একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থেই এমএসপিতে আপত্তি সরকারের

 

শিলিগুড়ি

নজিরবিহীন কৃষক আন্দোলনের চাপে মাথা নত করতে বাধ্য হল বিজেপি সরকার। তিনটি কৃষি আইন যেমন মোদি সরকারকে প্রত্যাহার করে নিতে হল তেমনই কৃষকদের অন্য কিছু দাবিও মেনে নিতে হল। এই জয় ঐতিহাসিক। উল্লসিত সারা দেশের কৃষকরা। দেশের আপামর শোষিত মানুষ এই জয়ে উজ্জীবিত। জনজীবনের যেখানেই শাসক শ্রেণির শোষণ-অত্যাচারের স্টিম রোলার চলছে তেমন প্রতিটি ক্ষেত্রে শোষিত মানুষ কৃষক আন্দোলনের সাফল্য থেকে শিক্ষা নিয়ে আন্দোলন জোরদার করার প্রস্তুতি গড়ে তুলছেন।

আন্দোলনকে দমন করার, ছত্রভঙ্গ করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি সরকার। বিজেপি নেতারা ঘোষণা করেছিলেন কৃষি আইন তাঁরা প্রত্যাহার করবেন না। কৃষকদের বিভ্রান্ত করতে প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, এই আইন কৃষকদের, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের মঙ্গলের উদ্দেশ্যেই আনা হয়েছে। কিন্তু কোনও মিথ্যা যুক্তিই কৃষকদের বিভ্রান্ত করতে পারেনি। সব রকম প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে কৃষকরা তাঁদের আন্দোলনে অনড় ছিলেন। যত দিন গেছে আন্দোলন আরও বিস্তৃত আরও শক্তিশালী হয়েছে। কৃষকদের মনোবল আন্দোলনের আগুনে পোড় খেয়ে আরও মজবুত হয়েছে। আন্দোলনের নেতাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের কৃষকরা, বিশেষত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান প্রভৃতি দিল্লির আশেপাশের রাজ্যগুলি থেকে আন্দোলনে ব্যাপক সংখ্যায় যোগ দিয়েছে। সর্বত্র কৃষক মহাপঞ্চায়েতে লাখো মানুষের সমাবেশ হয়েছে। অন্য রাজ্যগুলিতে কৃষকরা আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে লাগাতার কর্মসূচি নিয়েছে। বিজেপির সংগঠিত এলাকাগুলিতেও কৃষকরা সরকারের কৃষকস্বার্থ বিরোধী ভূমিকায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। এই সব এলাকার কৃষকরা বহু জায়গায় ব্যানার টাঙিয়ে দিয়েছে, ‘এখানে বিজেপি নেতাদের প্রবেশ নিষেধ’। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য, যাকে বিজেপি নেতারা তাঁদের খাসতালুক বলে মনে করেন, সেখানে গ্রামপঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে।

এই আন্দোলনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যথার্থ শত্রুকে চিনতে পারা। তাই আন্দোলনের অভিমুখ শুধু বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না। বিজেপিকে সামনে রেখে যে একচেটিয়া পুঁজি এই আইন সরকারকে দিয়ে নিয়ে এসেছিল আইনে তার স্বার্থটি, তার আগ্রাসী, জনস্বার্থ বিরোধী চরিত্রটি কৃষকদের কাছে অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই স্লোগান উঠেছিল কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে। জনগণের সমস্ত দুদর্শার মূলে যে এই পুঁজিপতি শ্রেণি তা-ও আন্দোলনের ময়দানে কৃষকদের কাছে ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাস্তবে পুঁজিবাদী রাষ্টে্র সরকার পরিবর্তনের দ্বারা পুঁজির স্বার্থে নেওয়া নীতির পরিবর্তন হয় না। পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষাকারী একটি দলের সরকারের বদলে তাদেরই আর একটি দলের সরকার আসে মাত্র।

এই আন্দোলন নানা ভাষা, নানা ধর্ম, নানা প্রদেশের মানুষের ঐক্যের যে নজির রেখে গেল তা যেমন অভূতপূর্ব, তেমনই শিক্ষণীয়। নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহরা সাম্প্রদায়িকতা আর জাতপাতের সংঘর্ষ-বিভেদকে যেভাবে প্রকট করে তুলেছে তা যে ভারতীয় সংস্কৃতি নয়, আন্দোলনে নানা ধর্ম, বর্ণ, প্রদেশের মানুষ যেভাবে এক সঙ্গে থেকেছেন, খেয়েছেন, লড়েছেন, সম্প্রদায়, জাতপাতের ঊর্ধ্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, তা-ই যে আসলে ভারতীয় সংস্কৃতি, এই আন্দোলন গোটা বিশ্বের মানুষের সামনে তা তুলে ধরেছে।

বিজেপি সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে বুঝে যান যে, যত সময় যাবে ততই তাদের বিরুদ্ধে কৃষকদের রোষ আরও শক্তি নিয়ে ফেটে পড়বে। এই অবস্থাতেই তাঁরা পিছু হঠার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তাঁরা প্রথমে শুধু কৃষি আইন তিনটি তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। মনে করেন এতেই বোধহয় কৃষকরা তাঁদের আন্দোলন গুটিয়ে নেবেন। কিন্তু কৃষকরা তাঁদের বাকি দাবিগুলিতে অনড় থাকেন এবং সেগুলি না মানা হলে আন্দোলন আরও জোরদার করার কথা ঘোষণা করেন। উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনের সামনে ‘যতটা বাঁচানো যায়’– এই মনোভাব থেকে বাকি দাবিগুলির আরও কয়েকটি তাঁরা শেষ পর্যন্ত মেনে নেন এবং কয়েকটি নিয়ে কৃষক মোর্চার সদস্যদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। এর মধ্যে কৃষকরা যে দাবিগুলিতে সব চেয়ে জোর দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা এমএসপি) আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি। এই দাবিটি নিয়ে সরকার ক্রমাগত টালবাহনা করে চলেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এতে বাজেটের অর্ধেক টাকা কৃষকদের ফসল কিনতে খরচ হয়ে যাবে। সরকারপন্থী কৃষি বিশেষজ্ঞরাও সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, এর ফলে নাকি সরকারের ১৭ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হয়ে যাবে।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে আইনি স্বীকৃতি দিলে সরকারের খরচ কত হবে, সেই খরচ সরকারের পক্ষে করা সম্ভব কি না, অর্থনীতির উপর তার কী প্রভাব পড়বে প্রভৃতি প্রশ্ন আলোচনার আগে দেখা যাক, ফসলের সহায়ক মূল্য কৃষকের জন্য কতখানি প্রয়োজন এবং তা আইনসম্মত করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না।

কৃষকদের দুর্দশা

সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট বলছে, ভারতে প্রতি ১২ মিনিটে একজন কৃষক আত্মহত্যা করে। ২০১৯ সালেই শুধু আত্মহত্যা করেছে ৪২ হাজারের বেশি কৃষক। গত ১৫ বছরে এই সংখ্যাটা চার লক্ষের উপর। যে কৃষক গোটা দেশের মানুষকে খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করে তাদের এমন হাজারে হাজারে আত্মহত্যা করতে হচ্ছে কেন? আত্মহত্যার একমাত্র কারণ ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া। প্রতি বছর চাষের খরচ লাফিয়ে বাড়ছে। সার বীজ কীটনাশক সেচ প্রভৃতি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি উপকরণ এখন দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির দখলে। উদারনীতির নামে সরকার এগুলি সবই মুনাফার জন্য তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। ফলে ১০ বছর আগে সার বীজ কীটনাশকের যা দাম ছিল এখন তারা সরকারি মদতেই তার তিন-চার গুণ বাড়িয়েছে। ফলে চাষের জন্য খরচের পরিমাণ অবিশ্বাস্য রকমে বেড়েছে। ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। চাষের এই বিপুল ব্যয় তাদের পক্ষে বহন করা অসম্ভব। স্বাভাবিক ভাবেই চাষের জন্য তাদের ঋণ করতে হয়। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলি ছোট চাষিদের ঋণ দেয় না। তাদের গিয়ে হাত পাততে হয় সুদখোর গ্রামীণ মহাজনদের কাছে। সেখানে সুদের পরিমাণ ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এতেও ততটা অসুবিধা হত না যদি চাষিরা ফসলের ন্যায্য তথা লাভজনক দাম পেত। বাস্তবে কী হয়?

কৃষির বাজারটি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের দখলে

কৃষি-ফসলের বাজারে ফড়ে, মহাজন, মাঝারি, বড় ও একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের চক্র ফসল ওঠার সময়ে দামকে একেবারে তলানিতে নিয়ে যায়। ঋণগ্রস্ত চাষি সুদ সহ ঋণ শোধ করতে, পরের ফসলের খরচ জোগাড় করতে, সংসার প্রতিপালন করতে ফসলের অভাবি বিক্রিতে বাধ্য হয়। ব্যবসায়ীরা চাষির থেকে জলের দামে ফসল কিনে নেয়। তারপর তা মজুত করে রেখে বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করে। ফসলের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকে। সেই কম দামে কেনা খাদ্যপণ্যই দেশের মানুষকে আগুন দামে কিনতে বাধ্য করে। অন্য দিকে চাষির ঋণ আর শোধ হয় না। আগের ঋণের সাথে নতুন ঋণ যোগ হয়ে তার পরিমাণটাকেই বাড়িয়ে তোলে। এর সাথে আছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রোগপোকার আক্রমণ প্রভৃতি। ঋণ শোধের কোনও উপায় দেখতে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত চাষির কাছে একটি রাস্তাই খোলা থাকে। আত্মহত্যা।

যে পেঁয়াজ এখন আমরা ৪০-৫০ টাকা কেজি দামে বাজার থেকে কিনছি, সেই পেঁয়াজ মহারাষ্ট্রের নাসিকের চাষিরা ১-২ টাকা দামে বিক্রি করেছে। উত্তরপ্রদেশের আখ চাষি কিংবা মহারাষ্ট্রের তুলো চাষিরাও একই রকম ভাবে জলের দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এ রাজ্যে সরকার এ বছর ধানের সহায়ক দাম কুইন্টাল প্রতি ১৯৪০ টাকা ঘোষণা করেছে। কিন্তু ঘোষণাই সার। কৃষকরা বাজারে বিক্রি করছে ১১০০ টাকা, যা উৎপাদন খরচের অনেক নীচে। সরকার যে পরিমাণ ধান কেনার কথা ঘোষণা করেছে তা ধানের মোট পরিমাণের এক নগণ্য অংশ মাত্র। সে-টুকু কেনা নিয়েও চলছে ব্যাপক দুর্নীতি। চাষিকে এখন শুধু স্লিপ ধরানো হচ্ছে, যা নিয়ে তারা সামান্য পরিমাণ ধানও তিন মাস পরে বিক্রি করতে পারবে। আলুর ক্ষেত্রে তো কোনও সহায়ক মূল্যই নেই। ফলে যে আলু ওঠার সময়ে চাষিরা প্রতি কেজি ৩-৪ টাকায় বিক্রি করে তা-ই এখন সাধারণ মানুষ বাজার থেকে ২০-২২ টাকা দামে কিনছে। গত বছর এই দাম ৫০ টাকায় উঠেছিল।

কৃষকরা কী চায়

চাষিকে ঋণে ডুবে যাওয়া থেকে, আত্মহত্যা থেকে বাঁচাতে হলে ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত করা দরকার। কিন্তু তা তো চাষির ইচ্ছেয় হবে না। তা হতে পারে একমাত্র সরকার ন্যূনতম সহায়ক দাম বেঁধে দিলে। আবার শুধু বাঁধলেই হবে না, তা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং তার জন্য তাকে আইন আনতে হবে। আইনকে কঠোর ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তা ছাড়া চাষিকে যাতে ঋণ করতে না হয় সে-জন্য সবার আগে চাষের খরচ কমাতে হবে। তা হতে পারে একমাত্র সার বীজ কীটনাশক সহ সব ধরনের কৃষিউপকরণের উপর একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্যের অবসান ঘটানোর দ্বারাই। সরকারকেই এই সব উপকরণ সস্তা দরে চাষিদের সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

সরকার এখন মোট ২৩টি ফসলের সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে। কিন্তু তা ওই ঘোষণামাত্রই। ভুট্টার ঘোষিত সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ১৮৫০ টাকা হলেও চাষিরা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ১১০০ থেকে ১৩৫০ টাকার মধ্যে। এমএসপি বাধ্যতামূলক না হওয়ায়, এখনও পর্যন্ত নূ্যনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া না দেওয়া সরকারের মর্জি। ইচ্ছা করলে সরকার এমএসপি ঘোষণা করতে পারে, নাও পারে। তাই কৃষক আন্দোলন থেকে যথার্থই দাবি উঠেছে এমএসপি আইনসঙ্গত এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই দাবিও উঠেছে, সমস্ত কৃষিপণ্যকেই এই আইনের আওতায় আনতে হবে। এ না হলে কর্পোরেট হাঙররা, বড় মাঝারি নানা মাপের ব্যবসায়ীরা কৃষককে ঠকানোর সেই ট্র্যাডিশনই বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাবে।

এমএসপিতে সরকারের আপত্তি কেন

দেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ২০ শতাংশ। কিন্তু শুধু শতাংশ দিয়ে কৃষির গুরুত্ব বোঝা যাবে না। গোটা জাতিকে খাদ্য জোগানোর দায়িত্ব পালন করেন কৃষকরা। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ কৃষির সাথে যুক্ত। তাই কৃষির অবদান শুধু অর্থনীতির নিছক কিছু সংখ্যাতত্ত্বের মানদণ্ডে মাপলে ভুল হবে। মাপতে হবে জীবনের মানদণ্ডে। কৃষির এই গুরুত্ব শাসক বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের পক্ষেও অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তাঁরা যা অস্বীকার করছেন তা হল, যাঁরা কৃষি অর্থনীতির নির্মাতা, অর্থাৎ যাঁরা উদয়াস্ত কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলান, সেই কৃষকদের প্রাপ্যটুকু স্বীকার করতে, তাদের অধিকারের মান্যতা দিতে।

কৃষকদের প্রাপ্য কতটা? কৃষক মানে কৃষক পরিবার। কারণ, ফসল ফলাতে কৃষকের গোটা পরিবার মেহনত দেয়। ফসলের খরচের হিসাবের সময় মেহনতের এই হিসেবটা ভুলে গেলে চলবে না। যদিও সরকারি কর্তারা এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা অধিকাংশ সময়ই ভুলে যান। কৃষকরা চাইছেন মজুরি সহ কোনও ফসল উৎপাদনের যা খরচ তার সঙ্গে তাঁদের পরিবার প্রতিপালনের খরচটাও, অর্থাৎ পরিবারের ভরণপোষণ, সকলের চিকিৎসা, লোকলৌকিকতা, সন্তানদের পড়াশোনা প্রভৃতি খরচটাও যোগ করা হোক। এটাই তো স্বাভাবিক এবং ন্যায্য হিসেব। কেন ন্যায্য? কারণ, না হলে ভবিষ্যতে কৃষির কাজের জন্য কেউ টিকে থাকবে না। কৃষকের তো অন্য কোনও রোজগারের উপায় নেই। স্বামীনাথন কমিশনও এই হিসেবই দিয়েছে। তা মোটের উপর কৃষির খরচের সাথে আরও ৫০ শতাংশ।

এটা নিশ্চিত করতেই সরকারের আপত্তি। কেন? প্রধানমন্ত্রী এই হিসেবের কোন অংশটা বাদ দিতে চান? নাকি মনে করেন কৃষকদের মানুষের মতো না বেঁচে শুধু উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে কোনও ক্রমে টিকে থাকলেই হল! শিল্পপতিরা যখন শিল্পদ্রেব্যর বিক্রয়মূল্য ঠিক করে, তখন তো যথেষ্ট লাভ ধরে হিসেব করার আইনসম্মত অনুমতিই সরকার দিয়ে থাকে। তা হলে কৃষি-ফসলের ক্ষেত্রে তা হবে না কেন? কেউ কেউ যুক্তি করছেন, এমএসপি ঘোষণা করলে আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিপণ্যের প্রতিযোগিতায় দেশ পিছিয়ে যাবে। এমন অদ্ভূত যুক্তি তাঁরাই করতে পারেন, যাঁরা কৃষকদের দেশের স্বাধীন নাগরিক বলেই মনে করেন না– যাঁদের বেঁচে থাকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি ভোগ করার সমান অধিকার রয়েছে। না হলে, শিল্পপণ্যের ক্ষেত্রে তো এমন যুক্তি আসে না। দেশের যে সব শিল্পপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় সাফল্য এনে দিচ্ছে, সেই সব পণ্যের উৎপাদক শিল্পপতিরা কি লোকসান করে রফতানি করে? তাঁদের কি কৃষকদের মতো এমন করে আত্মহত্যা করতে হয়? না, বরং তাদের মুনাফা– এমনকি করোনায় যখন দেশের বেশির ভাগ অংশের মানুষের জীবিকা তলানিতে তখনও অস্বাভাবিক রকমে বেড়েছে। তা হলে কৃষি পণ্যের বেলায় সরকার কৃষকদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবে কেন?

সরকার ২৩টি ফসলে নূ্যনতম সহায়ক মূল্য যে এখন ঘোষণা করে, তার মানে তো সরকার মনে করে এগুলিতে কৃষকের এই পরিমাণ মূল্য পাওয়া দরকার। তাই যদি হয় তবে তা পাওয়ার ব্যবস্থা সরকারি ভাবে সুনিশ্চিত করতে এত গড়িমসি কেন? তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটা কৃষক ন্যায্য দাম না পেলে আর কী উপায়ে হতে পারে! দ্বিতীয়ত, সরকার যদি দাম বেঁধে দেয় তবে সেই দামে বেসরকারি ক্রেতা তথা খাদ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরাও কিনতে বাধ্য থাকবে। সরকারি বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ যুক্তি তুলছেন, এর ফলে খাদ্যপণ্যের দাম অনেকখানি বেড়ে যাবে। একেবারেই তা নয়। এখন যে চাষির থেকে ব্যবসায়ীরা জলের দামে ফসল কিনে নেয়, তাতে কি সাধারণ মানুষ সস্তায় খাদ্যপণ্য কিনতে পারে? যে আলু চাষিরা ৪-৫ টাকা দামে বেচে সেই আলুই চিপস তৈরি করে প্রতি ৫ গ্রাম ১০ টাকা দামে বিক্রি করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি। সরষে যখন চাষিরা বিক্রি করে তার কোনও নূ্যনতম মূল্য নেই, কিন্তু আদানিদের সরষের তেলের এমআরপি (ম্যাক্সিমাম রিটেল প্রাইস বা সর্বোচ্চ খুচরো দাম) কিন্তু নির্দিষ্ট এবং সেই এমআরপি তারাই ঠিক করে। স্বাভাবিক ভাবেই কৃষকরা এই প্রশ্ন তুলছে যে, এমআরপি আইনসিদ্ধ হলে এমএসপি হবে না কেন?

একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থেই এমএসপিতে আপত্তি সরকারের

আসলে সরকার মানেই কোনও না কোনও শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী সরকার– হয় শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষ তথা শোষিত অংশের মানুষের সরকার, না হয় শাসক তথা শোষক পুঁজিপতি শ্রেণির সরকার। আমাদের দেশে যে সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় রয়েছে, সেই সরকারটা যদি জনগণের সরকার হয়, শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের সরকার হয়, তবে দেশের কৃষক শ্রেণি, যারা দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ, যারা গোটা জাতিকে খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করে, তারা তাদের পরিশ্রমের ফলটুকু যাতে পায়, তার ব্যবস্থা করতে সরকার এত গড়িমসি করবে কেন? বরং সরকার তো নিজের থেকেই এমন ব্যবস্থা নেবে যাতে সমাজের কোনও অংশের মানুষই তার পরিশ্রমের ফল থেকে বঞ্চিত না হয়। বিজেপি সরকার তা করছে কি? বাস্তবে করছে না শুধু নয়, কৃষকরা যাতে ফসলের ন্যায্য মূল্য না পায়, এবং সেই মূল্য যাতে মুনাফার আকারে একচেটিয়া পুঁজির মালিকদের ভাণ্ডারে গিয়ে জমা হতে পারে তার ব্যবস্থাই করছে। তার জন্যই কৃষি আইন। তার জন্যই এমএসপি না মানতে চাওয়া। একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ দেখতে গিয়েই সরকার কৃষকদের স্বার্থকে তাদের পায়ে বিসর্জন দিচ্ছে। এতে প্রমাণ হয় যে, সরকারটা কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের নয়, তা আসলে একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণিরই স্বার্থরক্ষাকারী সরকার। সরকারের একচেটিয়া পুঁজির তোষণনীতিই এমএসপি আইনসিদ্ধ করার ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা। যাঁরা সাধারণত সমাজে শ্রেণির অস্তিত্ব বুঝতে পারেন না বা বুঝলেও মানতে চান না, কৃষি আইন এবং তার বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলন তাঁদের তা বুঝতে খুবই সাহায্য করবে।

সংস্কার মানে কী

সরকারের মন্ত্রীদের মুখে, খবরের কাগজের কলমচিদের লেখায়, সরকারি বিশেষজ্ঞদের মুখে ‘সংস্কার’ কথাটা এখন খুব শোনা যাচ্ছে। সকলেই বলছেন, কৃষিতে সংস্কার চাই। কৃষি আইন বাতিলের পর এক দল পণ্ডিত হাহুতাশ শুরু করে দিয়েছেন। এর ফলে নাকি কৃষিতে সংস্কার আটকে গেল। সংস্কার মানে কী? সংস্কার মানে তো নানা কারণে যে ব্যবস্থাটা মানুষের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছে তাকে মেরামতের মধ্যে দিয়ে সহনীয় করে তোলা। তা হলে কৃষির ক্ষেত্রে সেই সংস্কারটা কী? চাষিরা ফসলের দাম পাচ্ছে না, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কৃষিউপকরণগুলি একচেটিয়া পুঁজির হস্তগত হওয়ায় তার দাম আকাশ ছুঁয়েছে। কৃষকরা চাষের খরচ জোগাড় করে উঠতে পারছে না। তাদের জন্য অল্প সুদে বা বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া দরকার। বহু ফসল সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। তার জন্য আধুনিক হিমঘর তৈরি করা দরকার। এরকম আরও অনেক কিছু। সরকারি এই সংস্কারে কি কৃষককে এই সব সঙ্কট থেকে মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে? আদৌ নয়। যে সংস্কারের পরিকল্পনা সরকারের নেতা-মন্ত্রী-বিশেষজ্ঞরা করেছেন, তার একটাই মানে, তা হল গোটা কৃষি ব্যবস্থাটিকেই একচেটিয়া পুঁজির মুনাফার জন্য তাদের হাতে তুলে দেওয়া। কৃষকরা হবে সেই মুনাফা লোটার যন্ত্রমাত্র। এই সংস্কারের লক্ষ্য কৃষককের কল্যাণ নয়, এর সাথে কৃষক-স্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই। পুঁজিবাদী শোষণে জর্জরিত দেশের সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতা তলানিতে। উৎপাদন শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিপুল পুঁজির মালিক দেশীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের পুঁজি বিনিয়োগের জায়গা করে দেওয়ার জন্যই ‘সংস্কার’ নাম দিয়ে কৃষিক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা। তাদের লক্ষ্য, কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি এবং দেশের উচ্চত্তিচার বা পাঁচ শতাংশের জন্য বাছাই করা কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও সরবরাহ। কৃষকদের স্বার্থকে বলি দিয়ে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষার এই অপচেষ্টাকে আপাতত কৃষকরা রুখে দিতে পেরেছে। সামজজীবন তথা অর্থনীতির অন্য ক্ষেত্রগুলিতে যেখানে এই সংস্কার অনেক আগেই সরকার শুরু করেছে, কোনও ক্ষেত্রেই তার ফল জনগণের জন্য সুফল দেয়নি। বরং তাদের ঘাম-রক্ত শোষণ করে পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার পাহাড় আরও উঁচু হতেই সাহায্য করেছে।

এমএসপির জন্য খরচের সরকারি হিসেব ঠিক নয়

এবার আসা যাক খরচের প্রশ্নে। প্রথমত, সরকার কৃষকদের বাঁচানো তথা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া জরুরি মনে করে কি না? যদি করে তবে অর্থের সংস্থান সেখানে বাধা হতে পারে না। সরকার যে পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর পুঁজিপতিদের ট্যা’ ছাড় দেয়, ঋণ মকুব করে দেয়, দুর্নীতিতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ তছনছ হয়, কৃত্রিম যুদ্ধাতঙ্ক তৈরি করে মারণাস্ত্র কিনতে যা খরচ করে তার পরিমাণটা বিপুল। গত ৩০ বছরে দেশের ৫০টা পরিবারকে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে ৪০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। গত ৭ বছরে ওদের ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করা হয়েছে ১৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। ৫০টা পুঁজিপতি পরিবারের জন্য যদি এত খরচ করা যায় তবে দেশের কোটি কোটি নিরন্ন মানুষের মুখে আহার জোগানোর অর্থ জোগাড় করা যাবে না কেন? এই অর্থের ভগ্নাংশ ব্যবহার করেও কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা যায়। উপরন্তু খাদ্যদ্রব্য সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে থাকলে তাদের হাতে যে অর্থ অতিরিক্ত হবে তা বাজারে শিল্পজাত দ্রব্য কিনতে ব্যয় হবে। এর ফলে বাজারে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হবে, যা শিল্প-কারখানাগুলিকে চাঙ্গা হতে এবং পরিণতিতে গোটা অর্থনীতিকেই চাঙ্গা হতে সাহায্য করবে।

সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করতে হবে

কৃষি-বাজারটির নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিদের হাতে থাকায় চাষির ফসলের দামের সঙ্গে কৃষিজাত খাদ্যপণ্যের দামের আকাশ-পাতাল ফারাক। ফসলের ন্যায্য দাম বেঁধে দিলে তাতে বাজারে পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। সরকারকে ফসল ওঠার পর দ্রুত তার নিজস্ব এজেন্সিগুলিকে দিয়ে বাজারে ফসল কিনে নিতে হবে। তা হলে ব্যবসায়ীদের কাছে কৃষকদের জলের দামে ফসল বেচতে হবে না। তারাও বাধ্য হয় সরকারি দামে ফসল কিনতে। অন্য দিকে সরকারকে রেশনে নিয়মিত চাল-গম-চিনি এবং সাথে ডাল, তৈলবীজ বা ভোজ্য তেল সহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করার দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি ন্যায্য মূল্যের দোকান খুলে এই সব সামগ্রী সস্তায় জনগণকে বিক্রি করতে হবে। একেই আমরা বলছি রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য। এমএসপি এই সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের একটি অপরিহার্য অংশ। একমাত্র এই পদ্ধতিতেই কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে বিরাট সংখ্যক বেকারের যেমন কাজের ব্যবস্থা হবে তেমনই সাধারণ মানুষও চড়া দামের হাত থেকে রেহাই পাবে।

আন্দোলনের ঐতিহাসিক জয়ের পর কৃষকরা আবার তাঁদের এলাকায়, পরিবারে, খেতে ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা সরকারের উপর এই আস্থা রেখেই ফিরে যাচ্ছেন যে, সরকার তার কথা মর্যাদা রক্ষা করবে। কোনও ভাবে সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আন্দোলনের আগুনে পোড় খাওয়া কৃষকরা আবার আন্দোলন গড়ে তুলবেন। সে ক্ষেত্রে এই আন্দোলনের বিপুল অভিজ্ঞতা তাদের আরও শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

শুধু কৃষকদের দাবিগুলিই নয়, জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আগামী দিনে সঙ্কটগ্রস্ত একচেটিয়া পুঁজি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আক্রমণ আরও বাড়াবে। সেই আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও এই অভিজ্ঞতা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আপাতত এই আন্দোলনের সাফল্যের উপর দাঁড়িয়েই এমএসপির দাবি আদায়ের আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ১৯ সংখ্যা ১৭ ডিসেম্বর ২০২১