Breaking News

ট্রাম্প বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল আমেরিকা

ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ লস এঞ্জেলেসে

রবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস, আগুন। লস এঞ্জেলেসের রাজপথ উত্তপ্ত। মাত্র কিছুদিন আগেই আগুন ছড়িয়েছে লস এঞ্জেলেস থেকে নিউইয়র্ক, টেক্সাস, সানফ্রান্সিস্কো, শিকাগো, সিয়াটেল প্রভৃতি বড় বড় শহরে। ন্যাশনাল গার্ড, অর্থাৎ আমেরিকান সেনার রিজার্ভ বাহিনী রাজপথ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।

ট্রাম্পের কড়া অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিক্ষোভ ছড়িয়েছে আমেরিকার শহরে শহরে। গত নির্বাচনে জেতার জন্য এই নীতিকেই তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টের গদিতে বসার পর কড়া হাতে এই নীতিকে কার্যকর করার কাজে তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন। কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে এখানেই।

একটা ঘটনার সাহায্যে তা বোঝা যেতে পারে। এক সময় ট্রাম্প সমর্থক ছিলেন লিয়ান পেজ। তিনি প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হন কিউবান তরুণ, ২৮ বছর বয়সী আলিয়ান মেন্ডেজ আগুইলার-এর সাথে। ২০১৯ সালে আলিয়ান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং সমস্ত আইন মেনেই ওই দেশে বসবাস শুরু করেন ও লিয়ানকে বিয়ে করেন। আলিয়ান তাঁর স্ত্রী ও তাঁর আগের পক্ষের প্রতিবন্ধী বড় ছেলের যত্ন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং তাঁদেরও বর্তমানে তিন বছরের এক শিশুকন্যা আছে। কিন্তু বর্তমানে ট্রাম্পের কড়া অভিবাসন নীতির ফলে এ বছরের ২৪ এপ্রিল আলিয়ানকে কিউবা ফেরত পাঠানো হয়। স্বভাবতই লিয়ান, তাঁর প্রতিবন্ধী ছেলে ও শিশুকন্যাকে নিয়ে কী ধরনের সঙ্কটে মধ্যে পড়তে পারে বুঝতে অসুবিধা হয় না। এই অভিবাসন নীতি যখন ঘোষণা হয়, লিয়ানের় ধারণা ছিল, এটা কেবল অপরাধীদের বহিষ্কার করতে কার্যকরী হবে। তাঁর স্বামী আলিয়ানের অপরাধমূলক কোনও ইতিহাস নেই। তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়েই ট্রাম্পকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে সমর্থন করেছেন। জনগণের নূ্যনতম চাহিদাগুলি পূরণে ব্যর্থ পুঁজিবাদী শাসকরা জনরোষ থেকে বাঁচতে কখনও সংকটের দায় চাপায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির ঘাড়ে, কখনও অভিবাসীদের ঘাড়ে। তারা যে পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস, জনগণের দুর্দশার জন্য সেই শ্রেণির ভূমিকাকে আড়াল করে, জনগণের এক অংশকে অপর অংশের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিয়ে নির্বাচনী লড়াইতে উৎরে যাওয়ার কৌশল নেয়। ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাদের আসল চেহারা প্রকাশ পায়। জনস্বার্থের নামে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিয়ে আসলে তারা জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাদের উপর জনবিরোধী নীতি চাপিয়ে দেয়। বর্তমানে আমেরিকায় যে বিক্ষোভের আগুন শহর থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে তার পিছনে লিয়ান-আলিয়ানদের মতো এরকম অসংখ্য দুঃখজনক অমানবিক ঘটনা আছে। বিক্ষোভকারীরা কেন এত মরিয়া, কেন তারা ট্রাম্পের পুলিশ মিলিটারির অত্যাচারকেও পরোয়া করছে না তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে দেশের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)-এর কাজকর্ম এমনই আতঙ্ক ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে যে, ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে, কারণ স্কুলের পার্কিং থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার তারা প্রত্যক্ষদর্শী। আসন্ন সন্তানসম্ভবা মহিলাকে পর্যন্ত তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাচ্চাদের় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। অভিবাসন নীতি কার্যকর করার নামে, বেআইনি অভিবাসী আখ্যা দিয়ে যে কোনও সময় যে কোনও জায়গা থেকে, যে কোনও পরিস্থিতিতে মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ফলে, সাধারণ মানুষের মনে একটা তীব্র ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। যারা ইতিমধ্যে ভুক্তভোগী তারা ছাড়াও যে অসংখ্য মানুষ জীবন জীবিকার সন্ধানে কোনও না কোনও সময় মার্কিন সরকারের অনুমতিক্রমে কারখানা, হাসপাতাল, সাফাই কর্মী, রেস্টুরেন্ট কর্মী, মেকানিক সহ নানা বৃত্তির কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন, এমনকি ভোটদানের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করেছিলেন তাঁরা আজ এই সঙ্কটের সম্মুখীন। বছরের পর বছর এই সব শ্রমিকদের সস্তা শ্রম কাজে লাগিয়ে আমেরিকার পুঁজিপতি শ্রেণি লাভের পাহাড় গড়েছে, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে, দেশে দেশে পুঁজির দাপট বাড়িয়েছে। নিজের দেশে অর্থনীতির সামরিকীকরণ করেছে। চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদের জমি প্রস্তুত করেছে। কিন্তু পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ তীব্র সঙ্কট ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। এতদিন ‘সিবিপিআই” অ্যাপের মাধ্যমে অন্য দেশের মানুষদের দেশে ঢুকতে দেওয়া, আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করার কাজ চালাতো আমেরিকা। অভিবাসন নীতি প্রয়োগের প্রথম ধাপেই সেই অ্যাপটি বাতিল করে দেওয়া হয়। এমনকি ট্রাম্প, এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্টে্রর দক্ষিণ সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি ও অভিবাসীদের সীমান্ত অতিক্রম বন্ধ করার জন্য সামরিক বাহিনী ব্যবহার করা শুরু করেছেন। এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া আমেরিকার প্রশাসনের আর যেন কোনও উপায় নেই। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের অমোঘ সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে আজ আরও প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রমিক সংখ্যা কমাতে চায়। যে সকল মানুষের সস্তা শ্রমের বিনিময়ে দুহাত ভরে বিপুল মুনাফা অর্জন করেছে, আজ সে যথেচ্ছ এ আই ব্যবহারের দিকে এগোচ্ছে। কোনও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে শ্রমিক ছাঁটাই করছে। এতদিন যে মানুষদের সস্তা শ্রমকে নিংড়ে কাজে লাগিয়েছে, প্রয়োজনে আশ্রয় দিয়েছে আজ সেই মানুষগুলো হয়ে পড়েছে সমাজের বোঝা! তাই ট্রাম্প চান, ‘অচিরেই এই জঞ্জালমুক্ত করতে’। তাঁর সাফ জবাব, লস এঞ্জেলেসকে আবার ‘শান্তিপূর্ণ পরিষ্কার শহর’ করে তুলতে চান তিনি।

বিরোধীদের সমালোচনায় ও আজ তিনি দমছেন না। উল্টে হুমকি দিচ্ছেন, ‘সেনাদের গায়ে যদি থুতু ছেটাও, আমরাও মারতে দ্বিধা করবো না’। যে কোনও মূল্যে এই বিক্ষোভকে দমন করতে তিনি বদ্ধপরিকর। আবার মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দেশের নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার দুর্নীতির খেলাও চলছে তলে তলে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি দেশে দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়ে, যুদ্ধের ইন্ধন জুগিয়ে নিজের দেশের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভকেও আজ প্রশমিত করতে পারছে না।

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা  ২৭ জুন – ৩ জুলাই ২০২৫ এ প্রকাশিত