যুদ্ধ মানে সমর শক্তির প্রদর্শন। তা কি শুধুই প্রতিপক্ষকে হারাতে? বিশেষজ্ঞদের দাবি, আজকের দিনে যুদ্ধ জয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ নিজেদের অস্ত্র প্রযুক্তির ধার বিশ্বকে দেখানো। যাতে তা বেচে দেদার অর্থ উপার্জন করা যায়।
সাম্প্রতিক ভারত-পাক যুদ্ধে ভারত রুশ প্রযুক্তিতে তৈরি ব্রহ্মস ব্যবহার করেছে, ইজরায়েলের থেকে কেনা অস্ত্র ব্যবহার করেছে। পাকিস্তান ব্যবহার করেছে চিন থেকে পাওয়া অস্ত্র, আমেরিকা থেকে পাওয়া অস্ত্র, তুরস্কের অস্ত্র। কোন অস্ত্র দিয়ে কোন অস্ত্রকে আকাশেই ঘায়েল করা যায় তারও একটি পরীক্ষা হয়ে গেল অপারেশন সিদুঁর অভিযানে। অস্ত্র কোম্পানিগুলির জন্য এটা জরুরি ছিল। কারণ অস্ত্রের গুণমান যাচাই করা ছাড়া খদ্দেররা অস্ত্র কিনবে কেন? ফলে অস্ত্র উৎপাদক পুঁজিপতিরা সব সময়ই চায় অস্তে্রর পরীক্ষা করতে। সেজন্য ছোটখাটো যুদ্ধ তাদের দরকার। এই যুদ্ধ সেই সুযোগ এনে দিল। স্বাভাবিকভাবেই সফল অস্ত্রগুলির ব্যবসার বিরাট বাজার খুলে গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ১২ মে বলেছেন, অপারেশন সিঁদুরের পর ভারতীয় কোম্পানির তৈরি অস্ত্র সম্ভারের ক্ষমতা দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রমাণিত। এ কথার মানে কী? এর অর্থ হল ভারতে তৈরি সমরাস্ত্র এবং প্রযুক্তি বিক্রির বাজারের বাড় বৃদ্ধি।
ভারত শুধু অস্ত্র তৈরি করে না, বিদেশ থেকে প্রচুর অস্ত্র আমদানিও করে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর তথ্য বলছে, ২০২০- ২০২৪ সালের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হল ভারত। ভারত কি অস্ত্র উৎপাদন বা অস্ত্র আমদানি করে শুধু আত্মরক্ষার জন্য? আত্মরক্ষার কথাটা সরকার বলে দেশের মানুষের সমর্থন আদায় করার জন্য। আসল লক্ষ্য থাকে অস্ত্র বিক্রি করে বৃহৎ পুঁজিপতিদের বিপুল মুনাফা অর্জন। ইজরায়েলের আক্রমণে গাজা ভূখণ্ডে যে শিশুদের প্রাণহীন দেহের ছবি সারা বিশ্বের মানুষকে কাঁদায়, তাদের অনেকের মৃত্যুর পিছনে আছে ভারতীয় কোম্পানির সরবরাহ করা অস্ত্র। এমনকি কিছুদিন আগেই জানা গিয়েছিল, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানির তৈরি কামানের গোলা ব্যবহার করছে ইউক্রেন। আবার রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য ১৯টি ভারতীয় কোম্পানিকে অভিযুক্ত করেছে আমেরিকা। তথ্য বলছে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারত ২১ হাজার ৯১ কোটি টাকার অস্ত্র রপ্তানি করেছিল। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ২২ কোটি টাকা ২০১৩-১৪ সালে, ভারতের প্রতিরক্ষা রপ্তানি ছিল ৬৮৬ কোটি টাকা। ১০ বছরের যা ৩৪ গুণ বেড়েছে। মোদি সরকার চাইছে ২০২৯ সালের মধ্যে অস্ত্র রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৫০০০০ কোটি টাকায় নিয়ে যেতে। বর্তমানে প্রায় ৮০টি দেশে ভারত অস্ত্র রপ্তানি করে। সরকার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে অতি দ্রুত ১০০টি দেশে অস্ত্র বিক্রি করার।
পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হানার পর এবং অপারেশন সিঁদুরের প্রেক্ষাপটে দেশের প্রতিরক্ষা কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এই সময় প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে থাকা সংস্থার শেয়ার-দর গড়ে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। ছোট ছোট আরও কিছু সংস্থার শেয়ার-দর বেড়েছে। শুধু কি শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ডেও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ফান্ডগুলির মোট সম্পদের মূল্য বা ন্যাভও ২২ এপ্রিলের পর থেকে বেড়েছে প্রায় ১৩ থেকে ২৩ শতাংশ (সূত্রঃ এই সময়, ১৮ মে, ’২৫)। ফলে যুদ্ধ এখন সবচেয়ে বড় ব্যবসা গোটা বিশ্বের পুঁজিবাদী দুনিয়ায়।
সাধারণ ধারণা বলে, অস্ত্র উৎপাদনকারীরা, অস্ত্রের ব্যবসায়ীরা অস্ত্রের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার চায়। অস্ত্রের ব্যবহার হয় কোথায়? জঙ্গি কার্যকলাপ, সন্ত্রাসী হানা, যুদ্ধ ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কাজ়ে। এরকম বিধ্বংসী কাজ, গণহত্যার কাজকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি তার মুনাফার জন্য ভাবছে কেন? কারণ, উৎপাদনের অন্যান্য ক্ষেত্রে তীব্র মন্দা, যে মন্দার সৃষ্টি হয়েছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ কারণেই। তাই পুঁজিবাদী দেশগুলি কম-বেশি প্রায় সবাই যুদ্ধাস্ত্র এবং যুদ্ধ-সরঞ্জাম উৎপাদনের দিকে ঝুঁকেছে। কারণ এখানে সরকারই ক্রেতা। অন্যান্য পণ্যের মতো দুর্দশাগ্রস্ত ক্রেতাদের উপর তার বিক্রি নির্ভর করে না। বাস্তবে এটা হল অর্থনীতির সামরিকীকরণ। লেনিন বহু আগেই বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধের জন্ম দেয়। বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা স্ট্যালিন দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সংকট আজ এত গভীরে যে, ছোট বড় সব পুঁজিবাদী দেশই তার অর্থনীতিকে ক্রমাগত যুদ্ধনির্ভর করে তুলছে। মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখান, যুদ্ধ আজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অস্তিত্বের শর্ত। পহেলগামের সন্ত্রাসী হানায় যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি ন্যূনতম সহানুভূতি জানাতে হলে যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিতে হবে। যে কোনও রাষ্ট্রের দখলদারি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে। জাতি ধর্ম ভাষা বর্ণ ইত্যাদি নিয়ে যে দ্বন্দ্ব, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা তাকে ব্যবহার করে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৩০ মে – ৫ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত