আলোকোজ্জ্বল পথ, নাকি অন্ধকারে ফিরে যাওয়া

মিউনিখে দাখাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বার, ফায়ারিং স্কোয়াড ও লক্ষ লক্ষ ইহুদিদের উপর অত্যাচার ও হত্যার নিদর্শন দেখিয়ে গাইডদের সেই অনুতপ্ত কন্ঠ মনে পড়ে যায়৷ ‘আমাদেরই পূর্ব পুরুষেরা এই জঘন্যতম কাজে লিপ্ত ছিল৷ পূর্বপুরুষ বলে এবং সেই অপরাধীদের বংশধর বলে আমরা লজ্জা পাই৷ নিজেদের বড় ছোট মনে হয়৷’ – জার্মান জাতি হিসেবে ‘মানব হত্যা’ কলঙ্কের যে ইতিহাস ওদের যুগ যুগ ধরে বইতে হচ্ছে, ওরা যে মর্মবেদনা সয়ে চলেছে, আমাদের কাছে বলে যেন ওরা একটু হালকা হতে চাইছিল৷

সেই নাৎসিদের স্লোগানের প্রতিধ্বনিই কি শুনছি আমাদের দেশে? গত পাঁচ বছর ধরে যে রাজনৈতিক দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন ছিল সেই দলের অনুগামীদের মুখে ‘হেইল হিটলার’ এর নকল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি– ‘হর হর মোদি’, ‘হর হর মোদি’৷ এক দল মানুষ যেভাবে এই ধ্বনি তুলে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে চলেছে, সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে দেশজুড়ে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করছে তাতে বিগত শতকের ওই ঘৃণিত দিনগুলিকেই মনে করিয়ে দেয়৷ কারণ, এই দলটির যেটা আঁতুড় ঘর, সেটা যে হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক দল৷ ১৯৩০–এর দশকেই এদের পরিচালিত ‘হিন্দু আউটলুক’ এবং ‘মাহরাট্টা’ পত্রিকায় মুসোলিনি ও হিটলারের প্রশংসাসূচক নিবন্ধ প্রকাশিত হয় বার বার৷ ১৯২৯–এ ‘কেশরী’ পত্রিকায় দীর্ঘ নিবন্ধে ফ্যাসিস্ট ইটালিতে –নারীদের ভোট দেওয়ার অধিকার থাকবে না, তাদের একমাত্র কর্তব্য বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থাকা– এগুলির প্রশস্তি গাওয়া হয়৷

সেই হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস সংগঠন থেকে আসা নেতৃবৃন্দই একটা বিশেষ শ্রেণির সমর্থনে রাজনৈতিক দল গড়ে আজ ক্ষমতায়৷ দেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলি বিপুল পরিমাণ অর্থ ও প্রচার যন্ত্র দিয়ে এদের পিছনে দাঁড়িয়েছে৷ অহর্নিশ প্রচারের মাধ্যমে হিন্দুত্বের ভাবাবেগ জাগিয়ে তুলে তাঁরা ক্ষমতার দখল নিয়েছেন৷

আজ যাঁরা হিন্দুত্ব রক্ষায় তথাকথিত ‘হিন্দু জাগরণে’ অংশগ্রহণ করছেন তাঁরা কি জানেন, হিন্দু বলতে কাদের বোঝায়? কলিযুগে চতুর্বর্ণেরও যে আর মূল্য নেই, ব্রাহ্মণ ছাড়া সবাইকে যাঁরা শূদ্রের দলে ভাবেন তাঁদের কাছে নেওয়া হচ্ছে হিন্দুত্বের পাঠ? ‘মনুস্মৃতি’–কে এঁরা ভারতীয় সংবিধানের মর্যাদা দিতে চান, সেখানে তো স্পষ্ট বলা আছে স্বয়ং ব্রহ্মাসৃষ্ট ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র৷ শূদ্রদের কাজ মুখ বুজে বাকি তিন বর্ণের শুধুই সেবা করা৷ দ্বিজ বা ব্রাহ্মণদের কটু কথা বললে জিভ কেটে ফেলা হবে, নাম উচ্চারণ করলে দশ আঙুল দীর্ঘ লোহার পেরেক গরম করে মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, উদ্ধতভাবে কোনও ব্রাহ্মণকে তার কর্তব্য শেখাতে গেলে তার মুখে ও কানে গরম তেল ঢেলে দেওয়া হবে, উচ্চ বর্ণের কাউকে আঘাত করলে যে অঙ্গ দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সেটি কেটে ফেলা হবে, হাত লাঠি তুললে হাত কেটে নেওয়া হবে, লাথি মারলে পা কেটে নেওয়া হবে, উচ্চবর্ণের মানুষের সঙ্গে একই আসনে বসলে নিতম্বে গরম ছ্যাঁকা দিয়ে গভীর ক্ষত করে দেওয়া হবে৷

এগুলি সমর্থন করেই তো আমরা সেই হিন্দু খাতায় নাম লেখাব? আমরা রামরাজ্য চাইব? সেখানেও তো শূদ্ররা বিদ্যার্জন করলে শিরোচ্ছেদ করার বিধান, বেদ পাঠ করলে কানে সিসা গরম করে ঢেলে দেওয়ার বিধান আছে, সেই রাজ্যে স্বয়ং সীতাকে পর্যন্ত গর্ভবতী অবস্থায় বনবাসী হতে হয়েছিল, সতীত্বের পরীক্ষার ঠেলায় পাতাল প্রবেশ করতে হয়েছিল –একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরাও কি নারীদের সেই চোখে দেখব? তাই যদি হয় তাহলে স্পষ্ট বলতে হয়, যারা অব্রাহ্মণ, চিরকাল ধরে যারা দাসত্বের জীবনযাপনে অভ্যস্ত– তারা কোনও দিনই সেই জীবনের বাইরে আসতে চায় না৷ সেই সতীদাহ প্রথা, স্ত্রী শিক্ষারোধ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার না থাকা এ সব আবার মেনেই নিতে হয়, সতী হওয়া নারীর অধিকার– এ কথাও বিশ্বাস করতে হয়৷ ওদের নির্দেশিত পথ – ইহজন্মে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলেই তো পরজন্মে বড়লোক হয়ে জন্মাতে পারবে৷ পূর্বজন্মের পাপস্খালন করতে আমাদের দেহ–মন ওদের হাতেই সমর্পণ করি, আমাদের শ্রমের মূল্যে ওরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করুক, ছিটে–ফোঁটা দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখুক– পরজন্মে আমরা বড়লোক হয়ে জন্মাবই– এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা হিন্দুত্বের ধ্বজা আকাশে তুলি – তাই তো?

আসলে একটা জিনিস সাধারণের মাথায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না যে, চলতি এই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিঁকিয়ে রাখতে জনগণকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখাটা জরুরি বলে ছলে বলে কৌশলে মানুষের মধ্যে বিভাজন ঘটানো ধনিক শ্রেণির শেষ ছোবল মাত্র৷ জাতি–ধর্ম–বর্ণগত ভেদাভেদ তৈরি করে তাদের বেঁচে থাকার লড়াইটাই ভুলিয়ে দিতে একের পর এক অপকৌশল নিয়ে চলেছে ধনিক শ্রেণি৷

মানুষকে শুধুমাত্র হিন্দুত্বের ভাবাবেগে ডুবিয়ে আবার তারা নতুন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছেন৷ বিগত বছরগুলিতে মানুষের মৌলিক চাহিদার কোনও পূরণ হল না, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প প্রতিটি ক্ষেত্রেই হাতগুটিয়ে নিয়ে বেসরকারিকরণের চতুর প্রয়াস চলছে৷ জনগণের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা যারা গায়েব করে দিল, তাদের আড়াল করে নতুন শিল্প–কারখানার মালিকদের যাতে ব্যাঙ্ক থেকে মুলধন পেতে ও হাতাতে কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য সাধারণের কষ্টার্জিত অর্থ কর হিসেবে আদায় করে ব্যাঙ্কগুলিকে জোগান দেওয়া হচ্ছে৷ এদিকে বেকার যুবক–যুবতীদের চাকরি নেই, কলকারখানায় শ্রমিকদের কাজ নেই, কৃষকদের উৎপাদিত সামগ্রীর মূল্য নেই, কৃষকদের আত্মহত্যা দ্রুত গতিতে বাড়ছে– সব কিছুকে ধামাচাপা দিতে সাম্প্রদায়িক কলকাঠি নেড়ে তার দাবানলে এসব পুড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস চলছে৷

তবে হ্যাঁ, আজ জার্মানির মানুষ নিজেদের পূর্বপুরুষের অত্যাচারমূলক ফ্যাসিবাদী মতাদর্শকে বর্জন করছে, আর আমাদের দেশে সেই মতাদর্শকেই গৌরবোজ্জ্বল করে তোলা হচ্ছে৷ কিন্তু ইতিহাস বলছে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিটলার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গ্রেপ্তার, অপহরণ, নির্বাসন, হত্যা করে ভেবেছিলেন যুগ যুগ ধরে জার্মানির সর্বাধিনায়ক হিসেবে থাকবেন৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঙ্কারেই তাঁকে আত্মঘাতী হতে হয়েছিল৷ আজ জার্মানিতে সেই ‘হেইল হিটলার’ ও হাত তোলা সম্বোধন শুনলে বা দেখলে খোদ জার্মানরাই ঘৃণা করে– এটা সবার মনে রাখা উচিত৷ একদল মানুষ যাঁরা আলোকোজ্জ্বল পথের দিশারি, চিরদিন তাঁরা সমাজের অন্তঃস্রোতে প্রবহমান– সীমাবদ্ধতা যতই থাকুক, তাঁদের হাত ধরে পরিবর্তন একদিন আসবেই৷ ইতিহাসে পুরনো ব্যবস্থা চিরস্থায়ী হওয়ার কোনও উদাহরণ নেই৷ তাই সেই পরিবর্তিত দিনে যাতে ‘ঘৃণার পাত্র’ হয়ে আত্মঘাতী না হতে হয়– সেদিকেও যেন শাসক শ্রেণি খেয়াল রাখে৷

দ্বিজেন্দ্রনাথ সরকার, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা)