পুঁজিপতি শ্রেণিই তাদের স্বার্থরক্ষাকারী দলগুলির ভোটের খরচ জোগায়

চলতি বছরে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মণিপুর, গোয়া এবং পাঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য ২২৩.১৪ কোটি টাকা খরচ করেছে বিজেপি। অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস-এর (এডিআর) একটি রিপোর্টে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই সমস্ত রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারের জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিজেপি সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কংগ্রেস। ১০২.৬৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে তারা।

ভোটের সময় বিজেপি-কংগ্রেসের মতো দলগুলি এই যে দেদার টাকা খরচ করে, বিজ্ঞাপনে আকাশ অন্ধকার করে দেয়, প্রচারে কান ঝালাপালা করে দেয়, মোবাইল খুললে হোয়াটসঅ্যাপে স্রোতের মতো মেসেজ ঢুকতে থাকে, তার একটা ভগ্নাংশ মাত্রই খরচের এই ঘোষিত অঙ্ক। এই দলগুলি ভোটে যে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে তার বিরাট একটা অংশ কালো টাকা, যার হিসাব দলগুলি নির্বাচন কমিশনকে দেয় না।

এই টাকাতেই তারা খবরের কাগজ, টেলিভিশন, রেডিও, মোবাইলে বিজ্ঞাপন দিয়ে দিয়ে মানুষের সুপ্ত আকাঙক্ষাকে ভার্চুয়াল সত্যে পরিণত করে। মিথ্যা প্রতিশ্রুতিগুলি অবিরাম এমন করে প্রচার করতে থাকে যাতে মানুষও বার বার দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে এক সময় ভেবে বসে, এ বোধ হয় সত্যি।

এই বিপুল পরিমাণ টাকা, যা এই দলগুলি ভোটে খরচ করে, তা আসে কোথা থেকে? ভোটের প্রচারের জন্য তারা কি জনগণের থেকে চাঁদা নেয়? বড় বড় দলগুলি কেউই জনগণকে টাকা চেয়ে ‘বিরক্ত’ করে না। উপরন্তু তাদের ভোট দিলে দল কী কী দেবে তার লম্বা ফিরিস্তি দেয়। কিছু কিছু ‘উপহার’ আগাম হাতে হাতেও মিলে যায়। তা হলে তারা এই টাকা পায় কোথা থেকে?

পায় শিল্পপতি-পুঁজিপতি-ব্যবসায়ীদের থেকে। কিন্তু তারা কেন এদের টাকা দেয়? দেয়, কারণ এই সব দলগুলি ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসার পর এদেরই ব্যক্তিগত, শ্রেণিগত দাবিগুলিকে কার্যকর করে। যেমন, শিল্পপতি-পুঁজিপতিদের ট্যাক্স কমিয়ে দেয়, তাদের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করে দেয়, সরকারি সম্পদ, সম্পত্তি, শিল্প, সংস্থা–সব জলের দামে, বিনা দামে তাদের হাতে তুলে দেয়। সরকারি টেন্ডার, অর্ডারগুলি পাইয়ে দেয়।

উল্টোদিকে, সাধারণ মানুষকে এই দলগুলি যে প্রতিশ্রুতি দেয় তার কোনওটিই তারা রক্ষা করে না। যেমন, সবচেয়ে উঁচু গলায় যে দাবি তারা করে তা হল, জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি রোধ করবে, বেকারদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে, দুর্নীতি বন্ধ করবে, জনগণের উপর চাপানো কর কমিয়ে দেবে–এমনই আরও সব। বাস্তবে এই সব প্রতিশ্রুতির কোনওটিই তারা রক্ষা করে না শুধু নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে একেবারে উল্টো আচরণ করে। যেমন জিনিসের দাম কমানোর কোনও চেষ্টাই তারা করে না, উপরন্তু যে সব নীতি নেয় তাতে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়ে। ব্যবসায়ীরা অন্যায় ভাবে, বেআইনি ভাবে দাম বাড়ালেও সরকার চুপ করে থাকে। চাকরির ব্যবস্থা দূরে থাক, এমন নীতি নেয় যাতে মালিকরা অবাধে ছাঁটাই করতে পারে। সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ বন্ধ করে। যতটুকু নিয়োগ করে তা অস্থায়ী এবং চুক্তির ভিত্তিতে। চাকরি শেষে যে সুযোগ সুবিধাগুলি শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওয়ার কথা সেগুলি বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতি দূর করা দূরের কথা, ক্ষমতায় বসে জনগণের সম্পত্তি অবাধে লুঠ করতে থাকে। ট্যাক্স কমানোর পরিবর্তে নানা অছিলায় আরও ট্যাক্স চাপাতে থাকে, অন্য দিকে পুঁজিপতিদের ট্যাক্স ছাড় করে দেয়।

আজ জনগণকে এটা বুঝতে হবে যে, ভোটের সময় এই বিপুল পরিমাণ খরচ যে এই দলগুলি করে তার একমাত্র উদ্দেশ্য জনগণকে ভুলিয়ে, প্রতারিত করে তাদের থেকে ক্ষমতায় বসার ছাড়পত্রটি আদায় করে নেওয়া। এবং এই খরচ জোগায় সেই পুঁজিপতি শ্রেণি, শাসক দলগুলি ক্ষমতায় গিয়ে যাদের রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে। জনগণকে আজ এটাও বুঝতে হবে, কোনও দল যদি সত্যিই জনস্বার্থকে প্রতিফলিত করে তবে তারা কোনও ভাবেই পুঁজিপতিদের থেকে টাকা নিতে পারে না। কারণ পুঁজিপতিদের টাকা নিলে, সেই টাকায় ভোট করলে, সেই ভোটে জিতে পুঁজিপতিদের শোষণ-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধতা করা যায় না। একটু খেয়াল করলেই যে কেউ বুঝবেন, পুঁজিপতিদের টাকায় পরিচালিত এই দলগুলি কেউই সেই বিরুদ্ধতা করে না। তাই আজ এটাও স্পষ্ট বুঝতে হবে যে, জনগণের স্বার্থে যে দল কাজ করে তাদের ভোটের খরচ জোগানো, জনস্বার্থে গড়ে তোলা আন্দোলনগুলির খরচ জোগানোর দায়িত্ব অন্যে, অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণি, পালন করতে পারে না, জনগণকেই তাদের নিজেদের স্বার্থে সে দায়িত্ব পালন করতে হয়।