Breaking News

বুর্জোয়ারা ইউরোপে আড়াইশো বছরে যা করতে পারেনি, সমাজতন্ত্র রাশিয়ায় দশ সপ্তাহে তা করেছে

এ বছর মহান নভেম্বর বিপ্লবের ১০৮তম বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে বিপ্লবের চতুর্থ বার্ষিকীতে (১৪ অক্টোবর ১৯২১) মহান লেনিন-এর ভাষণের অংশবিশেষ প্রকাশ করা হল

রাশিয়ার বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ও আশু লক্ষ্য ছিল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক, অর্থাৎ মধ্যযুগীয় আদর্শ ও চেতনাকে ধ্বংস করা, রীতিনীতিকে ঝেঁটিয়ে সম্পূর্ণ বিদায় করা। মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও তজ্জনিত অবমাননা ও গ্লানি থেকে রাশিয়াকে মুক্ত করা এবং এইসব বাধা যা আমাদের সকল সংস্কৃতি ও প্রগতির পথ আটকে দিয়েছিল, তা অপসারণ করা।

এবং আমরা ন্যায্যতই এ কথা জেনে গর্ববোধ করতে পারি সেই অপসারণের কাজটি আমরা, একশো কুড়ি বছর আগে সংঘটিত মহান ফরাসি বিপ্লবের চেয়েও বেশি দৃঢ়তায় ও অনেক বেশি দ্রুততা, বলিষ্ঠতা ও সফলতার সাথে করতে পেরেছি এবং জনগণের উপর ফলাফলের দিক থেকে বিচার করলে ফরাসি বিপ্লবের চেয়েও এই কাজ বেশি ব্যাপক ও গভীরভাবে ফলপ্রসূ হয়েছে।

নৈরাজ্যবাদীরা ও পেটিবুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা (অর্থাৎ মেনশেভিক ও সোসালিস্ট রেভলিউশনারিরা) বরাবরের মতো আজও, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (অর্থাৎ সর্বহারা বিপ্লব)-এর মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে অবিশ্বাস্য রকমের বাজে কথা বলে যাচ্ছে। গত চার বছর সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করেছে যে, এই বিষয়ে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে আমাদের ব্যাখ্যা এবং পূর্বতন বিপ্লবগুলির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন কত সঠিক ছিল। আমরা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে যে ভাবে সম্পূর্ণ করেছি, তা ইতিপূর্বে আর কেউ করেনি। আমরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে সচেতন, দৃঢ় ও অবিচল ভাবে এগিয়ে যাচ্ছি এ কথা জেনেই যে সমাজতান্ত্রিক ও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে কোনও চিনের প্রাচীর নেই, এবং এ কথাও আমরা জানি (শেষ বিচারে) একমাত্র সংগ্রামই স্থির করবে কত দূর আমরা অগ্রগতি ঘটাতে পারব, এই বিপুল ও মহৎ কাজের কতটা অংশ আমরা করতে পারব, আমাদের বিজয়গুলিকে আমরা কত দূর সংহত করতে সক্ষম হব। সময়ই তা বলবে। তবে এখনই আমরা দেখছি, সমাজের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে, এই ধ্বংসপ্রাপ্ত, পরিশ্রান্ত ও পশ্চাদপদ দেশের মাপকাঠিতে, একটা বিশাল পরিমাণ কাজ সাঙ্গ করা হয়েছে।

যাই হোক, আমাদের বিপ্লবের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মর্মবস্তু সম্পর্কে আগে বলে নেওয়া যাক। এর অর্থ কী, তা মার্ক্সবাদীদের অবশ্যই বুঝতে হবে। ব্যাখ্যা করার জন্য কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।

বিপ্লবের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মর্মবস্তু বলতে বোঝায়, দেশের সামাজিক সম্পর্কগুলির (ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান) মধ্য থেকে মধ্যযুগীয় রীতিনীতি, ভূমিদাস প্রথা, সামন্ততন্ত্রকে বিদায় করা।

১৯১৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথার অবশেষগুলির প্রধান লক্ষণগুলি কী ছিল? সেগুলি ছিল রাজতন্ত্র, ভূসম্পত্তি, জমির মালিকানা ও জমি ভোগদখল ব্যবস্থা, সমাজে নারীর অধিকার, ধর্ম, জাতিগত উৎপীড়ন। এই যুগসঞ্চিত গ্লানিগুলির যে কোনও একটির কথা ধরুন, দেখবেন, আরও উন্নত রাষ্ট্রগুলি যারা একশো বা একশো পঁচিশ বছর, কি দুশো বা আড়াইশো বছর আগে তাদের দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব করেছিল, (ইংল্যান্ডে হয়েছিল ১৬৪৯ সালে) তারা ওই একটিরও প্রায় অধিকাংশটাই ফেলে রেখেছে, কিছু করেনি। আমাদের ক্ষেত্রে ওই সব যুগসঞ্চিত গ্লানিগুলির যেটার কথাই বলুন, দেখবেন, আমরা তা পুরোপুরি পরিষ্কার করে দিয়েছি। বুর্জোয়া গণতন্ত্রী ও উদারবাদীরা (ক্যাডেটস) এবং পেটিবুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা (মেনশেভিক ও সোস্যালিস্ট রেভলিউশনারি) তাদের ৮ মাস ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যা করতে পেরেছিল, আমরা অন্তত তার এক হাজার গুণ বেশি কাজ করেছি মাত্র ১০ সপ্তাহে, ১৯১৭-এর ২৫ অক্টোবর (৭ নভেম্বর) থেকে ১৯১৮-র ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালে যখন কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, ওই সব কাপুরুষ বাক্যবাগীশরা হাওয়ায় তাদের কাঠের তরোয়াল ঘুরিয়েছে, কিন্তু এমনকি রাজতন্ত্রকেও ধ্বংস করেনি।

আমরা যে ভাবে ওই সব রাজতন্ত্রীয় পাঁক ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছি, ইতিপূর্বে অন্য কেউ তা পারেনি। সোসাল এস্টেট ব্যবস্থার (জমির মালিকানা ও ভোগস্বত্বের একটি বিশেষ রুশীয় ব্যবস্থা) মতো প্রাচীন কাঠামোর এক টুকরো পাথর কিংবা একটা ইটও আমরা ছাড় দিইনি (এমনকি ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো সবচেয়ে অগ্রসর দেশগুলিও আজও পর্যন্ত এই ব্যবস্থার অবশেষগুলিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে পারেনি)। জমির মালিকানা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সামন্ততন্ত্র ও ভূমিদাস প্রথার মধ্য দিয়ে ‘সোসাল এস্টেট সিস্টেম’-এর যে শিকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত ছিল, আমরা তার গোড়া পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছি। ‘‘কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে’’ (ক্যাডেট, মেনশেভিক ও সোসালিস্ট রেভলিউশনারিদের মধ্যে বিদেশে থাকা বিস্তর মানুষ রয়েছে এমন প্রশ্ন তোলার) যে, মহান অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কার্যকর করা কৃষি-সংস্কারের ‘শেষপর্যন্ত’ পরিণাম কী হবে। এই বিতর্কে সময় নষ্ট করার কোনও ইচ্ছা এই মুহূর্তে আমাদের নেই। কারণ এই বিতর্ক ও তার সঙ্গে আরও বহু অসংখ্য প্রশ্নের মীমাংসা আমরা সংগ্রামের দ্বারা করছি। কিন্তু এ সত্য অস্বীকার করা যাবে না যে, পেটি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা যে আট মাস ক্ষমতায় ছিল, তারা জমিদারদের সাথে, ভূমিদাসত্বের ঐতিহ্যের পাহারাদারদের সাথে ‘আপস’ করেছিল, যেখানে আমরা মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জমিদারকুল ও তাদের ঐতিহ্যসমূহকে রাশিয়া থেকে পুরোপুরি বিদায় করে দিয়েছি।

ধর্মের কথা অথবা নারীদের অধিকার অস্বীকার করার কথা, অথবা অ-রুশীয় ন্যাশনালিটিগুলির প্রতি উৎপীড়ন ও অসাম্যের কথাই ধরুন। এগুলি সবই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমস্যা। বাক্যবাগীশ পেটিবুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা এ বিষয়ে আট মাস ধরে কেবল কথাই বলে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর দেশগুলির কোনও একটিতেও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আইনে এইসব প্রশ্নগুলির সম্পূর্ণ মীমাংসা করা হয়নি। আমাদের দেশে অক্টোবর বিপ্লবের আইন দ্বারা এগুলির সম্পূর্ণ মীমাংসা করা হয়েছে। আমরা ধর্মের বিরুদ্ধে আন্তরিকভাবে লড়াই করেছি ও করে যাচ্ছি। আমরা সকল অ-রুশ জাতিগুলির জন্য তাদের নিজস্ব প্রজাতন্ত্র অথবা স্বশাসিত অঞ্চল অনুমোদন করেছি। নারীদের অধিকারগুলি বাতিল করার বা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যের কুখ্যাত ব্যবস্থা, যা সামন্ততন্ত্র ও মধ্যযুগীয় রীতিনীতির অরুচিকর অবশেষ, তা টিকে থাকার মতো সমাজভিত্তি ও উপায় রাশিয়ায় আর নেই। অথচ এই কুৎসিত ব্যবস্থাগুলিই এখন অতিলোভী বুর্জোয়া শ্রেণি এবং নির্বোধ ও ভয়ার্ত পেটিবুর্জোয়ারা বিশ্বের অন্যান্য প্রতিটি দেশেই নতুন চেহারায় খাড়া করছে।

এগুলিই হল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মর্মবস্তু। একশো, দেড়শো, দুশো বা আড়াইশো বছর আগের ওই বিপ্লবের (অথবা যদি আমরা একই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে এক একটি দেশের জাতীয় বৈচিত্র্য অনুযায়ী আলাদা আলাদা হিসাবে ধরি, তবে ওই বিপ্লবগুলির) প্রগতিশীল নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা মানবজাতিকে মধ্যযুগীয় সুবিধা ভোগের অন্যায় ব্যবস্থা থেকে মুক্ত করবেন, নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করবেন, কোনও না কোনও ধর্মের প্রতি (বা সাধারণভাবে ধর্মীয় ধ্যানধারণা, চার্চ প্রভৃতির প্রতি) রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার অবসান ঘটাবেন। প্রতিশ্রুতি দিলেও ওই নেতারা তা পালন করেননি বা করতে পারেননি। তাঁদের বাধা হয়েছে ‘‘ব্যক্তিসম্পত্তির পবিত্র অধিকার’’-এর প্রতি ‘‘সম্মান’’। কিন্তু বারবার অভিশাপগ্রস্ত মধ্যযুগীয় ব্যবস্থাদির প্রতি, ‘‘ব্যক্তিসম্পত্তির পবিত্র অধিকারে’’-র প্রতি ‘‘সম্মান’’ প্রদর্শনের অভিশাপ আমাদের সর্বহারা বিপ্লবকে ক্লিষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্যগুলিকে রাশিয়ার জনগণের জন্য সংহত করতে আমাদের আরও পথ পাড়ি দিতে হত এবং আমরা তা দিয়েছিও। আমাদের প্রধান কর্তব্য তথা যথার্থ সর্বহারা বৈপ্লবিক, সমাজতান্ত্রিক কার্যাবলি পূরণ করার পথে, তার (‘বাই প্রোডাক্ট’) উপজাত বিষয় হিসেবেই আমরা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমস্যাগুলির সমাধান করেছি। আমরা বরাবর বলেছি, সংস্কার (রিফর্মস) হচ্ছে বিপ্লবী শ্রেণিসংগ্রামেরই একটি ‘বাই প্রোডাক্ট’।

আমরা বলেছিলাম এবং কাজের দ্বারা প্রমাণ করেছি– বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংস্কারগুলি হচ্ছে সর্বহারা বিপ্লব, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি বাই-প্রোডাক্ট। কিন্তু কাউটস্কি, হিলফারডিং, মার্টভ, চারনভ, হিলকুইটস, লঙ্গেটস, ম্যাকডোনালডস, তুরাটিস ও অন্যান্যদের মতো ‘‘আড়াই হাত’’ মার্ক্সবাদের বীর প্রতিনিধিরা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ও সর্বহারা-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যকার সম্পর্ক বুঝতে অপারগ ছিলেন। প্রথমটা বিকাশের পথে দ্বিতীয়টায় পরিণত হয়। দ্বিতীয়টা এগোবার পথে অনুষঙ্গের মতো প্রথমটার সমস্যাগুলির সমাধান করে। দ্বিতীয় বিপ্লব প্রথমটাকে কতদূর ছাপিয়ে যেতে পারবে, একমাত্র সংগ্রামই তা নির্ধারণ করে দেবে। (চলবে)