ক্রিকেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষার বলি হল ১১টি তরুণ প্রাণ

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র বছর কুড়ির ভূমিক, বাবাকে না জানিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল তার প্রিয় ক্রিকেটারদের এক ঝলক দেখবে বলে। কিন্তু বাড়ি আর ফেরা হল না। মৃত ভূমিকের বাবা আর্ত চিৎকার করে পুলিশকে বলছেন, ‘ওর শরীরটাকে পোস্টমর্টেম কোরো না। আমাকে অন্তত ওর দেহটা ফিরিয়ে দাও। আমার একটাই ছেলে। আমি এখন বাঁচব কী করে’? শুধুমাত্র ভূমিক নয়, আইপিএল চ্যাম্পিয়ন রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (আরসিবি)-র বিজয় মিছিল দেখতে এসে ৪ জুন ব্যাঙ্গালোরের চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের কাছে ভিড়ের পায়ে পিষে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে চলে গেল ১১টি তাজা প্রাণ। এর মধ্যে ১৩ বছরের নাবালিকা সহ পাঁচজনের বয়স কুড়ির মধ্যে। বাকিরাও সকলেই তরতাজা যুবক। আহত ৪৭।

এই মৃত্যু কি অবশ্যম্ভাবী ছিল? অবশ্যই না। খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই দুঃখজনক ঘটনাটি রোধ করার সমস্ত উপায় সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনের হাতে ছিল। ঠিক কী হয়েছিল সে দিন? ১৭ বছর পর আরসিবির আইপিএল জেতাকে সামনে রেখে গোটা ব্যাঙ্গালোর জুড়ে উন্মাদনা তৈরির সমস্ত চেষ্টা চালিয়েছে আরসিবি কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি কর্ণাটক সরকার নিজেও। ৪ জুন আরসিবি বিধানসভা ভবন ‘বিধানসৌধ’ থেকে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম পর্যন্ত বিজয় মিছিল ও বিনামূল্যে পাস পাওয়ার কথা প্রচার করে।

এ দিকে ট্রফি জয়ের উল্লাসের স্রোতে শামিল হয়ে রাজ্যের যুবসমাজের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার সুযোগ ছাড়তে চায়নি কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার। তাই তাদের পক্ষ থেকে বিধানসৌধে খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা দিতে উপস্থিত হন রাজ্যপাল সহ মুখ্যমন্ত্রী ও উপমুখ্যমন্ত্রী। সেখানে ক্রমাগত ভিড় বাড়তে থাকে এবং সেই ভিড় ক্রমে বিপুল চেহারা নিয়ে স্টেডিয়ামের গেটে আছড়ে পড়ে। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে প্রবল বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, অনেকে পড়ে যান ও পদপিষ্ট হয়ে ১১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

৪ জুন অনুষ্ঠানের আগে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকেও এত কম সময়ে এত বড় অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জোরের সঙ্গে আপত্তি জানানো হয়নি। এক পুলিশ কর্তা মন্তব্য করেছেন, বিজয় মিছিলের সিদ্ধান্ত বাস্তবে একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, যা আটকানোর ক্ষমতা পুলিশের ছিল না।

অথচ এই উৎসব কয়েকদিন পরে করলে উত্তেজনার পারদ অনেক স্তিমিত হত এবং উৎসবও অনেক বেশি পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত হত। ব্যাঙ্গালোর পুলিশের পক্ষ থেকে তা নাকি বলাও হয়েছিল। কিন্তু সরকার সেই পরামর্শ শোনেনি। আসলে সমস্ত বেনিয়ম দেখেও রাজ্য সরকার তার রাজনৈতিক ফয়দার জন্য এই অনুষ্ঠানকে কার্যত সরকারি অনুষ্ঠানে পরিণত করেছিল। আর তাই রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী নিজে গাড়িতে বেসরকারি কোম্পানি আরসিবি-র পতাকা উড়িয়ে বিমানবন্দরে টিমকে স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন। জনপ্রিয় হওয়ার লোভে প্রস্তুতিহীন অবস্থায় এত বিপুল সংখ্যক লোকের হুল্লোড়ের পরিণাম কী হতে পারে সে সম্বন্ধে মুখ্যমন্ত্রীও ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি।

আরসিবি চেয়েছিল তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়িয়ে আরও রোজগারের জন্য উৎসবের নামে হুল্লোড় পরের দিনই করতে। কিন্তু সরকার কেন তাতে মেতে উঠবে? কেন তাকে সরকারি অনুষ্ঠানে পরিণত করবে? ফলে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর দায় কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার কোনও মতেই এড়াতে পারে না। সরকার না চাইলে আরসিবি কর্তৃপক্ষ ৪ জুন সকাল থেকে সমাজমাধ্যমে কী করে বিজয় মিছিল হওয়ার কথা ঘোষণা করে ক্রিকেট ভক্তদের মাতাতে পারল?

উৎসবের নামে উন্মাদনা তৈরির এই সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছে, যারা তাতে সম্মতি দিয়েছে, প্রশাসনিক সাহায্য করেছে, সামাজিক মাধ্যমে পরের পর পোস্ট করে যারা মানুষের উত্তেজনার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে রাস্তায় টেনে এনে নামিয়েছে এই ঘটনার, এই মৃত্যুর সমস্ত দায়ভার তো তাদেরই। অথচ আরসিবি মৃতদের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ধরিয়ে দিয়ে দায় সেরেছে। সরকারও ব্যাঙ্গালোর পুলিশের কয়েকজন কর্তাকে সাসপেন্ড করে এতবড় ঘটনার দায় ঝেড়ে ফেলেছে।

আরও জানা গেছে, চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে যখন ক্রিকেট ভক্তদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, ভিতরে তখন উৎসব কিন্তু চলছিল। সাধারণ মানুষের আজ একটাই প্রশ্ন– কোনও বিজয়োৎসব কি মানুষের প্রাণের থেকেও বেশি মূল্যবান? তা না হলে মৃত্যুসংবাদ জানার পরও কি করে বিজয়োল্লাস চলতে পারল? বুঝতে অসুবিধা হয় না ক্রিকেট আজ পুরোপুরি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আর আইপিএল হল ক্রিকেটকে সামনে রেখে বেসরকারি মালিকদের হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা লোটার সব থেকে বড় প্রতিযোগিতা। সমস্ত টিমগুলোর মালিক হল বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা ও ধনকুবেররা। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের স্থানীয় মানুষের আবেগকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করার জন্যই আইপিএল টিমের নামের সঙ্গে শহর বা রাজ্যের নাম যুক্ত করা হয়। এর সঙ্গে সেই নির্দিষ্ট রাজ্যের ক্রিকেটের কোনও স্বার্থ যুক্ত নেই। একটি রাজ্যের ক্রিকেট পরিচালন সংস্থার টিম সেই রাজ্যের মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী ক্রিকেট টিম। অথচ সেই টিম যখন রঞ্জি ট্রফি খেলে তখন আমরা সংবাদমাধ্যমকে এমন উন্মাদনা তৈরি করতে দেখি কি? আসলে ক্রিকেটের মতো জনপ্রিয় একটি খেলায় রাজ্যের নামে সমর্থক তৈরি আর তাদের উল্লসিত করার নেশায় না মাতালে আইপিএল-ব্যবসা সাফল্যের শিখরে ওঠে না, অর্থলগ্নিও সর্বাঙ্গ সার্থক হয় না। সুতরাং সীমাহীনভাবে সুস্থতার দিগন্ত ছাপিয়ে যায় বিজ্ঞাপন।

খেলা নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা আগে থাকলেও এই মাত্রাহীন উন্মাদনা ব্যবসায়িক স্বার্থে প্রচারমাধ্যমের দান। শুধু খেলার নামে ব্যবসার জন্যই নয়, কর্পোরেট অর্থে পুষ্ট মিডিয়া যুবসমাজের মধ্যে খেলা নিয়ে উন্মাদনা তৈরি করে, যাতে তারা জীবন-জীবিকার মূল সমস্যাগুলি ভুলে এই নিয়েই মেতে থাকে। এই মুনাফা শিকারিরাই ক্রিকেটারদের হিরো বানায়। এই সব হিরোরা সুস্থ জীবনের সন্ধান না দিয়ে কোটি কোটি টাকা নিয়ে দেশের যুব সম্প্রদায়কে আমন্ত্রণ জানায় ফ্যান্টাসি অ্যাপের জুয়া খেলতে, মাদকের নেশায় মেতে উঠতে।

খেলা শেষ হল। আইপিএল রোজগার করল ১২ হাজার কোটি টাকা। প্রতিযোগিতার স্পনসর টাটা গ্রুপ রোজগার করল ৫০০ কোটি টাকা। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো প্রায় ৩০৭ কোটি আর সমস্ত দল মিলিয়ে ৬৭৯৭ কোটি টাকা আয় করল। ট্রফি জেতার জন্য আরসিবি পেল কুড়ি কোটি টাকা আর তার কোম্পানির শেয়ার-মূল্য ২০০০ কোটি টাকার ওপর চলে গেল। ক্রিকেটাররা কোটি কোটি টাকা রোজগার করল। আর আপনি আমি কী পেলাম? ১১ জনের মৃত্যু, কিছু দুঃখপ্রকাশ করা টুইট, ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ আর সবটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য একটা তদন্ত কমিটি!

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা  ২০ – ২৬ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত