২ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা মানে ঠিক কতখানি টাকা, আমাদের গরিব দেশের অধিকাংশ মানুষই ভাবতে পারেন না। গুগলের তথ্য দেখাচ্ছে, ভারতবর্ষে মাথা পিছু গড় বার্ষিক আয় এক লক্ষ সত্তর হাজার টাকার কিছু কম, অর্থাৎ মাসে পনের হাজার টাকারও কম। ভয়ানক মূল্যবৃদ্ধির বাজারে এই টাকায় সংসার চালাতে যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, বলাই বাহুল্য। এবং একটা বিরাট অংশের দরিদ্র মানুষের আয়ের প্রকৃত ছবিটা এর চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। অথচ যে সব বড় বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে মানুষের সেবা করার কথা বলে ক্ষমতায় আসে, দেশের তেমন ছ’টি জাতীয় দলের এক বছরে প্রাপ্ত মোট অনুদান ২ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা।
২০২৩-২০২৪ অর্থবর্ষে এই দলগুলোর নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া তথ্য থেকে এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এডিআর (অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম)। এই অনুদানের সিংহভাগ– ৮৮ শতাংশ পেয়েছে দেশের শাসক দল বিজেপি, তাদের প্রাপ্ত অনুদান প্রায় ২২৪৪ কোটি টাকা। এর পরেই আছে কংগ্রেস। বাকি পাঁচটি দলের তহবিলে মোট যত টাকা জমা হয়েছে, তার ৬ গুণেরও বেশি গেছে বিজেপির একার ভাণ্ডারে। এই অনুদান দিয়েছে কারা? দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থক বা দেশের সাধারণ মানুষের এই পরিমাণ টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই এ কথা সকলেই বোঝেন। তা হলে এই বিপুল অঙ্কের টাকা কোথা থেকে এল? এর নব্বই শতাংশই হচ্ছে কর্পোরেট অনুদান, অর্থাৎ বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি কোম্পানি, একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা সারা বছর ধরে টাকা ঢেলেছেন এসব দলের পিছনে। মোট কর্পোরেট অনুদানের ৯১ শতাংশ, প্রায় ২০৬৫ কোটি টাকা গেছে বিজেপির ঘরে। বিগত বছরের চেয়ে এসব অনুদান বিজেপি এবং কংগ্রেসের ক্ষেত্রে প্রায় ২০০-২৫০ শতাংশ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি অনুদান এসেছে প্রুডেন্ট ইলেকটোরাল ট্রাস্ট নামে একটি সংস্থার কাছ থেকে, যার মধ্যে আছেন শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, আছে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং, ভারতী এয়ারটেল, ডিএলএফ-এর মতো সংস্থাগুলো। দেশের মানুষের রক্ত জল করা শ্রম লুট করে যারা মুনাফার পাহাড় বানাচ্ছেন, দেশের দারিদ্র-বেকারি-অপুষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে যাদের সম্পত্তির পরিমাণ বাড়ছে, সেই ধনকুবেররা এইসব দলকে টাকা দিচ্ছেন কেন?
২০১৬ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে। তামিলনাড়ুর এক কৃষক সাত লাখ টাকা ধার করে একটি ট্রাক্টর কিনেছিলেন। পাঁচ লাখ শোধ দেওয়ার পর বাকি দু লাখ তিনি দিতে পারছিলেন না। এর শাস্তি হিসেবে ঋণদাতা সংস্থাটি তার ট্রাক্টর বাজেয়াপ্ত করে নেয়। ছাব্বিশ বছরের সেই যুবক পরের দিন আত্মহত্যা করেন। বিজয় মাল্যর মতো কোটিপতি যদি ব্যাঙ্কের লক্ষ কোটি টাকা ঋণ ফাঁকি দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারেন, তা হলে দেশের এক গরিব কৃষককে দু’লক্ষ টাকার জন্য এমন মাশুল দিতে হবে কেন, এই প্রশ্ন সেদিন ধাক্কা দিয়েছিল বহু সংবেদনশীল মানুষের মনে। এই ‘কেন’-র কারণ খুব পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল গত বছর নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরোবার পর। বন্ড বস্তুটি বিজেপি সরকার চালু করেছিল স্বচ্ছতা রক্ষার নাম করে, অথচ এই রায়ের পর প্রকাশিত নানা তথ্য থেকে দেখা গেল বন্ডের সাথে অস্বচ্ছতার শক্ত বন্ডিং। নির্বাচনী বন্ড ছিল কার্যত বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি এবং কর্পোরেট মালিকদের ক্ষমতাসীন দলগুলোকে দেওয়া ঘুষ, যার বিনিময়ে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এইসব সংস্থা নানা চুরি, দুর্নীতি, বেআইনি কাজকর্ম দিব্যি চালিয়ে গেছে এবং তাদের কোনও শাস্তিও হয়নি। বন্ডদাতাদের নাম আড়াল করে মোদি সরকার এই সম্পূর্ণ বেআইনি লেনদেনকেই আইনসিদ্ধ করতে চেয়েছিল এবং ছক্সবছর ধরে বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস সহ বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দলের ভাণ্ডারে বন্ডের বিপুল অর্থ জমাও হয়েছিল। বন্ড বাবদ বিজেপির প্রাপ্ত অর্থ ছিল প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। জমা করেছিলেন কারা? বিভিন্ন ধনকুবেররা। এঁদের কারও আবগারি দুর্নীতি, কারও জাল ওষুধের কারবার, কারও জমি কেলেঙ্কারি দিব্যি মাফ হয়ে গেছিল এই বন্ডের কল্যাণে। কাজেই এ দেশে বিজয় মাল্যরা কেন সাধারণ মানুষের লক্ষ কোটি টাকা চুরি করে পালাতে পারেন, আর গরিব চাষির দুক্সলক্ষ টাকার বেলায় আইনের ফাঁস গলায় চেপে বসে, সেই অঙ্ক খুব সোজা। গত বছর কোর্টের রায়ের পর বেনামি বন্ডের বেচাকেনা আপাতত বন্ধ হলেও এডিআর-এর এই রিপোর্ট পরিষ্কার দেখিয়ে দিল, ভোটসর্বস্ব দলগুলোর সাথে পুঁজিপতিদের এই লেনদেনের সম্পর্ক অটুট আছে শুধু নয়, দিন দিন মজবুত হচ্ছে। এই দলগুলো ভোটের আগে যতই জনগণের দুঃখে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করুক, এদের আসল দায়বদ্ধতা পুঁজিমালিকদের প্রতি। পুঁজিপতিদের টাকায় ভর করে তাদের আশীর্বাদ নিয়েই তারা ক্ষমতায় বসে এবং স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতায় এসে একেবারে গলবস্ত্র হয়ে তাদের স্বার্থই রক্ষা করে। এই টাকাগুলো যায় কোথায়? যায় এইসব দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিলাস ব্যসনে, নির্বাচনের সময় চোখধাঁধানো প্রচারের জৌলুসে। এই টাকার জোরেই দলগুলো ভোট কেনার জন্য টাকার থলি হাতে ধরিয়ে যুবকদের নানা অসামাজিক কাজে লিপ্ত করে, প্রলোভন দেখায়। গরিব মানুষকে সাময়িক কিছু পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বারবার তাদের ভোটের জন্য ব্যবহার করে। নির্বাচনকে যতই ‘গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসব’ নাম দেওয়া হোক, আজকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নির্বাচন হল এই টাকা এবং পেশিশক্তির খেলা।
কোনও রাজনৈতিক দল যদি সত্যিই মানুষের স্বার্থ নিয়ে লড়ে, সততার আদর্শের রাজনীতি করে, তারা কখনও পুঁজিপতিদের কাছে সাহায্য চাইতে পারে না, আর পুঁজিমালিকরাও কখনোই এমন দলের শক্তি বৃদ্ধি হতে দেবে না। তাই সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী সেই দল তহবিল সংগ্রহ করবে সাধারণ মানুষের থেকেই, যেমনটা একসময় স্বাধীনতা আন্দোলনের সৈনিকরা করতেন। এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)-কে মানুষ এইভাবে তহবিল সংগ্রহ করতে দেখেন। এই দলের কর্মীরা দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। সম্প্রতি প্রকাশিত এই এডিআর রিপোর্ট আবারও পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, অর্থ এবং তহবিল সংগ্রহের পদ্ধতি একটি দলের যথার্থ শ্রেণিচরিত্রকে চেনার অন্যতম উপায়।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ২৩ – ২৯ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত