্তু যেখানেই কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা নিয়ে গেছি, সাড়া পেয়েছি। মানুষ বলেছেন, এই প্রথম কোনও দল দেখলাম যারা বলছে, ভোট দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না আন্দোলনের মাধ্যমে হবে। যারা ভগৎ সিং এর চর্চা করার কথা বলছে। কমিউনিস্টরা যে এমন হয়, আমরা জানতাম না। আমরা মানুষকে বলেছি, যথার্থ কমিউনিস্টরা এমনই হয়। তবে এই কাজ আরও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদের।

আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ

সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে, কর্মব্যস্ত কলকাতার রাজপথ ভিজছে অবিরত বৃষ্টিতে। তার মাঝেই শহর জুড়ে বইছে এক অন্য আলোর স্রোত, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ জড়ো হয়েছেন এক মহান মার্কসবাদী দার্শনিকের চিন্তার আকর্ষণে, তাঁর হাতে গড়া দলের ব্রিগেড সমাবেশে যাবেন বলে। শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, আমি লড়তে লড়তে মরব, মরতে মরতে লড়ব। আমার কথার মধ্যে যদি সত্য থাকে, ইতিহাস একদিন তার মূল্য দেবে। আজ শিবদাস ঘোষ নামটি ভারতবর্ষের মুক্তিকামী মানুষের কাছে বিপ্লবের মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আগামীকাল, ৫ আগস্ট লাল পতাকায় মোড়া ব্রিগেড দেখবে সংগ্রামী বামপন্থার নতুন সূর্যোদয়, লেখা হবে গণ-আন্দোলনের এক নতুন ইতিহাস।