‘অগ্নিবীর’ নাম দিয়ে এঁদের শোষণ-বঞ্চনাকে চাপা দেওয়া যাবে না

অগ্নিপথ প্রকল্পে চার বছরের জন্য সেনা নিয়োগের সরকারি ঘোষণার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যে এ ভাবে যুব-বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়বে তা ছিল শাসক বিজেপি নেতাদের ভাবনার অতীত। তাঁরা ভেবে পাননি যুব সমাজের এই ক্ষোভ স্তিমিত করবেন কী ভাবে। অতীতে যা কখনও ঘটেনি তাঁরা শেষ পর্যন্ত সে পথেরও আশ্রয় নিয়েছেন– যে কাজ সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের, অর্থাৎ এই প্রকল্প সরকার কেন গ্রহণ করল তার ব্যাখ্যা শুধু যুবসমাজের কাছেই নয়, সারা দেশের মানুষের কাছেও স্পষ্ট করা, সেই কাজে তাঁরা সেনাবাহিনীর তিন শীর্ষকর্তাকে নামিয়েছেন। যাঁদের পুরোপুরি রাজনীতির বাইরে থাকার কথা, সেই সেনাপ্রধানরা রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে সরকারি এই প্রকল্পের পক্ষে সওয়াল করলেন। কিন্তু প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্যটা কী এবং যুব সমাজের ক্ষোভের প্রধান যে কারণ– চার বছরে অবসরের পর তাঁদের পরিণতি কী হবে, সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর তাঁরাও দিতে পারেননি। তাঁরা একতরফা শুধু ঘোষণা করেছেন, সেনা নিয়োগে অগ্নিপথ প্রকল্প চালু হবেই। বিক্ষোভকারীদের বিক্ষোভের কারণ খোঁজা, সেগুলিকে বোঝা এবং সেগুলির নিরসনের কোনও চেষ্টা তাঁদের বক্তব্যে ছিল না। উল্টে আন্দোলনকারী যুবকদের উদ্দেশ্যে তাঁরা হুমকি দিয়েছেন, এই প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে যাঁরা বাহিনীতে যোগ দেবেন তাঁদের মুচলেকা দিতে হবে যে, তাঁরা বিক্ষোভে অংশ নেননি। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে সেনাকর্তারা কি তা হলে সরকার-ঊর্ধ্ব ভূমিকা পালন করলেন? কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এভাবে হুমকি তাঁরা দিতে পারেন কি? কে দিল তাঁদের এই অধিকার?

সেনা প্রধানদের নামিয়েও সরকার নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। নামাতে হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে। বাবু যত না বলেন, চিরকালই পারিষদরা বলেন শতগুণ। তিনি আসরে নেমেই ঘোষণা করেছেন, কোনও ভাবেই এই প্রকল্প প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে না। যেন প্রত্যাহার করা না করাটা সরকারের নয়, তাঁরই দায়িত্ব! বিজেপি শাসনে সরকারের নীতি নির্ধারণটাও কি তবে এখন নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে নাকি? নাকি বিজেপি নেতারা সংসদ কিংবা মন্ত্রিসভারও উপরে এঁদের জায়গা করে দিয়েছেন? উত্তরটা দেশের মানুষের জানা খুবই জরুরি। দোভাল বলেছেন, অগ্নিপথ কোনও হঠাৎ করে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়। ভেবেচিন্তে নেওয়া সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই ‘ভেবেচিন্তে’ সিদ্ধান্তটি কোথায় হল, কারা নিলেন? সংসদ জানল না, অভিজ্ঞ সেনাবিশেষজ্ঞরা জানলেন না, দেশের মানুষ জানল না, তা হলে কারা ভেবেচিন্তে এমন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন?

উত্তরটা বেরিয়ে এসেছে মহিন্দ্রা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান শিল্পপতি আনন্দ মহিন্দ্রার বক্তব্যে। দেশজোড়া যুব-বিক্ষোভ চলার সময়েই তিনি টুইট করে জানিয়েছেন, এক বছর আগেই এই প্রস্তাব আলোচনার জন্য তাঁদের টেবিলে ফেলা হয়েছিল এবং তাঁরা এই প্রকল্পকে দু-হাত তুলে সমর্থন করেছেন। কিন্তু সেনাবাহিনীতে নিয়োগ কী ভাবে হবে সেই পদ্ধতিগত প্রস্তাব শিল্পপতির টেবিলে কেন? তিনি কি সেনাবাহিনীর উপদেষ্টা বা সরকারের কোনও মন্ত্রী? তেমন কোনও কিছুই তো তিনি নন। তা হলে? অবশ্য আলোচনার জন্য প্রস্তাবটি যে শুধু তাঁর টেবিলেই ফেলা হয়েছিল এমনটা নয়। প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, তাঁর মতো সমস্ত বড় বড় শিল্পপতির টেবিলেই প্রস্তাব ফেলা হয়েছিল এবং তাঁদের সবুজ সংকেত পেয়েই সরকার প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে। আরপিজি গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান শিল্পপতি হর্ষ গোয়েঙ্কা, বায়োকন-এর চেয়ারম্যান কিরণ মজুমদার শ’, অ্যাপেলো হসপিটাল গোষ্ঠীর সঙ্গীতা রেড্ডি, টাটা সন্স-এর এন চন্দ্রশেখরন সহ একচেটিয়া শিল্পপতিদের প্রায় সব গোষ্ঠীর সোৎসাহ সমর্থন এটাই প্রমাণ করছে।

সেনাবাহিনীর পুরো গঠন ও নিয়োগব্যবস্থায় এত বড় একটি পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলা হল অথচ তা নিয়ে সংসদে কিছুমাত্র বিতর্ক হল না, বিরোধীরা কিছু জানতে পারল না, দেশের মানুষ জানতে পারল না, জানল শুধু শিল্পপতিরা? তা হলে এর মধ্যে কোথায় গণতন্ত্র? বাস্তবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ছিটেফোঁটাও বিজেপি নেতাদের এই কার্যকলাপের মধ্যে নেই। তা হলে আমরা মা’র্বাদীরা যে বলি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের আড়ালে থেকে সরকারটা তথা দেশটা আসলে চালায় রাজনীতিক-শিল্পপতি-সেনানায়কদের এক শক্তিশালী দুষ্ট-চক্র, সেটাই তো অগ্নিপথ প্রকল্পের ঘটনায় আবারও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেল!

টাটা গোষ্ঠীর চন্দ্রশেখরন বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, অগ্নিপথ ভারতীয় তরুণদের জাতীয় সেনাবাহিনীতে কাজের সুযোগ করে দেওয়া ছাড়াও দেশে দক্ষ ও কুশলী একটি কর্মীবাহিনী তৈরি করবে, টাটা গোষ্ঠী-সহ কর্পোরেট সংস্থাগুলি যার সুবিধা পাবে। এই সব শিল্পগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি জানানো হয়েছে, অবসরের পর অগ্নিবীরদের নিয়োগে তাঁদের সংস্থা অগ্রাধিকার দেবে। এই প্রতিশ্রুতির কী মূল্য আছে? এখন যে সেনারা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে ৪০ বছর বয়সে অবসর নেন, এই সব শিল্পগোষ্ঠীগুলি তবে নিজ নিজ সংস্থায় তাঁদের নিয়োগ করেন না কেন? তথ্য বলছে, প্রতি বছর প্রায় ৫৫ হাজার সেনা অবসর নেন। তার মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ নানা সংস্থায় পুনর্নিয়োগের সুযোগ পান, তা-ও বেশিরভাগই নিরাপত্তারক্ষীর মতো অল্প বেতনের কোনও কাজেই। তা হলে মাত্র ৪ বছরের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাপ্রাপ্তদের কর্পোরেট সংস্থাগুলি কাজে নিয়ে নেবে এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য?

বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলির সর্বোচ্চ সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, অগ্নিবীর সেনাদের অবসর পরবর্তী চাকরির বন্দোবস্ত করার বিষয়টি নিয়ে তারা সরকারের সহযোগী হতে আগ্রহী। তাদের প্রস্তাব, কর্পোরেট নিরাপত্তার একটি ছোট কোর্সের কথা ভাবা যেতে পারে, যার মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে অগ্নিবীরদের উপযুক্ত চাকরি দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ কর্পোরেট নিরাপত্তার কথা আসছে কেন? তবে কি এখন সেনাবাহিনীকে লুঠেরা কর্পোরেটদের নিরাপত্তা-কর্মী সরবরাহের কেন্দ্র করে তুলতে চাইছে মোদি সরকার? এই একই কথাই বেরিয়ে এসেছে বিজেপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়র কথায়। বলেছেন, বিজেপি দফতরে নিরাপত্তারক্ষী রাখতে তাঁরা অগ্নিবীরদের অগ্রাধিকার দেবেন। বিজেপি নেতারা সৈনিকদের আসলে কোন চোখে দেখে তা দলের এই শীর্ষ নেতার কথাতেই স্পষ্ট নয় কি!

এ বার দেখা যাক অগ্নিপথ সেনাদের ভবিষ্যতের বিষয়টি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী থেকে সেনাপ্রধান সকলেই বলছেন, সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের প্রয়োজনে সেনাদের গড় বয়স কমাতেই এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এটিকে দেশের স্বার্থে সংস্কারমুখী জরুরি পদক্ষেপ বলে জানিয়েছেন। তা হলে এর মধ্যে কোনটি সত্য? সেনাদের গড় বয়স কমিয়ে দক্ষতা ক্ষিপ্রতা বাড়ানোই যদি সত্যি এর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, যদি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ করে তোলাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য হয়, তবে তা কি মাত্র চার বছরে সম্ভব? আর যদি তা সম্ভবও হয়, তবে দক্ষ হয়ে ওঠা সেই কর্মীদের চার বছর বাদেই ছুঁড়ে ফেলা কেন? বাহিনীর আধুনিকীকরণই যদি এই প্রকল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য হয়, তবে তার সাথে চুক্তির ভিত্তিতে ঠিকায় নিয়োগের সম্পর্ক কী এবং তাদের স্থায়ী সৈন্যের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাগুলি থেকে বঞ্চিত করার কারণই বা কী? সরকার তথা সেনাবাহিনী যদি যুবকদের যৌবনের তেজকে, তাদের ক্ষিপ্রতা, কুশলতাকে ‘দেশরক্ষার’ কাজে ব্যবহার করে, তবে তারপর তাদের এ ভাবে অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতে ছুঁড়ে ফেলাটা কি তাঁদের সাথে প্রতারণা নয়? কেন তাদের বেতন কেন্দ্রীয় সরকারের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর থেকেও কম? এককালীন যে ১১ লক্ষ টাকা তাদের চাকরি শেষে দেওয়ার কথা, কেন তা সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হবে না? কেন তাদের বেতন থেকেই কেটে নেওয়া টাকাই তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে? কেন সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মর্যাদাময় নিয়োগের গ্যারান্টি দেওয়া হবে না? প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারের কোনও নেতা-মন্ত্রীই এ সব প্রশ্নের সদুত্তর দেননি।

তা হলে তো এটা স্পষ্ট যে, বিশ্বায়ন উদারিকরণের অন্যতম শর্ত আর্থিক সংস্কারের নামে একের পর এক পুঁজিবাদী সরকারগুলি শ্রমিক-কর্মচারীদের থেকে যে-ভাবে সামাজিক নিরাপত্তা ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ছেঁটে ফেলেছে, সেই এক কায়দাতেই বিজেপি সরকার সেনাদেরও সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ছেঁটে ফেলল। তা হলে কথায় কথায় বুর্জোয়া রাষ্ট্রনায়করা যে জনগণের সামনে সৈনিকদের ‘দেশরক্ষক’, ‘দেশপ্রেমিক’ হিসাবে আখ্যায়িত করে তাদের শৌর্যের বীর্যের যশগাথা গেয়ে বেড়ান, তাদের আত্মত্যাগের মহিমা কীর্তন করেন, দুটি দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ব্যবসায়িক মুনাফার দরকষাকষির দ্বন্দে্বর পরিণতিতে যে যুদ্ধ বাধে, যা আসলে সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যেকার বাজার দখলের লড়াই ছাড়া আর কিছু নয়, তাতে মৃত্যু হলে সেই সৈনিকদের দেশের জন্য ‘মহান আত্মত্যাগী’ হিসাবে প্রচার করেন, কখনও টিভি ক্যামেরার সামনে হয়ত কয়েক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেন, সেই সৈনিকদের তা হলে পরিণতি এই? পুলওয়ামা, উরি অথবা বালাকোটে যে সৈন্যদের মৃত্যু এবং সাহসিকতাকে বিজেপি নেতারা ভোটে তাদের সুবিধার জন্য মানুষের মধ্যে আবেগ তৈরির কাজে লাগালেন, কই সেই ‘মহান সৈনিকদের’ ছিবড়ে করে ছুঁড়ে ফেলতে এখন তো সেই বিজেপি নেতাদের বিবেকে বাধছে না!

বাস্তবে অগ্নিপথ প্রকল্পের দ্বারা বিজেপি নেতারা সেনাকর্মীদের মজুরি-শ্রমিকের চরিত্রটিকে স্পষ্ট করে দিলেন, প্রমাণ করে দিলেন সেনাকর্মীরাও শোষিত শ্রমিক শ্রেণিরই অংশ। যতই বিজেপি নেতারা এই প্রকল্পে নিযুক্ত সেনাদের ‘অগ্নিবীর’ তকমা দিন, তার দ্বারা তাদের প্রতি সমাজের অন্যান্য অংশের শ্রমজীবী মানুষের মতোই চলতে থাকা শোষণ-বঞ্চনাকে ঢাকা যাবে না। এতদিন যে মহিমার চাদরে এই শোষণের চরিত্রটা ঢাকা ছিল, অগ্নিপথের মধ্যে দিয়ে শাসক বিজেপি নেতারা আজ সেই চাদরটাকেই এক টানে খুলে দিয়েছেন। বেরিয়ে পড়েছে তার নগ্ন চেহারাটা।