ভোট-রাজনীতির পাঁকে ভারতরত্ন

একেবারে পাইকারি হারে। হ্যাঁ, ভারতরত্ন খেতাবের কথাই বলছি।

মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দু-দফায় পাঁচজনকে দেওয়া হল এই খেতাব। লালকৃষ্ণ আদবানি, নরসিমা রাও, চৌধরী চরণ সিং, কর্পূরী ঠাকুর এবং এম এস স্বামীনাথন। এর মধ্যে তিনজনকে দেওয়া হয়েছে মরণোত্তর।

একটা দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান যে এমন হারে দেওয়া যেতে পারে, সম্মানটিকে এমন করে সঙ্কীর্ণ রাজনীতির বিষয় করে তোলা যেতে পারে এবং জনমানসে তার মর্যাদাকে এমন করে ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়া যেতে পারে তা বোধহয় নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী না হলে বোঝা যেত না। কোনও শাসক যখন এমন একটি খেতাবকে ক্ষমতার হাতিয়ার করে নেন, তখনই একমাত্র এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটাতে পারেন। তখন আর চক্ষুলজ্জাটুকুও অবশিষ্ট থাকে না।

ভারতরত্নের মতো দেশের সর্বোচ্চ সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা কী হতে পারে? সাধারণ ভাবে যিনি সমাজের জন্য, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণের জন্য এমন বিশেষ কিছু করেছেন যা বিরল, যা সমাজকে, সভ্যতাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। অর্থাৎ যাঁকে এই সম্মান দেওয়া হবে তাতে তিনি যেমন সম্মানিত হবেন, ঠিক তেমনই দেশের মানুষও তাঁকে এই সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে নিজেদের সম্মানিত মনে করবেন। এই নিরিখেই কি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই পাঁচজনকে ভারতরত্নে সম্মানিত করল?

বিজেপির মার্গদর্শকমণ্ডলীর অন্যতম লালকৃষ্ণ আদবানির কথাই ধরা যাক। তাঁকে যে ভারতরত্ন দেওয়া হল, তা দেশ ও সমাজের প্রতি তাঁর কোন কল্যাণকর কাজের জন্য? না, তেমন কোনও যোগ্যতার কথা সরকার বা বিজেপি নেতারা বলতে পারেননি। তা হলে তাঁকে তা দেওয়া হল কেন?

অনেকেরই মনে আছে, কংগ্রেস নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উদ্যোগে টিভিতে রামায়ণ-মহাভারত দেখানো শুরু হলে দেশ জুড়ে বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে হিন্দুত্বের আবেগ তৈরি হয়। এই আবেগকে কংগ্রেস হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে আত্মসাৎ করতে পারে, এক দিকে এই আশঙ্কা, অন্য দিকে ভিপি সিংয়ের মণ্ডল রাজনীতি যে ভাবে রাজ্যে রাজ্যে জাতপাতের রাজনীতি চাগিয়ে তোলে তার পাল্টা, জাতপাত নির্বিশেষে গোটা হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে এককাট্টা করতে আদবানি নেমে পড়েন রামজন্মভূমি আন্দোলনে এবং শুরু করেন রথযাত্রা। পরিণতিতে যেমন দেশের নানা জায়গায় দাঙ্গা বাধে, তেমনই বিজেপি-আরএসএস দুষ্কৃতী বাহিনী পাঁচশো বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। তার অভিঘাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক দিনের মধ্যে হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ যায়। এই গোটা কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ভিতটিই নড়ে ওঠে। মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক প্রতিপন্ন করে দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদের যে ঢেউ ওঠে তাতে চড়েই ক্ষমতার গদিতে পৌঁছে যান বিজেপি নেতারা। আবার ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজি এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে উদারিকরণের নামে বেপরোয়া ভাবে বেসরকারিকরণের খাঁড়া নামিয়ে আনে দেশের শ্রমজীবী মানুষের উপর। সম্প্রতি সেই বাবরি মসজিদের জায়গাতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রামমন্দিরের উদ্বোধন করে হিন্দু-মসীহা সাজলেন। এই সার্বিক সাফল্যের স্বীকৃতি হিসাবেই রামজন্মভূমি আন্দোলন ও রথযাত্রার প্রাণপুরুষ লালকৃষ্ণ আদবানির ভারতরত্ন খেতাব। এই খেতাবের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের, কল্যাণের, জীবনমানের অগ্রগতির কী সম্পর্ক?

বিস্মৃতপ্রায় কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওকে কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে ভারতরত্ন দিলেন প্রধানমন্ত্রী? নরসিমা রাওই নেহেরু পরিবারের বাইরে প্রথম কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী। নানা কারণে নেহেরু পরিবারের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব আজ সকলের জানা। সেই দূরত্বকে দক্ষিণী এই নেতার প্রতি কংগ্রেসের অবহেলার ফল হিসাবে দেখিয়ে দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত তেলঙ্গানায় বিজেপির প্রভাব বাড়াতেই যে এই পুরস্কার, তা বুঝতে কারও বাকি নেই। দেখা যাক, নরসিমা রাওয়ের কৃতিত্বগুলির কোনও একটিও তাঁকে ভারতরত্নে উত্তীর্ণ করতে পারে কি না।

ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর দিল্লিতে ১৯৮৪-র শিখ বিরোধী দাঙ্গায় প্রায় তিন হাজার শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষ নিহত হন। সেই সময়ে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন নরসিমা রাও। দাঙ্গার সময়ে দিল্লি পুলিশ যে তা থামানোর কোনও চেষ্টা না করে হাত গুটিয়ে বসেছিল, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই বলে সেই সময়ে নানা মহল থেকে অভিযোগ উঠেছিল। রাওয়ের কৃতিত্বের মুকুটে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পালকটি তাঁর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও চাইলেই সেদিন পুলিশ দিয়ে, সেনা নামিয়ে বিজেপি-আরএসএস দুষ্কৃতীদের বাবরি মসজিদ ভাঙা আটকাতে পারতেন। কিন্তু এ বারও তিনি হাত গুটিয়ে বসে থেকে এ যুগের সবচেয়ে লজ্জাজনক কাজটি ঘটতে সাহায্যই করেছিলেন।

দুর্নীতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাকি জিরো টলারেন্স! তিনি নাকি দুর্নীতি দেখতেই পারেন না! তাঁর ঘনিষ্ঠ ধনকুবের গৌতম আদানিদের দুর্নীতি হয়তো কোনও কারণে তাঁর চোখে পড়ে না। কিন্তু নরসিমা রাওয়ের দুর্নীতিগুলি নরেন্দ্র মোদির চোখ এড়িয়ে গেল কী করে! কুখ্যাত গডম্যান চন্দ্রস্বামীর সঙ্গে নরসিমা রাওয়ের ঘনিষ্ঠতা, হর্ষদ মেহতার দাবি মতো তাঁর থেকে ১ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ, হাওলা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর তিন বছরের জেল হওয়ার মতো ঘটনাগুলিকে নরেন্দ্র মোদি কোন সুনীতি ঠাওরে তাঁকে দেশের ‘রত্ন’ বলে ঘোষণা করে দিলেন?

সব মিলিয়ে কংগ্রেসের উপর চাপ তৈরি করা এবং দক্ষিণ ভারতে বিজেপিকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা ছাড়া এই ভারতরত্নের আর কোনও কার্যকারিতা অন্তত দেশের শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের কাছে নেই। বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুর প্রায় বিস্মৃতিতে চলে গিয়েছিলেন। মণ্ডল আন্দোলনেরও আগে বিহারের অনগ্রসরদের জন্য সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করেছিলেন তিনি। আজ যখন বিহার সরকারের পক্ষ থেকে জাতগণনা করে নতুন করে জাতভিত্তিক সংরক্ষণের দাবি উঠেছে, ভোটরাজনীতিতে তাতেই খানিক কোণঠাসা হয়ে ওবিসি ভোট নিজেদের দিকে টানতে কর্পূরী ঠাকুরের শরণাপন্ন হল বিজেপি। ঠিক যেমন বিস্মৃতপ্রায় কৃষকনেতা চৌধরী চরণ সিংকে ভারতরত্ন দেওয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ২৯টি লোকসভার আসনের এলাকার জাঠ ভোট নিজেদের দিকে টানতে চেয়েছে। বিজেপি সরকারের কৃষিনীতি জাঠ ভোটে ফাটল ধরিয়েছে। সেই ভোট এনডিএ-তে টেনে আনতে চরণ সিংয়ের নাতি রাষ্ট্রীয় লোকদলের নেতা জয়ন্ত চৌধরীকে এনডিএ-তে যোগ দেওয়ানোটা বিজেপির পক্ষে জরুরি ছিল। পুরস্কার ঘোষণার পরই জয়ন্ত চৌধরীর এনডিএ-তে যোগ দেওয়াতে খেতাবের পিছনের ছকটা স্পষ্ট হয়ে গেল।

আজ যখন দেশের, বিশেষত উত্তর ভারতের কৃষকরা নতুন করে এমএসপি সহ নানা দাবিতে আবার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, কৃষি-বিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথনকে ভারতরত্ন দিতে সে সময়টিকেই বেছে নিল বিজেপি সরকার। কৃষিতে স্বামীনাথনের ভূমিকাকে সম্মান জানানোই যদি এই পুরস্কারের উদ্দেশ্য হত তবে দেশের পঞ্চাশ ভাগ মানুষ যে কৃষক সম্প্রদায়, যাদের কঠোর পরিশ্রমেই গোটা জাতির খাদ্যের জোগান অব্যাহত থাকে, তাদের জন্য কৃষির মোট খরচের দেড়গুণ হিসাবে ফসলের দাম নির্ধারণের যে সুপারিশ স্বামীনাথন করেছিলেন তাকে বিজেপি সরকার এ ভাবে অগ্রাহ্য করতে পারত না। পুরস্কার ঘোষণার পরেও স্বামীনাথনের কন্যা কৃষক আন্দোলনে বিজেপি সরকারের দমন-পীড়নের তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, কৃষকদের প্রতি সরকার অপরাধীর মতো ব্যবহার করছে, যা উচিত নয়। কৃষকদের দাবি মেনে নেওয়াই স্বামীনাথনের প্রতি সরকারের উচিত সম্মানপ্রদর্শন হত বলে কৃষকদের মতো দেশের বাকি মানুষেরাও মনে করেন।

ভারতরত্নের এই পাইকারি হার দেখে রাজ ঠাকরে সঞ্জয় রাউতরা বাল ঠাকরেকে এবং মায়াবতী দলিত রাজনীতির সূচনাকার কাঁসিরামকে ভারতরত্ন দেওয়ার দাবি তুলেছেন। তা হলে আর নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহরাই বা বাদ থেকে যান কেন! গুজরাট দাঙ্গা যদি এই দুজনের মুকুটের একটি উজ্জ্বল পালক হয় তবে হিন্দুত্ববাদী জিগির তোলার সাফল্য ছাড়াও আদানিদের হাতে সমস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও শিল্পকারখানা তুলে দেওয়ার যোগ্যতাও তো এই প্রতিযোগিতায় অন্য এক পালক হিসাবে বিবেচিত হতেই পারে। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটে নিজের নামে স্টেডিয়ামের নামকরণ করেছেন। ভারতরত্নটিই বা কে কবে তাঁকে দেবে তেমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উপর ফেলে রাখার কোনও মানে হয় কি!

দেশের সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে এই নোংরা খেলা দেখে অবশ্য সাধারণ মানুষ ধিক্কারই জানাচ্ছেন শাসকদের।