‘বাস্তব জীবনের কঠিন চাপে পড়ে আমি কিছু করতে পারি না’– এ নিজের দুর্বলতাকে ভদ্রভাষায় আড়ালের চেষ্টা মাত্র — শিবদাস ঘোষ

যেগুলোকে আপনারা বলেন, ‘‘বাস্তব জীবনের চাপ, সমাজজীবনের বাস্তবতা”। অথবা আপনি যখন বলেন, ‘‘বাস্তব জীবনের চাপে পড়ে আমি কিছু করতে পারি না”, তখন সে কথার অর্থ কী? আসলে এ কথার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রাম– প্রতিফলিত হচ্ছে শ্রমিক আন্দোলনের উপর বুর্জোয়া চিন্তা-ভাবনা ও আদর্শের আক্রমণ। ‘বাস্তব জীবনের কঠিন চাপে পড়ে আমি কিছু করতে পারি না’– এটা আসলে নিজের দুর্বলতাকে ভদ্র ভাষায় আড়াল করার প্রচেষ্টা মাত্র। আসলে, বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের উপর বুর্জোয়াশ্রেণির চক্রান্ত ও আক্রমণের অন্যতম রূপ হল, আপনার উপর এরূপ বাস্তব জীবনের চাপ সৃষ্টি করা, যার ফলে আপনি পঙ্গু হয়ে যাবেন, মানসিক শক্তি ও পরিশ্রম করবার শক্তি হারাবেন।

তা হলে আপনি ‘বাস্তব জীবনের চাপ’– এ কথা বলছেন কেন? আপনার স্বীকার করা উচিত যে, আপনি বুর্জোয়াদের এ জাতীয় আক্রমণ সম্পর্কে অবিদিত ছিলেন এবং একে প্রতিরোধ করার কথা ভাবেনইনি। আসলে বুর্জোয়াদের চক্রান্ত, তাদের ক্ষয়িষ্ণু চিন্তাধারা ও আদর্শ আপনার উপরে কাজ করছে। আপনি যদি সতর্ক থাকতেন, তা হলে বুঝতে সক্ষম হতেন যে, তাদের চক্রান্তেরই একটা দিক হল আপনাকে দুর্বল করা। আমরা অনেক বড় বড় বিষয় বুঝি, কিন্তু দুঃখের কথা হল, এই সোজা ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারি না। এটাই প্রমাণ করে, আমরা কী রকম উপর উপর বুঝি। … শুধু বই পড়ে মা’র্বাদ বোঝা যায় না বা এই বিজ্ঞানকে উপলব্ধি করা যায় না। একমাত্র তখনই আপনি মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ ঠিক ঠিক বুঝতে পারবেন, যখন আপনি জীবনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রস ও আবেগের সঙ্গে মিলিয়ে একে গ্রহণ করবেন এবং রক্ত-মাংসের সঙ্গে একে মেশাতে পারবেন।

আমাদের বোঝা উচিত, যে জিনিসগুলো আমাদের মানসিক কাঠামোর মধ্যে উদয় হচ্ছে, সেগুলো হয় শ্রমিক আন্দোলন, আর নয় তো বুর্জোয়া আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত। এই সহজ বিষয়টা আমাদের গোলমাল হয়ে যায় কেন? যখন কারও ভেতরে এরূপ মানসিকতা দেখা যায় যে, সে সবসময় হতাশা অনুভব করে এবং জীবনে কোনও কিছুর ভেতরেই কোনও উৎসাহ পায় না– তখন সে কি বোঝে যে, এই মানসিকতা তার উপর বুর্জোয়া আদর্শেরই প্রভাবের ফল এবং তা সর্বশেষ বিচারে বুর্জোয়া শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করে না? ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়া আদর্শই এ ধরনের অনীহা, নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার জন্ম দেয়। কারণ, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে কোনও চিন্তা-ভাবনা বা আদর্শই শ্রেণি উদ্দেশ্য, শ্রেণি স্বার্থবোধ থেকে মুক্ত হতে পারে না। শ্রেণি-চিন্তার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে, এরূপ কোনও মানসিকতা সমাজে থাকতে পারে কি?

‘কমিউনিস্ট চরিত্র গড়ে তোলার সংগ্রামের কয়েকটি দিক’ শিবদাস ঘোষ নির্বাচিত রচনাবলি, পঞ্চম খণ্ড