দাসপ্রথার থেকে কম ভয়াবহ নয় আজকের বাঁধা-শ্রমিকদের জীবন

‘চার দশক আগে ঠাকুরদার চিকিৎসার জন্য বাবা এক ইটভাটা মালিকের থেকে ৭ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। তিনি মারা গিয়েছেন। কিন্তু এই ঋণের জন্য গোটা পরিবার ভাটা মালিকের বাঁধা-মজুরে (বন্ডেড লেবার) পরিণত হয়েছে। ১৫ বছর আগে বাবা মারা গিয়েছেন, এখনও সেই ধার শোধ করে চলেছি। কত টাকা বাকি আমি জানি না। মালিক বলেছে আরও বেশ কয়েক বছর কাজ করতে হবে।’– বলছিলেন সুখাই রাম। উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌয়ের কাছে বরাবাঁকির বাসিন্দা।

সুখাই-এর মতো মর্মান্তিক পরিণতি ঘটেছে অসংখ্য বাঁধা-মজুরের জীবনে। এক একটি পরিবারের প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাঁধা-শ্রমিকের প্রচণ্ড খাটনি খাটতে বাধ্য হয়। ২০১৬-এর একটি রিপোর্ট বলছে, ভারতে এরকম ১ কোটি ২০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৪০ লক্ষ বাঁধা-শ্রমিক রয়েছে, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বে সব মিলিয়ে এই শ্রমিকের সংখ্যা ২৭ মিলিয়ন। কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান দপ্তর এই সংখ্যা কমিয়ে দেখালেও বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। এদের মধ্যে শিশু-শ্রমিক রয়েছে অনেক।

তামিলনাড়ূ, ওড়িশা, বিহার, কর্ণাটক, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ– প্রধানত এই রাজ্যগুলিতেই এই ধরনের শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। ইটভাটা বা অন্যান্য ক্ষেত্রে এদের অন্যায় ও অবৈধ ভাবে নিয়োগ করা হয়, চলে অমানুষিক শোষণ। ভাটা মালিকের অলিখিত নিয়মই এখানে আইন। শ্রমিকদের দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা খাটানো হয়, কোথাও তারও বেশি। কাজের ঘণ্টা নির্দিষ্ট নেই। রোদে পুড়ে, আধপেটা খেয়ে, জীর্ণ শরীরে ১০০০টি ইট তৈরি করলে তবে ২০০ টাকা পাওয়া যাবে। পরে ওই ইটগুলি হাজার হাজার টাকায় বিক্রি করে মুনাফা লোটে মালিক। সংসার চালানোর দায়ে বেশিরভাগ গরিব, দলিত পরিবারের মানুষ এই কাজে ঢোকেন। পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলোর উপর অন্যায়-জবরদস্তি চালাতেও সুবিধা হয়। ন্যায্য মজুরি দূরের কথা, কাজের ঘণ্টা-হিসাবে তাদের কত টাকা পাওয়ার কথা, তাও ভাল করে বোঝেন না অনেকে। ধার-কর্জের হিসাবও রাখতে পারেন না। পাওনাদাররা পছন্দমতো টাকা ধার হিসাবে দেখিয়ে এই শ্রমিকদের রক্ত-জল করা পরিশ্রম শুষে নেয়। বছরের পর বছর চলে এই অমানবিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। এরকম এক একটি শ্রমিক পরিবার়ে শিশুও জন্মায় শোষণের এই পেষাই-কলে ছিবড়ে হওয়ার ভবিতব্য নিয়ে।

দালালের মাধ্যমে প্রধানত এসব শ্রমিকদের নিয়োগ হয়। দালালরা কারখানা মালিকের সাথে চুক্তি করে শ্রমিকদের নানা টোপ দিয়ে কর্মস্থলে পরিবার নিয়ে আসতে বলে। পরিবারের সাথে একত্রে থাকার বন্দোবস্ত হবে ভেবে শ্রমিকরা এই প্রস্তাবে রাজিও হয়। কর্মস্থলে রাখার ব্যবস্থা করে তাদের হাতে অগ্রিম টাকা গুঁজে দেয় দালাল। এই টাকাটা শুরুতে ধার হিসাবে দেওয়া হয়। অগ্রিম টাকা নিলেই সেই শ্রমিক ফাঁদে পড়ে যায়, শোধ করার জন্য কাজ করতে বাধ্য হয় সেখানে। ভাটামালিক-দালালের ঘৃণ্য চক্র এভাবেই শ্রমিককে ঋণের ফাঁদে ফেলে। শ্রমিক কাজ করতে না চাইলে বা মালিকের পছন্দমতো কাজ না হলে জোটে অকথ্য অত্যাচার। শত অত্যাচারেও সেই জায়গা ছেড়ে অন্যত্র যেতে পারে না শ্রমিকরা। প্রাচীন কালে দাস-প্রভুদের মর্জিমতো যেমন দাসশ্রমিকদের চলতে হত, অন্য মালিকের কাছে ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে পারত না, তেমনই একবিংশ শতাব্দীতে আজও এভাবে দাস-প্রথা টিকে রয়েছে সমাজের বুকে।

ইটভাটাগুলিতে মহিলাদের নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। শৌচালয়ের ব্যবস্থা নেই। মালিকের একমাত্র লক্ষ্য কত বেশি খাটিয়ে কত কম মজুরি দেওয়া যায়। তার উপর মহিলাদের উপর চলে যৌন নির্যাতন। ঝাড়খণ্ড, বিহার থেকে উত্তরপ্রদেশে আসা এরকম বহু মহিলা-শ্রমিক ভাটা মালিকের লালসার শিকার হন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও অভিযোগও দায়ের হয় না কাজ থেকে ছাঁটাই হওয়ার ভয়ে। একে পরিবার প্রতিপালন করতে হিমশিম দশা, তার উপর কাজ চলে গেলে পেট চলবে কী করে? লাচার অবস্থায় কাজ করতে হয় দরিদ্র পরিবারের মহিলা শ্রমিকদের। এত করেও পরিবারের সদস্যদের পেট ভরাতে পারে না তারা। অনাহারে মারা যায় অনেকের শিশুসন্তান। এদের শিশুসন্তানরা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ তো পায়ই না, উপরন্তু বাবা-মাকে সাহায্য করতে বাধ্য হয় ভাঙা ইট কুড়িয়ে। এভাবে শৈশব থেকেই তারা দাসত্বের জীবনে এক ধাপ এগিয়ে যায়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং সামান্য মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয় রাজস্থানের ইটভাটাগুলিতে কাজ করা অসংখ্য শিশু-শ্রমিক। ১০-১২ ঘন্টা কঠোর শ্রম দেওয়ার পর তারা মাত্র ১০০ টাকা মজুরি পায়।

শুধু ইটভাটা নয়, শ্রমিক শোষণের ছবিটা একই অন্যান্য বহু ক্ষেত্রেও। উত্তরপ্রদেশে কার্পেট শিল্পে বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে কাজ করতে আসা পরিযায়ী শ্রমিকরা ঠাসাঠাসি অবস্থায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে বাধ্য হন। সেখানেও পরিস্থিতি ভয়াবহ। এখানকার শিশুদের পরিণতি ইটভাটায় কাজ করা শিশুদের মতোই। চুড়ি শিল্পের অবস্থাও ভয়ঙ্কর। এখানে বাঁধা-শ্রমিকদের উপর শোষণ ভয়াবহ। কমপক্ষে ৩৫০টা কাচের চুড়ি তৈরি করে মাত্র ৬ টাকা মজুরি মেলে। গোটা পরিবার ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করে প্রতিদিন এরকম ৩০ লট চুড়ি তৈরি করতে পারে। কঠিন শ্রম করে আয় হয় মাত্র ১৮০ টাকা। ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির বাজারে এতে ক’জনের পেট চলে!

ইটভাটা, কার্পেট বা চুড়ি শিল্প কোথাও শ্রমিক-নিরাপত্তা বলতে প্রায় কিছু নেই। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ভাল নয়। শ্রমিক অধিকার নিয়ে আইন রয়েছে, কিন্তু দিব্যি আইন ভঙ্গও করে চলেছে শিল্প-মালিকরা। ১৯৭৬-র বন্ডেড লেবার সিস্টেম (অ্যাবলিশন) অ্যাক্ট রয়েছে, ১৯৮৬-র জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট রয়েছে। কিন্তু শিশুশ্রমিকদের বহাল করা যেমন চলছে অনায়াসে, তেমনই তাদের কাজের নিরাপত্তা নিয়েও কারখানা কর্তৃপক্ষের কোনও মাথাব্যথা নেই। সরকারের কি চোখে পড়ে না শিশুশ্রমিকদের দুর্দশা? নাকি তারা দেখেও না দেখার ভান করেন? এমনকি যে সব ক্ষেত্রে মালিক শিশু-শ্রমিকদের নিয়োগ করছে, তাদের শাস্তির কোনও ব্যবস্থা করছে না সরকার। সরকারের উদাসীনতা মালিকদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে। অথচ এই নেতা-মন্ত্রীরাই শিশুশ্রম নিয়ে, আইন নিয়ে বড় বড় বত্তৃতা দেন। শিশু-শ্রমিকদের উদ্ধার করে অন্যত্র থাকা-খাওয়া-পড়াশোনার ব্যবস্থা করা কি সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?

পুঁজিবাদী সমাজে কারখানা-মালিকের তীব্র মুনাফা লালসার মূল্য জীবন দিয়েও দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের। এমনকী রেহাই পাচ্ছে না ছোট ছোট শিশুরাও। মার্কস দেখিয়েছিলেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিক শ্রমিককে ততটুকুই মজুরি দেয়, যতটুকু হলে সে খেয়ে-পরে বেঁচে থেকে মালিকের মুনাফা জোগানোর কাজটুকু করতে পারে। আজ চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদের সে বালাইও নেই। একজন শ্রমিক মারা গেলে হাজার হাজার অভুক্ত শ্রমিক অপেক্ষা করে আছে একটা কাজের জন্য। তাই আজকের এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে মালিকের কাছ থেকে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য ন্যায়সঙ্গত শ্রমিক আন্দোলনই একমাত্র পথ।