টেট যুদ্ধ

২০২২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় রবিবার। প্রভাত হইতেই বঙ্গদেশের রাজধানী সহ নগরে-শহরে সাজো-সাজো রব। পথঘাট আইনরক্ষকে ছয়লাপ। দেশে যে এত আইনকানুন রক্ষা করিবার লোক আছে, অন্য সময়ে বড় বুঝা যায় না।

নেতা-মন্ত্রীরা জালিয়াতি করিয়া, ঘুষ খাইয়া, হুমকি দিয়া কোটি কোটি টাকা জমাইতেছে, যত্রতত্র খেলিবার বল ভাবিয়া বোমা কুড়াইয়া পাইয়া বালক-বালিকা মারা যাইতেছে, চোলাই-সাট্টা-জুয়ার বন্যা বহিয়া যাইতেছে, খুন-জখম-নারীধর্ষণ তো গা সহাই হইয়া গিয়াছে। হঠাৎ ‘আজ প্রভাতে কী সুর বাজে?’ ‘সবাই বলে এ উহারে ব্যাপারটা কী, ব্যাপারটা কী?’ ডিসেম্বরে ডেডলাইনের একটি আওয়াজ কয়মাস ধরিয়া শুনা যাইতেছিল। সেই লাইন আসিয়া পড়িল কি? রাজ্য সরকারের কি সত্যিই গণেশ উল্টাইল? রাজ্যে ডবল ইঞ্জিনের বৈদিক শাসন আসিয়া পড়িল নাকি? অকালে কি হঠাৎ আবার ‘খেলা হইবে?’ পাকিস্তানি জঙ্গিরা কি চোরাগোপ্তা হামলা চালাইল, না চিন নাথুলা পার হইয়া ঢুকিয়া পড়িল?

জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া জানা গেল যে, না। ব্যাপার অত সহজ নহে। তদপেক্ষাও গুরুতর। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীকুল প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক হইবার জন্য পরীক্ষা দিবে। আর কে না জানে যে, এ রাজ্যে বর্তমান সরকার আসিবার পর হইতে যতবার শিক্ষক এবং সরকারি কর্মচারী নিয়োগের পরীক্ষার আয়োজন করিতে গিয়াছে ততবারই বিরোধীরা সাঁট করিয়া নানা রকম অন্তর্ঘাত চালাইয়া তাহা ভণ্ডুল করিয়া দিয়াছে? আর যে দু-একবার কোনও রকমে পরীক্ষা লওয়া গিয়াছে সেখানেও ধড়িবাজ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীকুল পরীক্ষার হলে অজস্র প্রকার কায়দায় নানা রকম জালিয়াতি করিয়া, লিস্টে নাম তুলিয়া চাকুরি পাইয়া গিয়াছে। ইহাদের টুকলিফাই করিবার নানাপ্রকার কায়দা-কানুনেরই ফলে আজ শিক্ষা দপ্তরের সৎ চরিত্রবান মহামান্য নেতাকর্তাদের শুভ্র ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হইয়া গিয়াছে।

অতএব এবারে আর চালাকি ন চলিষ্যতি। একেবারে কঠোরতম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। পরীক্ষার্থীরা তো বটেই, এমনকি নজরদার শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও তিনঘন্টা আগে পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢুকিয়া পড়িতে হইবে। সকল মাছি তাড়াইতে হইবে। গতকল্য রাত্রে যে সকল মশককুল বেঞ্চ-চেয়ার-টেবিলের তলায় আশ্রয় লইয়াছিল তাহাদের মারিতে হইবে। কেন না, মশাগুলিও আজিকালি তাল বুঝিয়া বেয়াদবি শুরু করিয়াছে। চক্রান্ত করিয়া ডেঙ্গু ছড়াইতেছে। পরীক্ষার্থী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারাও মোবাইল ঘড়ি ব্যাগ টিফিন জল কিছুই আনিতে পারিবেন না। পেটে কিল মারিয়া পরীক্ষা দিতে ও নিতে হইবে। পরীক্ষার্থীরা কখন কিভাবে জালিয়াতি করে তাহার ঠিক কী? তাহারা ঘড়ি আংটি দুল নাকছাবি শাঁখা-পলা কিছুই পরিয়া ঢুকিতে পারিবে না। অতটুকু সব গহনার মধ্যে স্থাপনযোগ্য, পরীক্ষায় নকল করিবার উপযুক্ত কোনও ‘ডিভাইস’ আবিষ্কার করিবার কথা অ্যাপল কোম্পানিও এখনও কল্পনা করিয়া উঠিতে পারে নাই। কিন্তু বাঙালি তরুণ-তরুণীদের বিশ্বাস নাই! সব এক একটি জেমস বন্ডের চেলা। নাকছাবি হইতে বিষাক্ত গ্যাস বা লেজার রি¬ ছুঁড়িয়া ইনভিজিলেটরকে ঘায়েল করিয়া প্রশ্নপত্র লইয়া জানালা হইতে লাফ মারিয়া মোটরবাইকের উপর পড়িয়া ছুট মারিলেই তো চিত্তির! পশ্চিমবঙ্গের এতদিনকার শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিশ্বখ্যাত স্বচ্ছতার একেবারে মাথায় বাড়ি!

অতএব খোলো সব। নাকছাবি না খুলিলে নাক কাটিয়া বাহিরে রাখিয়া পরীক্ষা দাও। হুঁ হুঁ বাবা। বাঙালি পুলিশকে তো চেনো না! উপরতলা হইতে একবার হুকুম আসিবার অপেক্ষা মাত্র। করোনা ভাইরাসের চাহিতেও দ্রুতবেগে থানা হইতে লাঠি বন্দুক লইয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া এলাকা ছাইয়া ফেলে।

যাহা হউক। বিরোধীদের সকল চক্রান্ত ব্যর্থ করিয়া টেট পরীক্ষা তো মহা সমারোহে হইয়া গেল। শিক্ষা প্রসারে কৃতসংকল্প মহামান্য রাজ্য সরকার বাহাদুরের কর্তাব্যক্তিরা শুধু চুরি করেন এই অপপ্রচার ভ্রান্ত প্রমাণিত হইল। দেখা গেল সুযোগ পাইলে তাঁহারা ছুটির দিনেও কাজ দেখাইয়া ফাটাইয়া ফেলিতে পারেন। তবে একটা কথা। এই পরীক্ষার ফলাফল কবে বাহির হইবে, তাহাতে কোন দেবতা কত কোটি টাকার খেলা খেলিবেন, ফলাফল বাহির যদি হয়ও, নির্বাচিত প্রার্থীদের কবে নিয়োগ হইবে, তার পূর্বে তাঁহাদের কয় বৎসর অনশন করিতে হইবে এবং মামলা লড়িতে হইবে এই সকল প্রশ্ন করিয়া সময় নষ্ট করিবেন না। ইহাদের উত্তর গুগলও জানে না, বেদেও কিছু বলা নাই।