আমেরিকার ব্যাঙ্কসঙ্কটের নেপথ্যে

সম্প্রতি আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক ও সিগনেচার ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্ক ক্রেডিট সুইসের আর্থিক হালও খারাপ। আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত আমেরিকার ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাঙ্কও। ব্যাঙ্কগুলির ব্যাপ্তি বিশ্বজুড়ে। সে কারণে এই ব্যাঙ্কগুলির হাল বিশ্ববাসীকে বিচলিত করেছে, সমগ্র বিশ্বকে এক গভীর আর্থিক অনিশ্চয়তার গহ্বরে টেনে নিয়ে চলেছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০০৮ সালের সেই ভয়ঙ্কর মন্দাকে, লেম্যান ব্রাদার্সের দেউলিয়া হওয়ার মধ্য দিয়ে যা সামনে এসেছিল। দু’দেশের সরকার এবং শীর্ষ ব্যাঙ্ক টাকা ঢেলে, গ্রাহকদের আমানত তোলার সুযোগ সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে যে পদক্ষেপই নিক, সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক কারণে এতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না। সুদ বৃদ্ধি ব্যাঙ্কগুলিকে বিপাকে ফেলেছে। সুদ বৃদ্ধি ব্যাঙ্কের দায় তথা লায়াবিলিটিকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলায় সুদ বৃদ্ধি ছাড়া ব্যাঙ্কগুলির কাছে আর কোনও পথ নেই। তবে কেবল সুদ বৃদ্ধি নয়, অনুমান করা যেতে পারে, এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণ। ঋণদানের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি মানা হচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি বলতে ঋণ পরিশোধ হওয়ার মতো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, সব রকম যাচাই এবং তাকে ভিত্তি করে বিচক্ষণতার সাথে ঝুঁকির পরিমাপ করে ঋণ দেওয়া। শুধু ঋণ দেওয়া নয়, ঋণ দেওয়ার পর তার গতিপ্রকৃতির সাথে নিবিড় যোগাযোগ রেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণও ঋণদান প্রক্রিয়ার অন্যতম কাজ। এসব মানা হচ্ছে না বিশ্বজুড়ে। পর্যাপ্ত এবং দক্ষ কর্মীর অভাব, সরকারের নানা নির্দেশ মেনে চলার বাধ্যবাধকতা এবং আরও এ জাতীয় কিছু সমস্যা এসব ক্ষেত্রে বাধা হিসাবে কাজ করছে। এসব না মানার ফলে ঋণ পরিশোধ হচ্ছে না এবং ব্যাঙ্কের দায় ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাঙ্ককে সঠিক পথে চালাতে গেলে চাই সম্পদ বা অ্যাসেট এবং দায়ের যথাযথ মেলবন্ধন। উপযুক্ত বা কার্যকরী সম্পদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এই দায় সামলানোর পরিবর্তে দায় সামলাতে ব্যাঙ্কগুলি শেয়ার বিক্রি করছে। এতে মূলধন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে দায় থেকে সাময়িক সুরাহা মিললেও বস্তুত দায়ের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সম্পদ এবং দায়ের মধ্যে সমতা রক্ষা হচ্ছে না। এরই পরিণামে দুর্বল হতে হতে ডুবছে ব্যাঙ্কগুলি।

এ কেবল আমেরিকায় নয়, সারা বিশ্বেই কম-বেশি এই সমস্যা ব্যাঙ্ক শিল্পকে ভোগাচ্ছে, বিপন্ন করে তুলছে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সব ব্যাঙ্কেই বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণ। ঋণদান প্রক্রিয়ার গলদ ছাড়া এ সমস্যা এমন দানবীয় আকার নিতে পারে না। আবার এসব অনাদায়ী ঋণ আদায় বা অনুৎপাদক সম্পদ কমানোর ব্যাপারে কোনও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না ঋণগ্রহীতা পুঁজিমালিকদের স্বার্থে। এ সব কারণে ব্যাঙ্কগুলি ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে এবং তা সামাল দিতে কখনও সরকারি কোষাগার থেকে টাকা দেওয়া হচ্ছে, আবার কখনও শেয়ার বিক্রি করে ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। এখন আবার ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের মধ্য দিয়ে এই সমস্যা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা চলছে। এ সব পদক্ষেপ সমস্যা সমাধানের কোনও স্থায়ী সমাধান নয়।

সরকারি কোষাগার থেকে টাকার জোগান দিয়ে রুগ্ন ব্যাঙ্কগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা অত্যন্ত আপত্তিজনক। কারণ সরকারের রাজস্ব হল জনগণের কাছ থেকে করের মাধ্যমে আদায়ীকৃত অর্থ, যা এ ভাবে ব্যয় করা কোনও যুক্তিতেই দাঁড়াতে পারে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ব্যাঙ্কগুলিকে কার্যত বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারিকরণের অর্থ হল সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ যা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা আছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে যার সম্মিলিত পরিমাণ বর্তমানে ১,০০,০০০,০০কোটি টাকার কাছাকাছি–তার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে এ দেশের ধনকুবেরদের হাতে। বেসরকারি ব্যাঙ্কের ইতিহাস সকলের কমবেশি জানা। এ নিয়ে বহু আলোড়ন সৃষ্টিকারী গল্প-উপন্যাস-সিনেমাও হয়েছে। গত শতকে দেশের বহু বেসরকারি ব্যাঙ্কে লালবাতি জ্বলেছে। ১৯১৩ থেকে ১৯৬৮ এর মধ্যে এ দেশে মোট ২১৩২টি ব্যাঙ্ক ফেল করেছিল। এতে ডুবে যাওয়া ব্যাঙ্কের গ্রাহক এবং কর্মচারীরা পড়েছেন অথৈ জলে। ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণ ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারিকরণের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য সফল করবে না। উল্টে এতে শাখা ও কর্মচারী সংখ্যা কমবে এবং গ্রাহক পরিষেবা দুর্বল হবে।

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে কেবল ব্যাঙ্ক পরিচালকদের বিচক্ষণতা দিয়ে সবটা সামলানো যায় না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমগ্র পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া আজ গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই সমস্যার বেড়াজাল থেকে সহজে বেরোতে পারে না।

ভারতীয় মূল্যায়ন সংস্থা ‘ক্রিসিল’-এর পরামর্শ অনুযায়ী নানা পদক্ষেপ, বিশ্বজুড়ে এ জাতীয় নানা টোটকা-কবিরাজিও আজ এই ভয়ঙ্কর সমস্যা সমাধানের যথার্থ বিজ্ঞানসম্মত কোনও পথ দেখাতে পারছে না। সে কারণে এই সমস্যা সমাধানের জন্য বর্তমান এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন আজ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।