কী শিখবে ছাত্ররা! (পাঠকের মতামত)

ছোটবেলায় দেখেছি, পেটের দায়ে কেউ ছাগল বা গোরু চুরি করে ধরা পড়লে গ্রামবাসীরা তার মাথা ন্যাড়া করে গালে চুনকালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা ঝুলিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরাত। সবাই ছি ছি করত। আমরা ছোটরা বুঝতাম চুরি করা খারাপ, ভীষণ লজ্জারও। স্কুলে গেলে মাস্টারমশাইরা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ থেকে পড়াতেন– ‘চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে, চোর বলিয়া তাহাকে সকলে ঘৃণা করে। চোরকে কেহ কখনও প্রত্যয় করে না।’

ভাবি, এখনকার ছেলেমেয়েদের বর্ণপরিচয়ের এই কথাগুলো পড়ালে পাল্টা প্রশ্ন করবে না তো! সে সব প্রশ্নকে অযৌক্তিক বলে উড়িয়েও তো দেওয়া যাবে না! কারণ মানুষ যা দেখে তাই শেখে। এই কচি মনগুলো টিভি খুললে এখন কীদেখে? দেখে, দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই জেরার পর মন্ত্রী বাড়িতে ফিরলে অনুগামী জনতা উল্লাসে মেতে ওঠে, ফুলের মালা দিয়ে তাঁকে বরণ করে। তারা দেখে, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর মেয়ে দুর্নীতির চাকরি করে। নেতা-মন্ত্রীদের কুবাক্যে টেলিভিশন গমগম করে। দেখে, নীতি-আদর্শের তোয়াক্কা না করে যা খুশি তাই করে চলেছে সরকারের হর্তাকর্তারা। নির্লজ্জতা তাদের কাছে যেন গর্বের বিষয়! তারা ভাবে, শখের দায়ে টাকার নেশায় চোর বনে যাওয়া নেতা-মন্ত্রীদের শাস্তি হচ্ছে কই?

মনে প্রশ্ন আসে, ছোটরা তা হলে কী শিখবে? বইয়ের পাতার নীতি-আদর্শের কথাগুলো তাদের ভুল বলে মনে হবে না তো? নেতা-মন্ত্রীরা প্রভাবশালী। তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণের নানা দিক তো ছোটদের দেখে শেখার কথা। ভালোটা না দেখলে তারা খারাপটাই শিখবে। এই অবস্থায় স্কুলে গিয়ে আমরা শিক্ষকরা যখন নীতি-আদর্শের কথা বলব, উচিত-অনুচিতের বোধ গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করব, ছাত্ররা তখন আড়ালে মুখ টিপে হাসবে না তো?

মনে মনে আতঙ্কিত হই আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ভেবে। এ কোন সমাজ-সংস্কৃতি তাদের উপহার দিচ্ছি আমরা! আমরা কি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ভুল প্রমাণ করেই ছাড়ব! ছোটরা তো জানছে, চোরদের আজ আর কেউ ঘৃণা করে না। ক্ষমতাশালীরা চুরি করে ধরা পড়লেও তাদের ফুলের মালায় বরণ করা হয়। তাদেরই আবার ভোট দিয়ে মন্ত্রী বানানো হয়। ‘একসময় দুর্নীতিবাজেরা দুর্নীতি করে উল্লাস করবে, মূর্খরা মূর্খতার জন্য উল্লাস করবে’– সক্রেটিসের এই কথাটাই কি তাহলে সত্যি হবে!

না, সন্তানদের জন্য এই পঙ্কিল সমাজ আমরা চাই না। এর জন্য সচেতন হতে হবে অভিভাবকদেরই। ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝাতে হবে শিশুদের। শেখাতে হবে, চোরকে নয়, ফুলের মালায় বরণ করতে হয় মনীষীদের।

আব্দুল জলিল সরকার, হলদিবাড়ি, কোচবিহার

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ৩ জুন ২০২২