রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে স্বার্থ জড়িয়ে সব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির

অল ইন্ডিয়া অ্যান্টি ইম্পিরিয়ালিস্ট ফোরামের (এআইএআইএফ) সহসভাপতি মানিক মুখার্জী ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় ৭ অক্টোবর এক বিবৃতিতে বলেন, ইউক্রেনের মাটিতে আজ যে বিধবংসী যুদ্ধ চলছে তার শুরু রাশিয়ার আগ্রাসী আক্রমণের মধ্য দিয়ে। এই যুদ্ধটা আসলে দুই সাম্রাজ্যবাদী সুপার পাওয়ার রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার লড়াইয়ের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। কোভিড-১৯ মহামারীর বিপর্যয়ের ক্ষত থেকে মানবজাতির মুক্তিলাভের আগেই শুরু হয়েছে এই যুদ্ধ। দেখতে দেখতে তা ৯ মাসের বেশি সময় অতিক্রম করেছে। সীমাহীন ধবংসলীলা চলছেই।

এই ধবংসের থেকে একটু স্বস্তি দিতে পারে, এমন কোনও কিছুর চিহ্ন চোখে পড়ছে না। যুযুধান দুই দেশের পক্ষে গ্রহণযোগ্য সমাধানের রাস্তা বার করতে কোনও আলোচনার সামান্য আশার রেখাটুকুও দেখা যাচ্ছে না। বরং যুদ্ধের গতি বেড়েই চলেছে।

একের পর এক দেশ ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহকারী দলে নাম লেখাচ্ছে। আমেরিকার নির্দেশে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি রাশিয়ার উপর একের পর এক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে চলেছে। অন্য দিকে রাশিয়া অল্প কিছু দেশের সমর্থন পাচ্ছে। চিন রাশিয়ার বিরুদ্ধতা করেনি। ভারত নিজ দেশের একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের স্বার্থে আপাত নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে চলছে। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে চিন এবং পাকিস্তানের সাথে মিলে ভারত রাষ্ট্রসঙ্ঘে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবের উপর ভোট দানে বিরত থেকেছে। নিরাপত্তা পরিষদেও ভারত ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থেকেছে।

সংবাদমাধ্যমের প্রচার থেকে অনেকে আশা করেছিলেন, উজবেকিস্তানের সমরখন্দে ১৫ এবং ১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশনের শীর্ষনেতাদের বৈঠক যুদ্ধ বন্ধের কাজে সাহায্য করবে। কিন্তু সেই বৈঠকে ভারত সহ কোনও দেশই সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবি তোলেনি। এ বিষয়ে ভারতের মন্তব্যটি ছিল একেবারেই দায়সারা। বরং দেখা যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির এই শীর্ষ বৈঠকের পর রাশিয়া ইউক্রেনে বোমাবর্ষণের তীব্রতা বাড়িয়েছে। আগের থেকে বেশি সংখ্যায় সাধারণ নাগরিক যুদ্ধে প্রাণ হারাচ্ছেন।

এমনকি তারা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিও দিচ্ছে। সম্প্রতি তারা ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা করেছে। এআইএআইএফ রাশিয়ার এই আগ্রাসী ভূমিকার তীব্র নিন্দা করছে। বাস্তব হচ্ছে, এই চলমান যুদ্ধের পিছনে প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরই স্বার্থ কাজ করছে।

সংকুচিত ও গভীর সংকটে দীর্ণ বিশ্ববাজারকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের যে তীব্র কাড়াকাড়ি চলছে, এই আগ্রাসী যুদ্ধ তারই ফল। যুদ্ধবাজ দেশগুলি যুদ্ধের জন্য যে আশু কারণ বা অজুহাতই দেখাক, এগুলো সবই তাদের আসল চেহারা এবং মতলব আড়াল করার ধূর্ত প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। পৃথিবীর সব প্রান্তে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গায়ে হানাদার এবং নানা দেশের উপর অন্যায় দখলদারির ঘৃণ্য তকমা লেগে আছে। এ দাগ মোছার নয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মোকাবিলা করার অজুহাতে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীদের জোট হিসাবে ন্যাটোর সৃষ্টি। তারা এখন হিংস্র শক্তি হিসাবে উঠে এসেছে এবং একের পর এক দেশে সামরিক হামলা চালাচ্ছে। সমাজতন্ত্র ধবংসকারী প্রতিবিপ্লবের পর রাশিয়া আজ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত নিয়মের কারণেই তীব্র বাজার সংকট থেকে তার রেহাই মেলেনি।

এই সংকটের মোকাবিলা করতে বিশ্ববাজারের বড় অংশের ভাগ পাওয়ার জন্য রাশিয়াকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ন্যাটোর সঙ্গে বাজার দখলের লড়াইতে নামতে হয়েছে। ফলে ১৯৯০-এর পর থেকে বিশ্বে একটা নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যার একপক্ষে রাশিয়া-চিন, অপরপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কখনও তা ছোটখাট বিবাদ কখনও বড় যুদ্ধে ফেটে পড়ে।

পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বাঁচার জন্য ক্রমাগত যুদ্ধ বাধানো এবং যুদ্ধ উন্মাদনা তৈরি করা ছাড়া আর রাস্তা নেই। কারণ অর্থনীতির সামরিকীকরণের মধ্য দিয়ে বাজারে কৃত্রিম তেজিভাব সৃষ্টি করতে না পারলে তার জং ধরা উৎপাদনব্যবস্থার চাকাটাকে গড়ানো যাবে না। এতে লাভবান হয় সব দেশের ধনকুবের, সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিপতি এবং যুদ্ধব্যবসায়ীরা। অন্য দিকে সব স্তরের জনসাধারণের দুর্দশা চরমে ওঠে। জীবন, জীবিকা, আশ্রয়, খাদ্য সহ সমস্ত কিছু হারিয়ে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধবস্ত দেশের জনগণ আজ চরম দুর্দশার গ্রাসে। এবার পালা ইউক্রেনের। এটাই শেষ নয়। ধনকুবেরদের সিন্দুক যত ভরে উঠছে, ততই সব পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশের সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। পুঁজিবাদের সংকট নিরসনে বাধানো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের জন্য সাধারণ মানুষ কেন এত মূল্য দেবে?

বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ হিসাবে আজ আমাদের সকলের কর্তব্য যুদ্ধ বন্ধ করার দাবি নিয়ে সোচ্চার হওয়া। রাশিয়ার আগ্রাসন এবং ন্যাটো-মার্কিন উস্কানির অবসান চেয়ে দাবি তোলা আজ কর্তব্য। সাম্রাজ্যবাদীদের সমস্তরকমের যুদ্ধ প্রচেষ্টার আমরা দৃঢ় বিরুদ্ধতা করছি। আসুন অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করা ও ন্যাটো ভেঙে দেওয়ার দাবিতে আমরা সকলে সোচ্চার হই।