এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে উত্তর কলকাতার একটি স্কুলে। বাথরুমের কাছ থেকে হঠাৎ ভেসে এল চিৎকার। সবাই ছুটে গিয়ে দেখলেন, দুই ছাত্রের তুমুল ঝগড়া। শুধু গালিগালাজ, হাতাহাতিতে ঝগড়া শেষ হয়নি, একজন প্রবল রাগে সামনে পড়ে থাকা ভাঙা টিনের কৌটো তুলে ছুঁড়ে মেরেছে আরেক জনের মুখে, রক্তারক্তি কাণ্ড। পুলিশ, ফার্স্ট এইড, বোর্ডে খবর দেওয়ার পালা চুকলে সেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করা হল, মারপিট করলে কেন? মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে এসে এরকম করছ, লজ্জা করে না? ছেলেটি প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, ঝগড়া শুরু করেছে অন্যজন, সে গালাগাল দেওয়ায় ওর রাগ হয়ে যায়। তারপর একটু চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, সরি স্যার, আমার ভুল হয়ে গেছে, আসলে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।
একজন শিক্ষক বলছিলেন, ‘এদের মধ্যে এত রাগ, এত ক্ষোভ জমে আছে, সামান্য সুযোগ পেলেই সেটা ফেটে পড়তে চায়, আসলে কী জানেন, এদের কথা শোনার মতো কেউ নেই’। শিক্ষকতা বা অন্য কোনও পেশায় যাঁরা এমন কমবয়সি ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা জানেন এ কত বড় সত্যি। আমাদের চোখের সামনেই ক্রমশ বেড়ে উঠছে এক প্রজন্ম, সকলের মাঝে থেকেও যারা ভয়ঙ্কর রকমের একা, ওই ছেলেটির মতোই যারা নিজেদের কন্ট্রোল করতে পারছে না। একটু গভীরে ভাবতে গেলেই নজর পড়বে সমাজের একেবারে গোড়ায়, যেখানে পচন ধরলে স্বাভাবিক মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াই নষ্ট হয়ে যায়।
এই দুটি ছেলে এসেছে একেবারে সাধারণ দরিদ্র পরিবার থেকে। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা, পরিবারের আর্থিক সমস্যা, আশৈশব স্নেহ-ভালোবাসা-যত্নের অভাব, জীবনের সর্বত্র ব্যর্থতা আর অপারগতার জ্বালা, দিশাহীন ভবিষ্যৎ– এমন অজস্র কারণ রয়েছে এদের ধৈর্যহীন আচরণের পিছনে। কিন্তু এ জিনিস শুধু দরিদ্র পরিবারের মধ্যে ঘটছে এমন নয়। বিগত কয়েক বছরে কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে আমাদের দেশে। তার প্রকৃতিও হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর। যার কাছে এই মারামারি নেহাত তুচ্ছ ঘটনা মনে হতে পারে। ঝগড়া, বিবাদ বা কোনও জিনিসের মালিকানা নিয়ে হাতাহাতির জেরে বন্ধু বন্ধুকে আহত করছে এমনকি মেরেই ফেলছে, নিজের শখ মেটানোর জন্য আরও টাকা লাগবে বলে পরিকল্পনা করে খুন, অপহরণ এমনকি কিডনি বিক্রি করা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে কেউ কেউ। নিজের ইচ্ছে বা চাহিদা না মেটার রাগে, এমনকি মা-বাবা বকলে তার প্রতিক্রিয়াতেও নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছে অথবা মারমুখী হয়ে উঠছে, নম্বর না পাওয়ার রাগে বা শাসনের প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শারীরিক এবং মানসিক আক্রমণ করছে– এমন ঘটনা এখন আর বিরলের মধ্যে বিরলতম বলা যাবে না। যেখানে অবস্থা সচ্ছল বা ধনী, মা-বাবা সর্বক্ষণ না চাইতেই হাতের কাছে সাজিয়ে রাখছেন সন্তানের পছন্দের সব উপকরণ, অভাব জিনিসটা কী আদৌ না জেনেই যারা বড় হচ্ছে, এই অসুস্থ মানসিকতার প্রকোপ সেখানেও বেশি বই কম নয়।
এনসিআরবি-র তথ্য বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৪-র মধ্যে দেশে নাবালকদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ বেড়েছিল ৪৭ শতাংশ। বিগত দশ বছরে বেড়েছে আরও বেশি, ৬০ শতাংশ। ২০১৩ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ভারতে খাতায় কলমে নথিভুক্ত এই ধরনের অপরাধের সংখ্যা তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার একশো আটষট্টি, যার মধ্যে দেশের তেরোটি রাজ্যেই অপরাধের সংখ্যাটা দশ হাজারের বেশি। ২০২২– এই একটি বছরের মধ্যে দেশে কিশোর বয়সীদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা তিরিশ হাজার পাঁচশো পঞ্চান্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, ৪০টি উন্নয়নশীল দেশে শতকরা ৪২ ভাগ ছেলে এবং ৩৭ ভাগ মেয়ে সহপাঠীদের হাতে পীড়ন বা বুলিং-এর শিকার হয়। ২০২৩-এ একটি গবেষণামূলক পত্রিকা ৪৬৩ জন ভারতীয় ছাত্রের ওপর সমীক্ষা করে এবং তাদের অর্ধেকেরও বেশির মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ দেখা যায়। এসব পরিসংখ্যানের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে দিশেহারা লাগে। সমাজের যে অংশটাকে আমরা বলি ভবিষ্যতের নাগরিক, যাঁদের নিয়ে নজরুল লিখেছিলেন – ‘মোদের চোখে বিশ্ববাসীর স্বপ্ন দেখা হোক সফল’, যাদের হওয়ার কথা ছিল সবচেয়ে সংবেদনশীল, অনুভূতিপ্রবণ, দায়িত্বশীল, তারা এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? শারীরিক হেনস্থা, খুন জখম থেকে শুরু করে গণধর্ষণ পর্যন্ত এমন কোনও ঘৃণ্য অপরাধ নেই, যার সাথে যুক্ত নেই নাবালকদের নাম। খাতায় কলমে যাকে অপরাধ বলে, তার বাইরেও প্রতিনিয়ত এমন অনেক কিছু ঘটছে যাকে চূড়ান্ত অসংবেদনশীলতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। যেমন, অতি সম্প্রতি মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষে বইয়ের পাতা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে রাস্তায় ছড়িয়েছে একদল ছাত্রছাত্রী, এটাই নাকি তাদের আনন্দের উদযাপন!
কারণ অনেক, সেসব কারণ ধরিয়ে দিয়ে বারবার সতর্কও করছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন, নিউক্লিয়ার পরিবার, মা-বাবা সারাদিন কাজে ব্যস্ত, দাদু-ঠাকুমার সাহচর্য নেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এর সাথে যুক্ত হয়েছে স্মার্টফোনের অনন্ত হাতছানি। বিশেষ করে কোভিডের পরে নানা কারণে এই স্মার্টফোন জিনিসটা একেবারে ঘরে ঘরে বাচ্চাদের হাতেও পৌঁছে গেছে সর্বনাশা মাদকের মতোই। সেখানে একটি বাচ্চা কী দেখছে, কতক্ষণ দেখছে– তার ওপর দরকারি নজরদারি থাকছে না বহু ক্ষেত্রেই। শুধু তাই নয়, ফোনের স্ক্রিনে ডুবে থাকতে থাকতে শিশু-কিশোরদের মনোজগৎ ছেয়ে থাকছে ভার্চুয়াল দুনিয়া। পাশের মানুষটির সাথে স্বাভাবিক সংযোগ, কথাবার্তা, রাগ-দুঃখ-অভিমান-বন্ধুত্বের যে বাতাবরণ একটা মানুষের গড়ে ওঠার জন্য জরুরি, ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা ভীষণ ভাবে বঞ্চিত হচ্ছে তার থেকে। গল্প শোনার সুযোগ নেই, গল্পের বইয়ের জগত নেই, খেলার মাঠ নেই, খেলার সঙ্গী নেই, শরীর-মনের শক্তি আর আবেগ সুস্থ ভাবে ব্যয় হওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ। অন্য দিকে যে কোনও উপায়ে ইঁদুর দৌড়ে অন্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়াকেই চেনানো হচ্ছে জীবনের সাফল্য বলে। চেনাচ্ছে এই রাষ্ট্র, এই সমাজ, সর্বক্ষণের বিজ্ঞাপন, মিডিয়া, স্কুল-কলেজের আলোচনা। আর এসব জিনিসকে চালায় কারা? কী উদ্দেশ্য কাজ করে তার পেছনে?
সকলেই জানেন, এসবের পেছনে আসল পরিচালক হল দেশ-বিদেশের ধনকুবের গোষ্ঠী, রাজনীতির পরিভাষায় যাদের বলে পুঁজিপতি শ্রেণি। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এইসব শব্দগুলো শুনলেই কেউ কেউ ভাবেন, এই রাজনীতির আলোচনায় আমি নেই। কিন্তু বাস্তবে চাইলেও এর বাইরে থাকার ক্ষমতা কারও নেই। ধনী-দরিদ্রের তীব্র বৈষম্যের ওপর গড়ে ওঠা এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, এই মুনাফাসর্বস্ব অর্থনীতি শুধু যে মানুষকে আর্থিক ভাবে নাচার, দরিদ্র করে তাই নয়, সে আক্রমণ করে মনুষ্যত্বকেও, মানুষে মানুষে স্বাভাবিক সম্পর্ককেও। কীভাবে? এই সমাজে প্রতিটি মানুষ অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। ছোট থেকেই শেখানো হয়, অন্যকে টপকে যেতে না পারলে, তাকে দৌড় থেকে সরিয়ে দিতে না পারলে তোমার সাফল্যের আশা নেই। এর উপযোগী মন তৈরি করতে মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকেই মারার আয়োজন করে শাসক শ্রেণি। একদিকে ঢালাও মদের লাইসেন্স, পর্ন সাইটের রমরমা, নারীদেহের পণ্যায়নের মতো মানুষকে অমানুষ বানানোর উপকরণ সর্বত্র ছড়ানো। বেকারি, চাকরির অনিশ্চয়তা বা কর্মক্ষেত্রের অন্যায় শোষণ, সম্পর্কের ভাঙন, বিশ্বাসহীনতা এমন আরও হাজারো সমস্যা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে মানুষকে। যে কোনও ভাবে এই সমস্যার বেড়াজাল কেটে বেরোবার মরিয়া চেষ্টায় বড়োরাও দিশেহারা, কিছুটা অসহায়। তাই পরীক্ষার নম্বর আর চাকরির দৌড়ের বাইরে কোনও জীবন তৈরি হচ্ছে না আজকের ছোটদের। পরাজয় বা প্রত্যাখ্যানকে তারা জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে মেনে নিতে শিখছে না, সাময়িক ব্যর্থতা তাদের মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। ন্যায়-অন্যায় উচিত-অনুচিতের পাঠ ছাড়াই এক অদ্ভুত আত্মকেন্দ্রিকতার আবর্তে বড় হয়ে তারা পা দিচ্ছে কৈশোরে, যৌবনে, যার ভয়ঙ্কর পরিণাম দেখা যাচ্ছে সমাজ জুড়ে। বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের পরিচালকরা চায় না মানুষ এসব নিয়ে ভাবুক, মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে বড় হয়ে উঠুক। তারা চায় কিছু বিবেক-মনুষ্যত্বহীন যন্ত্র তৈরি করতে, যারা শুধু এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য মুখ বুজে কাজ করে যাবে। সচেতন হয়ে, সচেষ্ট হয়ে এই বিপর্যয় কিছুটা আটকানো যেতে পারে নিশ্চয়ই। কাউন্সেলিং এবং চিকিৎসাও অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এর উৎস আছে যেখানে, তার নিরাময় বা সমাধান এই সমাজব্যবস্থার মধ্যে হতে পারে না। এর সমাধানের পথ দেখিয়েছিল একমাত্র সমাজতন্ত্র, যৌথ শ্রমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজ।
১৯১৭-তে বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে রাশিয়ায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পাল্টে প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় তখন চলছে অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টে যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠার লড়াই, অন্যদিকে সেই নতুন সমাজের উপযুক্ত করে নতুন মানুষ গড়ে তোলার সংগ্রাম, বিপ্লবের চেয়ে যা কোনও অংশে কম কঠিন বা কষ্টসাধ্য ছিল না। সমাজতান্ত্রিক সমাজে পুরনো পুঁজিবাদী সমাজ থেকে আসা যেসব ছেলেমেয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের পথ থেকে সরে গেছে, তাদের আবার জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিল নবগঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্র। বিপথে চলে যাওয়া বহু ছেলেমেয়ে ফিরেও এসেছিল আলোর পথে, হয়ে উঠেছিল নতুন সমাজের সম্পদ। শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী আন্তন মাকারেঙ্কোর লেখা ‘জীবনজয়ের পথে’ বইতে রয়েছে এমন বহু অভিজ্ঞতা। পুঁজিবাদী সমাজে শিশু-কিশোরদের মধ্যে লুপ্ত হতে বসা শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণগুলি জাগিয়ে তুলেছিলেন সোভিয়েত সমাজের পরিচালকরা। সেদিন এইভাবে নষ্ট হতে চলা বহু অমূল্য মানবসম্পদকে সুস্থ জীবনের প্রবাহে ফিরিয়ে আনতে পারা সম্ভব হয়েছিল, কারণ সেই সমাজের চোখে, রাষ্ট্রের চোখে তার নাগরিকরা ছিল অমূল্য সম্পদ, বুর্জোয়া সমাজের মতো তারা নিছক ভোট পাবার মেশিন নয়। দুনিয়া জুড়ে আজকের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো চায় এর ঠিক উল্টোটা। মানুষকে যত অমানুষ, অপরাধী বানানো যায়, তার শিক্ষা-চেতনা-মনুষ্যত্ব যত ধ্বংস করা যায়, তত তাদের দিয়ে অমানুষের কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। আর তত সহজ হয় পুঁজিপতিদের মুনাফার প্রাসাদ গড়ে তোলা, সহজ হয় এই অন্যায় ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা ১৩ – ১৯ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত