প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি সারা ভারত জুড়ে যে ভাবে যুদ্ধের প্রচার করে চলেছেন, তাতে মনে হচ্ছে ‘অপারেশন সিঁদুরে’ ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা ইত্যাদি সব যেন তিনিই নিজে হাতে ছুঁড়েছেন! ভারত পাকিস্তানের মধ্যে হয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক চার দিনের যুদ্ধ নিয়ে তিনি যা বলে চলেছেন তাতে বলিউডের চিত্রনাট্যকারদের সুবিধা হয়ত হতে পারে, কিন্তু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের ব্যবস্থা গ্রহণের যে দায়িত্বটা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর ওপর বর্তায়, সেই পদক্ষেপ কোথায়?
তিনি কখনও বলছেন, সিঁদুর তাঁর রক্তে বইছে, সেই সিঁদুর নাকি একেবারে বারুদ হয়ে গেছে। কখনও পাকিস্তানের উদ্দেশে বলছেন, হয় রুটি খাও নইলে আমার গুলি খাও ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কোনও মতেই বলছেন না, তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কেন এক মাসেরও বেশি সময় পার করে পহেলগামের খুনি দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার বা তাদের সুনির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করার কাজে পুরোপুরি ব্যর্থ! তাঁর উচ্চগ্রামের বাকপটুতা এবং নাটকীয়তার পরিচয় দেশ অনেক পেয়েছে। তিনি বলেন অনেক, কিন্তু যে কাজগুলি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর কাছ থেকে দেশের মানুষ আশা করেন, সেগুলি নিয়ে পুরোপুরি নীরব।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশের মানুষের কাছে তাঁর এটুকু দায়বদ্ধতা থাকার তো কথা যে, জনগণের অর্থে চলা সামরিক সরঞ্জাম, অস্ত্র, বিমানের সঠিক ব্যবহার এবং তার ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে দেশের মানুষকে সঠিক তথ্য তিনি বা তাঁর সরকার দেবে! অথচ দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে ভারতের কোনও বিমান ধ্বংস হয়েছে কি না এ বিষয়ে দেশবাসী কোনও প্রশ্ন করলেই তাদের ‘পাকিস্তানের ভাষায় কথা বলা’র দায়ে বিজেপি নেতারা অভিযুক্ত করেছেন। কিন্তু ভারতের ‘চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ’ সিঙ্গাপুরে বসে যুদ্ধ শেষের ২১ দিন পরে ৩১ মে রয়টার্স এবং ব্লূমবার্গের মতো বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সামনে স্বীকার করে নিলেন যুদ্ধের প্রথম পর্বেই ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে। কতগুলি ধ্বংস হল তা অবশ্য তিনি খোলসা করে বলেননি। যখন সন্ত্রাসবাদী হামলার বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষ ধিক্কার জানাচ্ছে, সংসদীয় বিরোধী দলগুলিও একযোগে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছে, এই রকম একটা সময়েও দেশের মানুষের কাছে সত্য স্বীকারের সাহসটা প্রধানমন্ত্রী দেখালেন না কেন? তাঁর বীররসে ঘাটতি পড়ার আশঙ্কাতেই কি! দেশের মানুষের থেকে বিদেশি সংবাদমাধ্যমই কি মোদি সরকারের কাছে বেশি নির্ভরযোগ্য? নাকি এই যুদ্ধে সন্ত্রাসবাদীদের নির্মূল করার বদলে আসলে অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল, যেটা বিদেশি সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরলে লাভ বেশি! এই প্রসঙ্গে আবার একটু পরে আসছি।
প্রধানমন্ত্রী অপারেশন সিঁদুরের পর পাঁচটি রাজ্যে ইতিমধ্যে সভা করেছেন। এসেছেন পশ্চিমবঙ্গে, এর পরেই ছুটেছেন বিহারে। এক এক জায়গায় এক এক রকম সেজেওছেন, নিশ্চয়ই তিনি এরপর আরও নানা রাজ্যে গিয়ে নানা সাজে আরও কিছু গরম কথা বলবেন। কিন্তু পাকিস্তানের গোলায় কাশ্মীরে যে প্রায় দশ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই সব বাড়ির বাসিন্দা পরিবারগুলির সঙ্গে তাঁর দেখা করার কথাটা মনেই পড়েনি। অথচ এই মানুষগুলিই তো পাকিস্তানি কামানের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কাশ্মীরের যে সাধারণ মানুষ পহেলগাম হামলার পর সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হলেন, বনধ করলেন, যে মানুষ নিজেদের রোজগারের কথা না ভেবে বিপদগ্রস্ত পর্যটকদের আশ্রয় দিয়েছেন, বিনা ভাড়ায় টোটোয় কিংবা গাড়িতে চাপিয়ে পর্যটকদের নিরাপদে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করেছেন কাশ্মীরের এই জনগণের সাথে সর্বপ্রথম দেখা করার প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রী অনুভবই করলেন না! পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের কারণে ক্ষতি তুলে ধরাই প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য হলে এই ভারতীয় নাগরিকদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার কথা তিনি কি না ভেবে পারতেন! কিন্তু তিনি সম্ভবত হিসাব কষে দেখেছেন, এই সীমান্তের হতদরিদ্র পরিবারগুলি এবং কাশ্মীরের বাসিন্দারা অধিকাংশই মুসলিম, ফলে তাঁদের সাথে দেখা করে, তাঁদের কথা প্রচার করে পাকিস্তান বিরোধিতার বকলমে দেশজুড়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উচ্চনাদ তোলার কাজে লাভ বিশেষ কিছু হবে না! তাঁর আসল লক্ষ্য তো ভোট প্রচার, এর বাইরে কোনও নজর তাঁর নেই। সে জন্যই তিনি ও পথে হাঁটেননি।
প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে এসে উচ্চস্বরে ভোটের প্রচার করেছেন, তার জন্য সিঁদুরকে ঘিরে যত ধর্মীয় অনুষঙ্গ টানা যায় তা টেনেছেন। তার সাথে তিনি মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানে এবং মালদায় ঘটে যাওয়া দাঙ্গার কথা তুলে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলকে বিঁধেছেন। বিজেপির সঙ্গে হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে তৃণমূল কংগ্রেস এই দাঙ্গা কিছুটা চলতে দিয়েছে সন্দেহ নেই। রাজ্য প্রশাসন না চাইলে এই দাঙ্গা কোনওমতেই হতে পারত না। কিন্তু তাতে কি বিজেপির অপরাধের স্খালন হয়? বিশেষত যখন দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীর সভার পরেই পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা উচ্চস্বরে ‘হিন্দু ভোট’ সংহত করার পক্ষে নেমে পড়েছেন, বোঝা গেল প্রধানমন্ত্রী ‘সিঁদুর’ নিয়ে আসলে ভোট ব্যবসাতেই নেমেছেন। তবে দেখা যাচ্ছে ১১ বছর কেন্দ্রীয় সরকার চালিয়ে শুধু সিঁদুর আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছাড়া অন্য কিছু বলবার মতো সম্বল তাঁর নেই। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি নিয়ে কিছু কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর মন্ত্রকের অধীন সিবিআই কেন বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতিগুলির কোনওটিরই কিনারা করতে পারছে না, নাকি করছে না, তার জবাবটা দিচ্ছেন না।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিহারে গিয়ে বিক্রমগঞ্জের জনসভায় তিনি বলেছেন, ‘প্রতিশ্রুতি পালন করার পর আমি ফিরে এসেছি’। বলেছেন, এটা ‘নতুন ভারত’, ‘রামরাজ্য’ এখানে ‘প্রাণ যায়ে, পর বচন না যায়ে’ (প্রাণ যাক, কিন্তু প্রতিজ্ঞা যাবে না)। প্রধানমন্ত্রীর কথা রাখার বহর দেশের মানুষ জানে। নোট বাতিল করে সন্ত্রাসবাদের কোমর ভেঙে দেওয়া, কালো টাকা উদ্ধার করে ১৫ লক্ষ টাকা সকলের অ্যাকাউন্টে ভরে দেওয়া, বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি, সবকা সাথ সবকা বিকাশ ইত্যাদি যা যা তিনি এতদিন ধরে বলেছেন তার কোনওটি রক্ষা করেছেন কি? দেশের মানুষও কি আশা করে, যে তিনি কথা রাখবেন? ‘জুমলা’ শব্দটি তো তাঁকে স্মরণ করেই সারা দেশে এখন উচ্চারিত হয়! এই সেই তিনি, যিনি পহেলগাম হামলার দু-দিন পর ২৪ এপ্রিল বিহারের জনসভায় বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদীদের এমন শিক্ষা দেব যা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। সেই কথা রাখার ব্যাপারে কী করেছেন তিনি? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এই হত্যাকারীদের তাঁর সরকার আজও খুঁজে বারই করতে পারেনি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কিছু জায়গায় সেনা অভিযানে ধ্বংস হওয়া কয়েকটি বাড়ির ছবি তাঁরা প্রচার করেছেন। তাতে প্রমাণ হয়ে যায় কি যে সন্ত্রাসবাদীরা নির্মূল হয়ে গেছে? সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সন্ত্রাসবাদীদের জনবিচ্ছিন্ন করা। তার জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন ইসলামিক কিংবা হিন্দুত্ববাদী সব ধরনের মৌলবাদের মোকাবিলা করা। সে জন্য প্রয়োজন দেশে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক পরিবেশের প্রসার।
কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় জনগণের আস্থা অর্জন, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করা, সমস্ত দিক থেকে উন্নয়ন এবং ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সে রাজ্যের মানুষের সমস্যাকে বোঝা প্রয়োজন। দিল্লির শাসকদের কাছ থেকে এই আচরণ কি কাশ্মীরবাসী পেয়েছেন? নাকি বিজেপি এবং তার প্রভাবিত নানা সংগঠন দেশ জুড়ে কাশ্মীরী তথা সমস্ত মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষকেই দেশের শত্রু সাজিয়ে লড়াইতে নেমেছে! এমনকি যে কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে সামনে রেখে সরকার যুদ্ধের সাফল্য প্রচারে নেমেছিল তাঁকে ‘সন্ত্রাসবাদীদের বোন’ বলেছেন মধ্যপ্রদেশে বিজেপির এক মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী কি কোনও প্রতিবাদ করেছেন? বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ পহেলগামে নিহতদের স্ত্রীদেরই এই হত্যাকাণ্ড রুখতে না পারার জন্য দায়ী করেছেন। এমন সাংসদের হাত তোলা ভোটেই তো প্রধানমন্ত্রীর দল জনবিরোধী নানা আইন কিংবা মুসলিমদের কোণঠাসা করার জন্য ওয়াকফ আইন পাশ করায়! এমন সব সম্পদদের দলে জায়গা দেওয়ার কারণে তিনি কি একটুও লজ্জিত? তা হলে কোন প্রতিশ্রুতিটি তিনি রাখলেন?
এ বারে আসা যাক অপারেশন সিঁদুরের তথাকথিত সাফল্যগাথা প্রসঙ্গে। সরকারের দুর্বল অবস্থান প্রথমেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতা এবং বাণিজ্য প্রলোভন দিয়ে যুদ্ধ বিরতির দাবি জানানোর পর প্রধানমন্ত্রী একবারও তা অস্বীকার করলেন না। আইএমএফ ভারত সরকারের কথা না মেনে দেউলিয়া পাকিস্তানকে ঋণ মঞ্জুর করে দিয়েছে। ‘বিশ্বগুরু’ বলে নিজেকে অনেক জাহির করার পর নরেন্দ্র মোদি যুদ্ধের মধ্যে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কার্যত কোনও সমর্থন জোগাড় করতে পারেননি। ফলে এখন দেশে দেশে সাংসদ দল পাঠাতে হয়েছে বিজেপি সরকারকে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিজেপির সুবিধা করে দিয়েছে সংসদীয় বিরোধী দলগুলি। কারণ ভারতের আসল শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতি তারা সকলেই একই রকম দায়বদ্ধ। তাই এই শ্রেণির নির্দেশে সমস্ত বিরোধী দলকেই দেশের মানুষের কাছে আসল কথা তুলে ধরার বদলে সরকারের রাবার স্ট্যাম্প হিসাবে বিদেশে দৌড়তে হয়েছে। বিদেশে গিয়ে এখন দেশের নামে আসলে মোদি সরকারের ওকালতি করতে হচ্ছে তাঁদের। এমনকি বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিএমকেও একই কারণে এই দলে ভিড়তে হয়েছে।
ভারতের জনগণ আর শাসক শ্রেণির স্বার্থ যে এক নয়, জনগণ যেমন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, তারা যুদ্ধেরও বিরুদ্ধে, এই কথাটাও আজ এই সব বিরোধীদের বলার উপায় নেই। মনে রাখা দরকার, সন্ত্রাসবাদ এবং যুদ্ধ-উত্তেজনা জিইয়ে রাখার প্রয়োজন ভারত পাকিস্তান উভয় দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির যেমন আছে, তেমনই বিশ্বের নানা দেশের বৃহৎ পুঁজিরও স্বার্থ আছে।
এই প্রেক্ষিতে এ বারে সিঙ্গাপুরে আন্তর্জাতিক ‘সাংগ্রি-লা ডিফেন্স’ সম্মেলনে গিয়ে ভারতের সেনা প্রধানের ভারতের যুদ্ধকৌশল ব্যাখ্যার কারণটা বুঝতে সুবিধা হবে। তাঁকে সত্যের খাতিরে মানতে হয়েছে যে, ভারতের যুদ্ধ বিমান ধ্বংস হয়েছে। আবার সাথে সাথে ব্যাখ্যা করে তিনি বুঝিয়েছেন, ভারতে তৈরি অস্ত্র কত সরেস, নানা দেশ যেন তা কেনে। সীমিত আঞ্চলিক যুদ্ধের প্রয়োজন আজ এ দেশের এবং বিদেশের বৃহৎ পুঁজি মালিকদের কাছে এ কারণেই বিপুল। এই যুদ্ধে ভারতের এবং নানা দেশের অস্ত্র কোম্পানিগুলির পরীক্ষা হয়েছে।
পহেলগাম সন্ত্রাসের পরেই যেমন অতি দ্রুত মোদি সরকার নতুন করে রাফাল বিমানের বরাত দিতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে ফেলেছে তেমনই আদানি, টাটা, রিলায়েন্স সহ নানা কোম্পানি তাদের অস্ত্র দেখিয়ে কেউ আর্মেনিয়া, কেউ বেলজিয়াম, কেউ ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশে অস্ত্রের অর্ডার জোগাড় করেছে। এ দিকে চিন, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইজরায়েল, তুরস্ক, আমেরিকা ইত্যাদি দেশের কোম্পানিও কেউ পাকিস্তানকে খুঁটি করে কেউ বা ভারতকে খুঁটি করে বিশ্বের খদ্দেরদের সামনে অস্ত্র প্রদর্শনী করে নিয়েছে। সে জন্যই এই যুদ্ধের প্রয়োজন পুঁজিপতিদের কাছে অসীম। যাঁরা ভাবেন অস্ত্র ব্যবসায় ভারতের কোম্পানির উন্নতি মানে দেশের মানুষের সুরক্ষা– তাঁদের ভাবতে হবে তা হলে অন্য দেশে অস্ত্র বেচতে ভারতীয় মালিকরা এত উদগ্রীব কেন? আজকের দিনে অর্থনীতির সামরিকীকরণই যে পুঁজিবাদের বাঁচার একমাত্র রাস্তা তা বহু আগেই মার্ক্সবাদ লেনিনবাদের ভিত্তিতে দেখিয়ে গেছেন মহান নেতা স্ট্যালিন। আজ পুঁজিবাদের সংকট এতটাই গভীর, যে ভাবে হোক একটা যুদ্ধ বাধিয়ে অস্ত্র উৎপাদনের ওপরেই জোর দেওয়ার জন্য সামাজিক ছাড়পত্র নিতে না পারলে তাদের সংকট আরও গভীর হবে।
শোষণে জর্জরিত দেশের বেশির ভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এতই কম যে, তাদের কেনাকাটার ওপর ভরসা করে পুঁজিপতিদের মুনাফা আজ একেবারে অসম্ভব। ফলে দেশের মানুষের টাকায় অস্ত্র ব্যবসা, সামরিক সরঞ্জাম তৈরি ও বেচা এবং তার প্রয়োজনে যুদ্ধ, এটাই তাদের দরকার। নরেন্দ্র মোদি সহ পুঁজিবাদের সেবাদাসরা এই প্রয়োজন থেকেই আজ সিঁদুর কিংবা কাল হয়ত অন্য কোনও যুদ্ধ উন্মাদনার প্রচারে নামবেনই। উগ্র-পাকিস্তান বিরোধিতা আর একই সাথে মুসলিমদের শত্রু বানানোকেই এরা জাতীয়তাবাদের সাথে সমার্থক করে তুলেছেন। একই কথা প্রযোজ্য পাকিস্তানের শাসকদের জন্য। তাঁরা দেশের মানুষকে জীবনের কোনও আলো দেখাতে পারবেন না জেনেই মৌলবাদ, উগ্র-ভারত বিরোধিতার মধ্যে মানুষকে ফাঁসিয়ে রেখেছেন।
মানুষের জীবনের ক্রমবর্ধমান সংকট থেকে যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে তা যাতে গণআন্দোলনের পথ বেয়ে এই সমাজব্যবস্থার দিকে আঙুল তোলার মতো জায়গায় না যায় তার জন্য পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার দলগুলির আজ দরকার উগ্র জাতীয়তাবাদ, উগ্র সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আচ্ছন্ন জনমন তৈরি করা। জনগণের সামনে তারা ভোট চাইতে গিয়ে কী বলবে? জনগণের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানের উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে যে তারা অপারগ! কারণ জনগণের প্রকৃত কল্যাণ করতে গেলে পুঁজিপতিদের লুঠের ভাগে কম পড়ার সম্ভাবনা। তাতে পুঁজিপতিরা রুষ্ট হলে ভোট তহবিলে টাকা দেবে কে? এই কারণেই আজ সব ছেড়ে নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে বিজেপির সব নেতারা ‘সিঁদুর’ নিয়েই প্রচারে ব্যস্ত। জনগণের স্বাস্থ্য-শিক্ষা-চাকরির মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলি পিছনে ঠেলে দিতে এটাই তাদের হাতিয়ার।
এই প্রচারের জোরেই তাঁরা সামনের বিহার ভোট কিংবা পরের বছরে পশ্চিমবঙ্গের ভোট পার করতে চাইছেন। এতে তাদের সুবিধা করে দেয় কংগ্রেস কিংবা তৃণমূল কংগ্রেসের মতো বিরোধীদের জনবিরোধী ভূমিকা। এই দলগুলিও নিজেদের দুর্নীতি, অপশাসন রুখতে ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতিতে মাতে। এরাও নানা ভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে, নরম হিন্দুত্ব না হলে মুসলিমদের ত্রাতা সাজে। যা সুবিধা করে দেয় বিজেপির রাজনীতিকে। কিন্তু এই ফন্দিও আজ ধরা পড়ে যাচ্ছে অনেকটাই। তাই নরেন্দ্র মোদিকে এখন সস্তা ফিল্মি ডায়লগ দিয়ে বাজার গরম করতে হচ্ছে। এ যেমন তাঁর দুর্বলতার পরিচয়, একই সাথে ভারতীয় সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদের দুর্বলতারও লক্ষণ।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা ৬ – ১২ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত