দেশভাগের স্মৃতি আনন্দের নয়, যন্ত্রণার

পশ্চিমবঙ্গ দিবস ঘোষণার প্রতিবাদে কলকাতার শ্যামবাজারে দলের উদ্যোগে সভা। ২০ জুন

পশ্চিমবঙ্গ দিবস? সেটা আবার কী? শোনামাত্র রাজ্যের প্রায় সব মানুষই এমন প্রশ্ন করেছেন। কারণ এর আগে কখনও এমন দিবসের নাম শোনেননি তাঁরা।

হঠাৎ সংবাদমাধ্যম থেকে রাজ্যের মানুষ জানল যে ২০ জুন কলকাতায় রাজভবনে রাজ্যপাল পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করবেন। জানা গেল, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের সব রাজভবনে নির্দেশ পাঠিয়েছে দিনটিকে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে আনন্দ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পালন করতে। তাই রাজ্যপাল সেদিন রাজভবনে নাচ-গান-বসে আঁকো প্রভৃতি নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন।

স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা দিবস হয়ে গেল কী করে? দিল্লির বিজেপি নেতাদেরই বা হঠাৎ এমন পশ্চিমবঙ্গ-প্রীতির কারণ কী? ইতিহাস বলছে, ১৯৪৭ সালের এই দিনটিতে অবিভক্ত বাংলার আইনসভায় ভোটাভুটি হয়েছিল বাংলা ভাগের প্রশ্নে। সেই বিধানসভায় মুসলিম লিগ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারপরেই ছিল কংগ্রেসের শক্তি। সিপিআইয়ের ছিল তিনজন সদস্য। হিন্দু মহাসভার একজন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটায়, শিক্ষকদের ভোটে জিতে তিনি আইনসভায় গিয়েছিলেন। ভোটাভুটি সেদিন তিনবার হয়েছিল। সব সদস্যের উপস্থিতিতে যৌথ অধিবেশনের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি মত দেয়– বাংলা অবিভক্ত থাকবে এবং পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে। পূর্ববঙ্গের মুসলিম প্রধান জেলার প্রতিনিধিদের নিয়ে আলাদা যে ভোটাভুটি হয় তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে এবং বলে, যদি বাংলা ভাগ হয় তবে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে যোগ দেবে। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুপ্রধান জেলাগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে যে ভোট হয় সেখানে বেশির ভাগ অংশ বাংলাকে দু’ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত দেয়। বাংলা ভাগের পক্ষে-বিপক্ষে ৫৮-২১ ভোট পড়ে। এই সব ফলাফল বাংলার তৎকালীন গভর্নর ফ্রেডরিক বারোসের কাছে পাঠানো হয়। তিনি তা পাঠান ভাইসরয়ের কাছে।

পশ্চিমবাংলার ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট দেওয়া ৫৮ জন প্রতিনিধির একজন ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। তা হলে বিজেপির দাবি মতো শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গের জনক হন কী করে? মূলত মুসলিম লিগ এবং কংগ্রেসের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত যা হওয়ার হয়েছিল। বিজেপি প্রচার করে চলেছে শ্যামাপ্রসাদ না থাকলে নাকি বাংলার হিন্দুরা সে দিন রক্ষা পেত না। তাদের চলে যেতে হত মুসলিম শাসনে। ইতিহাস থেকে স্পষ্ট, বাংলা ভাগের পিছনে শ্যামাপ্রসাদের আলাদা কোনও ভূমিকা ছিল না। এবং বিজেপি শ্যামাপ্রসাদকে হিন্দুদের ত্রাতা বানাতে যে প্রচার করছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং অনৈতিহাসিক। অবশ্য বিজেপি জোরের সঙ্গে দাবি করতে পারে, তাদের তাত্ত্বিক নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকরই ১৯২৩ সালে প্রথম হিন্দু এবং মুসলমানকে দুটি পৃথক জাতি বলে দ্বিজাতি তত্তে্বর অবতারণা করেছিলেন। তার বহু পরে মুসলিম লিগ ১৯৪২ সালে তাদের এক সম্মেলনে সাভারকরের এই তত্ত্বকেই কাজে লাগায় দেশভাগের পক্ষে তাদের দাবিকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করতে এবং পরে ব্রিটিশ শাসকরা ভারতকে ভাগ করার হাতিয়ার হিসাবে এটাকেই ব্যবহার করে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, চারের দশকের গোড়ায় এ দেশের তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই-ও ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি, এই তত্ত্ব প্রচার করে কার্যত সাভারকরের দ্বিজাতি তত্ত্বকেই সমর্থন করে এবং বাংলাভাগের পক্ষে তাদের তিন জন প্রতিনিধি ভোট দেয়। অথচ ধর্মের ভিত্তিতে জাতি– এই তত্ত্ব কতখানি ভ্রান্ত তা মা’র্বাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে আগেই দেখিয়েছেন মহান নেতা স্ট্যালিন। বাস্তবের মাটিতেও বারবার মা’র্বাদের এই বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ প্রমাণিত হয়েছে। ভারতভাগের কয়েক বছরের মধ্যেই এ সত্য স্পষ্ট হয়ে যায় পাকিস্তানের বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তান বিরোধী তীব্র ক্ষোভের মধ্যে, যা শেষ পর্যন্ত আলাদা রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম দেয়। ধর্মের ভিত্তিতে যদি জাতি তৈরি হত তবে আরবের মুসলমানদের কিংবা ইউরোপের খ্রিস্টানদের একটি করেই রাষ্ট্র থাকত, আলাদা আলাদা এতগুলি রাষ্ট্রের জন্ম হত না।

দেশভাগের ভয়ঙ্কর পরিণতির শিকার ছিন্নমূল মানুষদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীরা শুরু থেকেই করে আসছে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসার পর সেই চেষ্টা তারা আবার জোর কদমে শুরু করেছে। ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে ২০ জুন দিনটিকে বের করে এনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে চালানোর চেষ্টা সেই উদ্দেশ্যেই। কিন্তু দেশভাগের মতো একটি স্মৃতি, যা আসলে যন্ত্রণার, তা আনন্দের দিন হয় কী করে? দেশভাগ মানে তো কয়েক যুগ ধরে দেশের কোনও একটি অংশে বাস করা লাখ লাখ মানুষকে ভিটেমাটি, জমি, পরিচিত পরিবেশ, প্রতিবেশী সব কিছু ছেড়ে অনিশ্চিতের দিকে পাড়ি দিতে বাধ্য করা, দেশভাগ মানে তো সর্বস্ব হারানো-লুণ্ঠন-দাঙ্গা-মৃত্যু-যন্ত্রণা-হাহাকার– এর মধ্যে কোথায় আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন বিজেপি নেতারা?

এ ছাড়া ভাগ তো শুধু বাংলাই হয়নি, পাঞ্জাবও ভাগ হয়েছিল। সে রাজ্যে কি পাঞ্জাব দিবস পালনের নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মন্ত্রীরা? কেন দেননি? আসলে বাংলায় দলের সমর্থন বাড়াতে এখন তাদের এমন একটা যে-কোনও দিবসের দরকার যে দিবসটির গায়ে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ লেগে রয়েছে। তা সে ২০ জুন না হয়ে আর একটা যে কোনও দিন হলেও তাদের চলত।

দেশভাগের সেই প্রবল যন্ত্রণাদায়ক ঘা, ছিন্নমূল হওয়া মানুষের মনের মধ্যে যা অনেকটাই শুকিয়ে এসেছে, তাকেই নতুন করে খুঁচিয়ে আবারও দগদগে করে তোলাটা আজ বিজেপির বিশেষ প্রয়োজন। কারণ অনেক চেষ্টা করেও পশ্চিমবাংলায় জায়গা করতে পারছে না বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। বাংলার নবজাগরণ আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, বামপন্থী আন্দোলন সাধারণ মানুষের বড় অংশের মধ্যে যে চেতনার জন্ম দিয়েছিল, সেই সংগ্রামী চেতনার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার জায়গা ছিল না। সাম্প্রদায়িকতাকে সে ঘৃণা করেছে, প্রতিরোধ করেছে, প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিজেপি নেতারা ভালই জানেন, সিপিএমের অবাম রাজনীতি এবং সর্বনাশা সিদ্ধান্ত ‘আগে রাম পরে বাম’-এর ফলে এ রাজ্যে গত লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসনে জয়ী হয়ে গেলেও বাস্তবে তাদের দলের জনসমর্থন তেমন নেই। কেন্দ্রে গত ন’বছরের বিজেপি শাসনে বড় অংশের মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জাতপাতের বিরোধ– এ সব ছাড়া মানুষকে কার্যত আর কিছুই দিতে পারেনি বিজেপি শাসন। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে নিজেদের সেই অপদার্থতা ঢাকতে এ রাজ্যে হঠাৎ ২০ জুনকে তুলে এনেছে তারা।

রাজ্যের মানুষের পশ্চিমবঙ্গ দিবস নিয়ে অনাগ্রহের বিষয়টি বুঝেই বিজেপি নেতারা রাজভবনকে দিয়ে দিবসটি পালনের সূচনা করেছেন। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে যদি রাজ্যের মানুষ সাবধান না হন, তবে নানা কায়দায়, মানুষের পুরনো স্মৃতিকে খুঁচিয়ে তুলে সাম্প্রদায়িক বিজেপি তাদের এই হীন রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে ফেলবে। মানুষকে ভাবতে হবে, এই যে দীর্ঘদিন ধরে বাংলার মানুষ ধর্ম-বর্ণ-জাত নির্বিশেষে পাশাপাশি শান্তিতে বাস করে আসছে, বিজেপির এই ষড়যন্ত্রের আসল লক্ষ্য সেই শান্তি-সুস্থিতিকে নষ্ট করে দেওয়া, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে মানুষের মনকে এমন করে বিষাক্ত করে তোলা, যাতে গুজরাটের মতো, আসামের মতো, উত্তরপ্রদেশের মতো, মণিপুরের মতো প্রতিবেশী প্রতিবেশীর বুকে ছুরি হানতে পারে, খুন করতে পারে, ঘরদোর জ্বালিয়ে দিতে পারে। আর এই ভাবে বিজেপি তার ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করবে, ক্ষমতার গদিতে গিয়ে বসবে। আমরা কি নিজেদের এই ষড়যন্ত্রের শিকার হতে দিতে চাই? তা যদি না চাই তবে বিজেপির এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। বিজেপি নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন করতে হবে, মানুষের কোন কল্যাণ-উদ্দেশ্যে তোমরা পশ্চিমবঙ্গ দিবসকে ইতিহাসের ধুলো ঘেঁটে হাজির করলে? কেন মূল্যবৃদ্ধি-বেকারির বিরুদ্ধে তোমাদের সরকারের কোনও ভূমিকা নেই? সাধারণ মানুষ যখন ক্রমাগত দারিদ্রের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে, কী করে দেশের মুষ্টিমেয় মানুষ মুনাফার পাহাড় তৈরি করতে পারছে? মানুষের করের টাকায় মন্দির তৈরি করে আর রাষ্ট্রায়ত্ত সব সম্পত্তি ধনকুবেরদের হাতে তুলে দিয়ে কোন কল্যাণটা তোমরা করছ? আমরা সাধারণ মানুষ যদি এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সক্রিয় না হই, তবে শুধু ২০ জুনেই বিজেপি থামবে না, কাল অন্য একটা দিবস, পরের দিন আর একটা দিবস, যার গায়ে বিন্দুমাত্র সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ আছে তা খুঁজে বের করবে এবং তাকে কেন্দ্র করে হিন্দুত্বের, বিদ্বেষের, সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলবে।

বাস্তবে দেশভাগ অনিবার্য ছিল না। দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবন বাজি রেখে, তাঁদের আবেগ-মতামত-নিরাপত্তাকে কোনও গুরুত্ব না দিয়ে ক্ষমতালোভী নেতারা নিজেদের গদি ভাগ-বাঁটোয়ারার স্বার্থে দেশভাগ ডেকে এনেছিলেন। এই ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তের পরিণতিতে শুধু যে দুই বাংলার অসংখ্য মানুষ সারা জীবনের জন্য ভিটেছাড়া হয়েছেন শিকড় হারিয়েছেন তাই নয়, ভয়াবহ হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন ঘটেছে এবং সম্প্রীতির মাটিতে মানবতার মাটিতে হিন্দু-মুসলিম বৈরিতার বীজ বাসা বাঁধার সুযোগ পেয়েছে। এই ভয়ানক অপরাধের দায় সেদিনের কংগ্রেস-মুসলিম লিগ-হিন্দু মহাসভা-সিপিআই সহ বড় বড় কোনও দলই অস্বীকার করতে পারে না। তাই আজ দাবি ওঠা দরকার, দেশভাগের ইতিহাস যদি জানতেই হয়, তবে সেই ভয়ঙ্কর কলঙ্কিত দিনগুলির সত্য ইতিহাস জানা প্রয়োজন। সম্প্রীতির লক্ষ্যে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের একতার লক্ষ্যেই সেই ইতিহাসের চর্চা, পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। আর দিবস যদি পালন করতেই হয়, নেতাজি-ভগৎ সিং-ক্ষুদিরাম সহ বিপ্লবীদের স্মরণে তা পালন করা দরকার, যারা ধর্মের বিভেদহীন শোষণমুক্ত ভারত গড়ার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। তা না করে, যারা ভোট রাজনীতির স্বার্থে দেশকে, বাংলাকে ভাগের সর্বনাশা সিদ্ধান্তকে আনন্দ-উদযাপনের বিষয় করে তুলতে চাইছে, তারা মানবতার শত্রু। তাদের সব দিক থেকে পরিত্যাগ করাই কর্তব্য।