চোখ বন্ধ রেখেই কি প্রলয় বন্ধ করতে চান রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীরা

রাজ্যে এখন সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় কী জিজ্ঞাসা করলে যে কেউ উত্তর দেবেন, শিক্ষা। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ নিয়ে বিরাট পরিমাণ দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে এবং তা নিয়ে কোর্টের তত্ত্বাবধানে চলছে তদন্ত। তার মানে কি সরকারের অন্য দফতরগুলি নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই, বা সেই দফতরগুলিতে কোনও দুর্নীতি নেই? কাণ্ডজ্ঞান থাকলে যে কেউ বলবেন, দুর্নীতি সব দফতরেই আছে। তবে শিক্ষা দফতরটির সঙ্গে যেহেতু সন্তানদের গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি যুক্ত হয়ে রয়েছে এবং সেই প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষ হিসাবে তাদের গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই শিক্ষা দফতরের দুর্নীতিতে মানুষের বিক্ষোভও বেশি। কিন্তু অপদার্থতা কিংবা দুর্নীতি যে সব দফতরেই গেড়ে বসেছে, তা নিশ্চিত করেই বলে দেওয়া যায়।

সম্প্রতি রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে, এবার শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র সহ ৩৩টি দফতরের বাজেট নিয়ে বিধানসভার অধিবেশনে কোনও আলোচনা হবে না। গিলোটিনে দেওয়া হবে। অর্থাৎ বিতর্ক বা আলোচনা না করেই ব্যয় বরাদ্দের অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু কেন বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হবে না? রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলার যেমন দ্রুত অবনমন ঘটছে, তেমনই শিক্ষা নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। বিতর্ক তো শুধু নিয়োগ দুর্নীতি নিয়েই নয়, শিক্ষার মানের মারাত্মক অবনমন, পরিকাঠামোর অবনমন, স্কুলছুট তথা ড্রপআউটের ঘটনার মারাত্মক আকার নেওয়া প্রভৃতি বহু বিষয় রয়েছে, যা নিয়ে গুরুতর আলোচনা-বিতর্ক হওয়া দরকার। স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষার বাজেটের সঙ্গে পরিকাঠামো সহ বহু কিছু বিষয় যুক্ত। সেই আলোচনাকেই সরকার এড়িয়ে যেতে চাইছে।

এ রাজ্যে শিক্ষার দশা কতখানি বেহাল অবস্থায় পৌঁছেছে তা স্পষ্ট হয়ে যায় শুধু একটি ঘটনা থেকেই। এ বার মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে চার লক্ষ। অতিমারির সময়ে দু’বছর স্কুল বন্ধ রেখে সরকারি স্কুল শিক্ষাব্যবস্থাটি কার্যত অকেজো করে রাখা হয়েছিল। এর ফলে শিক্ষার্থীদের যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে, চার লক্ষ পরীক্ষার্থী কমে যাওয়া তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। পরীক্ষার্থী কমে যাওয়াই শুধু নয়, রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় ড্রপআউট একটি ধারাবাহিক সমস্যা। একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে প্রাথমিকে অন্তত ৮ লক্ষ ছাত্রছাত্রী স্কুলছুট হয়েছে। এর আগে সিপিএম শাসনেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আর, তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীরা বিষয়টির গুরুত্ব আদৌ বোঝেন কি না সে বিষয়েই সন্দেহ রয়েছে। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে জেলার ছাত্রছাত্রীদের ভালো ফল দেখিয়ে সিপিএম সরকার সেটাকে নিজেদের সাফল্য বলে দাবি করত। নেতা-মন্ত্রীরা দেখাতেন, কী ভাবে শহরকে টেক্কা দিয়ে গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা ভাল রেজাল্ট করছে এবং এর দ্বারা শিক্ষার মূল সমস্যাগুলিকে আড়াল করার চেষ্টা হত।

বাস্তবে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে সিপিএম শাসনেই। প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি ও পাশফেল তুলে দিয়ে শিক্ষার ভিতটাকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আজ যে বাংলা মাধ্যম শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে তার জন্য পুরোপুরি দায়ী সিপিএম সরকারের শিক্ষানীতি। শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যমের রমরমার শুরু সেই সময়েই। ইংরেজি এবং পাশফেল না থাকাতেই রাজ্যের মধ্যবিত্ত বাংলা মাধ্যম ছেড়ে ইংরেজি মাধ্যমমুখী হয়েছে। তৃণমূল সরকারও একই রাস্তায় হেঁটে চলেছে। তাই তাদের চোখেও বাংলামাধ্যম স্কুলগুলি দুয়োরানি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষার অধিকার আইনের নামে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশফেল তুলে দেওয়া। এর ফলে প্রায় কিছুই না শিখে ছাত্রছাত্রীরা নবম শ্রেণিতে পৌঁছে যাচ্ছে। তারপরই শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক ঘাটতি সামনে আসছে। বর্তমান সরকারের সময়ে পুরনো ঘাটতি পূরণ করার কোনও চেষ্টা তো নেই-ই, উপরন্তু নানা ধরনের দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে শিক্ষা দপ্তর। একদিকে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। অন্য দিকে যতটুকু নিয়োগ হয়েছে তাতে বহু অযোগ্য প্রার্থীকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে। স্কুলগুলোয় শিক্ষাকর্মী নেই, চেয়ার টেবিল ব্ল্যাকবোর্ড নেই, দেওয়ালে রং হয় না, ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিড ডে মিলের হিসেব রাখা, জনগণনা, ভোটার লিস্ট তৈরি, ভোট পরিচালনার মতো যাবতীয় শিক্ষা-বহির্ভূত কাজে সরকারি শিক্ষকদের ব্যস্ত রাখা।

সম্প্রতি সরকারি বদলি নীতির ফল হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গ্রামের স্কুল ছেড়ে শিক্ষকদের শহরমুখী ঢল। গ্রামের স্কুলে ছাত্রসংখ্যা বেশি হলেও দিব্যি বদলি নিয়ে শহরের স্কুলে চলে আসছেন বহু শিক্ষক। ফলে বহু স্কুল শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে, অনেক উচ্চমাধ্যমিক স্কুলকে শিক্ষকের অভাবে পুরো বিভাগই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আবার শহরের স্কুলে কোথাও ছাত্র নেই বলে শিক্ষকদের শিক্ষাদফতরের কর্মীতে পরিণত করে দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হয়েছে উচ্চশিক্ষায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কমানোর ঘটনা।

বিধানসভায় এ সব কিছু নিয়েই দরকার ছিল গভীর আলোচনা, বিতর্ক এবং শিক্ষার উন্নয়নের জন্য নতুন পরিকল্পনা তৈরি করা। সরকারের উচিত ছিল সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলির সমাধানে আন্তরিক চেষ্টা চালানো। পরিবর্তে তৃণমূল সরকার সমস্যাগুলিকে চাপা দিতেই ব্যস্ত থাকল। সেই চেষ্টারই অঙ্গ শিক্ষা বাজেট নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে তা গিলোটিনে পাঠানো। বিজেপি সরকার যে ভাবে সংসদে জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বদলে স্বৈরাচারী শাসকের মতো অর্ডিন্যান্স জারি করে দেশের মানুষের উপর নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত, তৃণমূল সরকারও একই ভাবে বিধানসভাতে আলাপ-আলোচনার রাস্তা বন্ধ করে স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত রাজ্যের জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু চোখ বন্ধ রাখলে যেমন প্রলয় বন্ধ থাকে না, তেমনই শিক্ষার সমস্যাগুলিকে আড়াল করে সেগুলির মারাত্মক ক্ষতি এড়ানো যাবে না। সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের এই দায়িত্বহীন আচরণের প্রতিবাদ ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক বুদ্ধিজীবী শিক্ষাপ্রেমী সব মহল থেকেই হওয়া আজ অত্যন্ত জরুরি। বিধানসভায় যে বিতর্ক এড়ালেন তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা সেই বিতর্ক আজ উঠছে সমাজের সব স্তরে। কারণ শিক্ষার মানের অবনমন নিয়ে তৃণমূল নেতাদের দায় না থাকতে পারে, ভুক্তভোগী জনগণের সেই দায় রয়েছে।