ভুয়ো সংঘর্ষের তদন্তে বিজেপির এত ভয় কেন

 

ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা করেছে গুজরাটের বিজেপি সরকারের পুলিশ৷ দেখিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা বিচারপতি বেদি কমিটির রিপোর্ট৷ এই রিপোর্টকে আটকাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷

ময়নাতদন্ত বলছে সোহরাবুদ্দিন সেখ এবং তাঁর স্ত্রীকে গুলি করে খুন করা হয়েছিল৷ খুন হয়েছিলেন তঁদের সঙ্গী তুলসীরাম প্রজাপতিও৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই সেই খুনিকে খুঁজেই পেল না তারা কোনও রকম সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করতে না পারায় অবশেষে অভিযুক্ত সকলেই বেকসুর খালাস পেয়ে গেল৷ নিহত সোহরাবুদ্দিনের পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বিচারপতি শর্মা৷ বিচারকের এই অসহায়তাই বলে দেয় বিজেপির গণতন্ত্রের স্বরূপ কী৷ বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে গুজরাটে ২০০২ সালে তাদের অপকীর্তি ঢাকার যে চেষ্টা সিবিআই সহ কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলি করে চলেছে তার নির্লজ্জ উদাহরণ এই ঘটনা৷ ২০১৪ তে বিজেপি কেন্দ্রে সরকারে বসতেই এই মামলায় অভিযুক্ত গুজরাটের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহ ১৬ জনকে সিবিআই বেকসুর রেহাই দেয়৷ ২০০২–২০০৬ সালে গুজরাটে মোদি জমানায় এরকম সাজানো খুনের ঘটনা ঘটেছিল অজস্র৷ যেখানে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের যুবক–যুবতীদের টার্গেট করে পুলিশ ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে৷ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পুলিশের অভিযোগ ছিল নিহতরা সন্ত্রাসবাদী এবং তারা নাকি মোদিকে হত্যার ছক কষেছিল৷ যদিও একটি ক্ষেত্রেও নিহতদের অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি সিবিআই৷

কংগ্রেস আমলেই ’৮০–র দশকে পাঞ্জাবে, আসামে, মহারাষ্ট্র সহ উত্তর–পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এনকাউন্টার পুলিশের কাছে প্রায় জলভাত হয়ে দাঁড়ায়৷ ‘ফার্স্টপোস্ট’ নামে একটি সংবাদসংস্থার আর টি আই–এর উত্তরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জানায় ২০০০ থেকে ২০১৭–য় ১,৭৮২টি ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনা নথিভুক্ত হয়৷ উত্তরপ্রদেশে সর্বাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে৷ বর্তমানে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের আমলে পুলিশ শুধু ভুয়ো সংঘর্ষ ঘটাচ্ছে তাই নয়,  মুখ্যমন্ত্রী নিজে এ কথা বুক বাজিয়ে ঘোষণা করছেন৷ শাসক দলের প্রয়োজনে যেমন পুলিশ এই ভুয়ো সংঘর্ষ ঘটায়, তেমনই পুলিশ অফিসাররাও ঘুষ, প্রচার ও পদোন্নতির মতো ব্যক্তিগত স্বার্থে ভুয়ো সংঘর্ষের মাধ্যমে হত্যা করে৷ গুজরাট–উত্তরপ্রদেশ-হরিয়ানার মতো রাজ্যে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার সাজানো অভিযোগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু জনগণকে টার্গেট করা হয় এমন অভিযোগকে সমর্থন করছে সরকারি এবং আন্তর্জাতিক রিপোর্টও৷ দিন কয়েক আগেই দিল্লি–উত্তরপ্রদেশে অস্ত্রশস্ত্র সহ বেশ কিছু স্থানীয় দুষ্কৃতীকে ধরে পুলিশ৷ সন্ত্রাসবাদী চক্র ধরার রোহমর্ষক গল্প সাজানো হয়৷ পরে জানা যায়, রকেট লঞ্চার দূরে থাক, ছিল কিছু ট্রাক্টরের ভাঙা অংশ ও কিছু দেশি বন্দুক৷ অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও সন্ত্রাসের অভিযোগ সাজানো৷ যে কোনও ফোন–কম্পিউটারে আড়ি পাতার অবাধ অধিকার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার অজুহাত তৈরি করতেই এই রকম সাজানো ‘সন্ত্রাসবাদী’ আবিষ্কার বলেই সন্দেহ মানুষের৷

বলা বাহুল্য টাডা, পোটা,  ইউ এ পি এ–র মতো কালা আইনগুলি পুলিশকে অগণতান্ত্রিকভাবে কিছু ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে৷ কংগ্রেস আমলেই যে আইনগুলি বলবৎ হয়েছিল এখন বিজেপি তাকে ব্যবহার করছে৷

ভুয়ো সংঘর্ষে সরকার যে কতটা দোষী তা বোঝা যায়, এই বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্ট আটকানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে৷ ২০০২–২০০৬–এর মধ্যে গুজরাটে এ রকমই আরও ২২টি ভুয়ো তথা সাজানো সংঘর্ষ নিয়ে সিবিআই অথবা সিট তদন্তের আর্জি জানিয়ে ২০০৭–এ সুপ্রিম কোর্টে  জনস্বার্থ মামলা করেন প্রবীণ সাংবাদিক বিজি ভার্গিস ও গীতিকার জাভেদ আখতার৷ তারই প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া বিচারবিভাগীয় কমিটি ২০১৮–র গোড়ায় তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়৷ সেই তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশের দাবিতে সম্প্রতি আদালতের দ্বারস্থ হন উক্ত মামলাকারীদ্বয়ের আইনজীবীরা৷ সঙ্গে সঙ্গে সেই তদন্ত রিপোর্ট আটকাতে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল ও মোদি জমানার গুজরাট সরকারের আইনজীবী তুষার মেহতা৷ অর্থাৎ সরকারই মেনে নিচ্ছে, তারা ইচ্ছামতো খুন করেছে সংঘর্ষের নামে৷

ভুয়ো সংঘর্ষের জন্য দোষী নেতা–মন্ত্রী ও পুলিশ অফিসারদের আড়াল করতে সরকারি তৎপরতা দেখে বোঝা যায় ষড়যন্ত্রের জাল কতটা গভীর ও ব্যাপক৷ অবশ্য এমন আশঙ্কা অমূলক নয় যে, এরপর শোনা যাবে সিবিআই তদন্তে দেখা গেছে মোদির শাসনাধীনে গুজরাটে আদৌ কোনও ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেইনি৷ এ দেশে ক্রমশ তাৎপর্য হারাচ্ছে ‘প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা’, ‘আইন ও ন্যায়ের শাসনে’র মতো গালভরা কথাগুলি৷ সোহরাবুদ্দিন খুনের মামলার বিচারপতি শর্মাকে এ দেশে অসহায়ত্বের কথা বলে আফশোস করতে হয়, রহস্যজনকভাবে খুন হতে হয় এই খুনের মামলার আরেক বিচারপতি লোয়াকে৷ বুঝতে অসুবিধা হয় না, গণতন্ত্র–ন্যায়বিচার এসবই আজ প্রহসন মাত্র৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২৩ সংখ্যা)