‘আত্মনির্ভর’ না ‘যুদ্ধ-নির্ভর’ ভারত বানাতে চায় বিজেপি!

গুজরাটে বিধানসভা ভোট ঘোষণার অনেক আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী সেখানে প্রচার শুরু করে দিয়েছিলেন। তারই একটা অঙ্গ ছিল ১৮-২২ অক্টোবর গান্ধীনগরে ভারত সরকার আয়োজিত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সেমিনার ‘ডেফ এক্সপো-২০২২’। সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁরা ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত থেকে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে চান। যুদ্ধাস্ত্রকে ভারতীয় বৃহৎ পুঁজিপতিদের মুনাফার প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করার মধ্যে ‘সদর্থক’ দিক দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা। এটাই নাকি ভারতের ‘আত্মনির্ভরতা’? বিজেপি প্রচার করছে, প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতার জেরেই অস্ত্র রপ্তানির অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে চলেছে ভারত! উদ্দেশ্য, গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রতিরক্ষা শিল্পকে কেন্দ্র করে বেকার সমস্যায় জর্জরিত গুজরাটবাসীকে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের খোয়াব দেখিয়ে ভোটের বাজার গরম করা। একই সাথে অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনকেই দেশের শক্তি বলে তুলে ধরে মিথ্যা দেশপ্রেমের মোহে জনগণকে ফাঁসিয়ে দেওয়া। যাতে দেশ জুড়ে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জনরোষকে কিছুটা চাপা দেওয়া যায়।

এই সেমিনারে ১৩০০ প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সংস্থা অংশগ্রহণ করেছিল। যার মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি শিল্পপতিরাও ছিলেন। আসলে যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসাই এখন ভারতীয় বৃহৎ পুঁজিমালিকদের অন্যতম প্রধান ব্যবসা হয়ে উঠছে। বিগত পাঁচ বছরে ভারত থেকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানি বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় কোম্পানিগুলি ৭৫টি দেশে প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানি করছে। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসে (এপ্রিল থেকে জুন) ভারত ১৩৮৭ কোটি টাকা মূল্যের প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানি করেছে। ভারতের প্রতিরক্ষা ও সেই সংক্রান্ত প্রযুক্তি রপ্তানির পরিমাণ ২০২১-২২ আর্থিক বছরের সর্বাধিক ১২,৮১৫ কোটি টাকা স্পর্শ করেছে।

২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে যুদ্ধাস্ত্র রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২০৫৯ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে যুদ্ধাস্ত্র রপ্তানির পরিমাণ বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় প্রায় আটগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এই সেমিনারের উদ্দেশ্য তুলে ধরে জানিয়েছেন, ভারতকে তাঁরা অতি দ্রুত আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘পথপ্রদর্শক’ করে তুলতে চান। এটাই নাকি ভারতের ‘গর্বের পথ’।

এ প্রসঙ্গে তিনি ‘নতুন বিশ্বে’ ভারতের যে বিশেষ ভূমিকার কথা বলেছেন, তা আসলে তথাকথিত একমেরু বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে বাজারের নতুন ভাগবাঁটোয়ারার মধ্যে ভারতীয় পুঁজিপতিদের লাভ নেওয়ার কথাই বলতে চেয়েছেন। বর্তমানে আমেরিকা রাশিয়া চিন জাপান অস্টে্রলিয়া ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে ভারত সরকার ব্যালেন্সের খেলার মধ্য দিয়ে দেশীয় ধনকুবেরদের জন্য বিদেশের বাজার ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য কখনও চোখ রাঙানি, কখনও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে আফ্রিকা, এশিয়া এমনকি ইউরোপেরও বাজারের ভাগ পেতে চাইছে। তাই প্রতিরক্ষামন্ত্রী আফ্রিকার ৭৫টির বেশি দেশের এই সেমিনারে অংশগ্রহণে উচ্ছ্বসিত। প্রসঙ্গত, ২০১৮ তে ভারতে অনুষ্ঠিত এমনই একটি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সেমিনারে আফ্রিকার ৫৩টি দেশ অংশ নিয়েছিল। আফ্রিকার দেশগুলিতে প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানি করাই এখন ভারতের কাছে ‘নতুন দিগন্ত’।

আর এই দিগন্ত উন্মোচনে কেন্দ্রীয় সরকার কী করছে? তারা প্রতিরক্ষা শিল্পে ৭৪ শতাংশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং সরকার প্রতিরক্ষা কারখানাগুলিতে ভারতীয় মালিকদের ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগে ছাড়পত্র দিচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ২০২৫ সালের মধ্যে ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকার প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে উৎপাদন ও ৩৫ হাজার কোটি টাকার যুদ্ধ সরঞ্জাম রপ্তানির কথা জানিয়েছেন। এ জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকেও বিনিয়োগের কথা জানিয়েছেন তিনি। বর্তমানে ৩০টি ভারতীয় প্রতিরক্ষা কোম্পানি অস্ত্র ও সরঞ্জাম রপ্তানি করছে ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া এবং আফ্রিকার নানা দেশে। এই রপ্তানির মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা, ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি, পাহারাদার জলযান, উন্নত হালকা হেলিকপ্টার, বুলেটপ্রুফ বর্ম, রেডিও সিস্টেম এবং রাডার সিস্টেম ইত্যাদি। উত্তরপ্রদেশ এবং তামিলনাডুতে কেন্দ্রীয় সরকার দুটি প্রতিরক্ষা করিডোর তৈরি করছে যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলি বিনিয়োগ করবে বলে তাদের আশা।

কিন্তু যুদ্ধাস্ত্র এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জামে এই বিপুল বিনিয়োগ সাধারণ মানুষের কোন প্রয়োজন মেটাবে? এর মধ্য দিয়ে কি দেশের জনসাধারণের প্রয়োজনীয় যথার্থ ‘আত্মনির্ভরতা’, সমৃদ্ধি আসতে পারে? বেশি পরিসংখ্যানের দরকার নেই, দেশের যে কোনও মানুষই আজ স্বীকার করবেন, ভারতের জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা আজ প্রায় নিঃশেষিত। পুঁজির শোষণে সাধারণ মানুষ আরও রিক্ত-নিঃস্ব হওয়ার পথে চলেছেন। ফলে ভারতের পুঁজিবাদী বাজারকে গ্রাস করেছে ভয়াবহ সঙ্কট। অথচ জনগণ যতই দুর্দশাগ্রস্ত হোক এই বিপুল জনসমষ্টির রক্ত চুষে এর মধ্যেই ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজি ক্রমাগত ফুলে ফেঁপে উঠছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাবে যখন দেশে কোনও শিল্পেরই বাজার নেই তখন একচেটিয়া মালিকরা সরকারের সাহায্যে বিনিয়োগ করে চলেছে প্রতিরক্ষা এবং সামরিক ক্ষেত্রে। সরকারও সামরিক খাতে ক্রমাগত ব্যয় বাড়াচ্ছে, বাড়ছে সামরিক সরঞ্জামের উৎপাদন। দেশের মানুষের দেওয়া করের টাকায় গড়া সরকারি কোষাগারের অধিকাংশটা ঢেলে সরকার সামরিক খাতে খরচ বাড়াচ্ছে, যাতে একচেটিয়া মালিকদের মুনাফা ক্রমাগত বাড়তে পারে। ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিরা বেশ কিছু সময় আগে থেকেই বিশ্বের নানা দেশে পুঁজি রপ্তানি করছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত একটি অন্যতম সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা তাদের মুনাফা অটুট রাখতে এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে ছাপিয়ে গিয়ে নিজেরাই অস্ত্র উৎপাদনে নামতে চাইছে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারই এর ক্রেতা, তাই ব্যবসায় মন্দার সুযোগ কম। একইসাথে এর মাধ্যমে তারা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী বাজারের তীব্র প্রতিযোগিতায় নিজেদের জায়গা করে নিতে রাষ্ট্রীয় সামরিক তাকত বাড়ানোর কাজে ঝাঁপাচ্ছে। অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তিই হয়ে যাচ্ছে যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ। যাকে বলা হয় অর্থনীতির সামরিকীকরণ। বিশ্বের সমস্ত পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশই এইভাবে অর্থনীতির সামরিকীকরণ করার পথে যাচ্ছে।

‘সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধের জন্ম দেয়’, মহান লেনিনের এই শিক্ষা যে কত বড় সত্য আজকের দুনিয়ার পরিস্থিতি তা আবার প্রমাণ করছে। মা’র্বাদী বিজ্ঞানকে অনুসরণ করে মহান স্ট্যালিন এবং পরবর্তীকালে মহান নেতা শিবদাস ঘোষ আরও সুনির্দিষ্টভাবে দেখিয়েছেন, বিশ্বের সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী দেশের একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের সামনে আজ বেঁচে থাকার একটাই রাস্তা খোলা আছে, তা হল, অর্থনীতির সামগ্রিক সামরিকীকরণ। এই কারণেই আজ ক্রমাগত যুদ্ধ বাধানো অথবা যুদ্ধ উত্তেজনা জিইয়ে রাখা তাদের অতি প্রয়োজন। না হলে যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসা জমবে না। একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের সেবদাস হিসাবে সমস্ত পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশের সরকারের মতোই ভারতে বর্তমান বিজেপি সরকারও এই দায়িত্ব পালনে মনোযোগী। এই প্রতিরক্ষা শিল্পে তারা কিছু কর্মসংস্থানের খোয়াব দেখাচ্ছে। এমনিতেই প্রতিরক্ষা শিল্প এখন অতি আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর। ফলে কর্মসংস্থান বিশেষ কিছু হওয়ার নয়, কিন্তু যদি হয়ও, তা হলেও কি তা দেশের মানুষের মূল প্রয়োজনগুলি মেটাতে পারে? এর জন্য যে যুদ্ধ-উত্তেজনা, সন্ত্রাসবাদের ভূতকে সরকার মদত দিয়ে চলে তাতে প্রাণ যায় কার? হয় দেশের নিরীহ সাধারণ মানুষের না হয় দরিদ্র ঘর থেকে চাকরি করতে আসা কোনও সৈনিক-জওয়ানের। আর এটাকেই দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা বলে সরকার প্রচারের ঝড় তুলে সামরিক ক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগের গল্প শোনায়।

এর ফলে একচেটিয়া মালিকদের বিপুল মুনাফা হয়। কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সামগ্রী মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। একচেটিয়া মালিকদের স্বার্থে এই পথই নিয়েছে বিজেপি সরকার। আত্মনির্ভর নয় ওদের চোখে ভারত হবে যুদ্ধ-নির্ভর, যেখানে ক্ষুধার্ত অপুষ্ট শিশু অবাক চোখে দেখবে রাইফেল, যুদ্ধ বিমান, কামানের ঝলক, কিন্তু তার পেট রয়ে যাবে খালি।