ভারত সরকারের কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি কৃষি বিপণন উপদেষ্টা ও ড্রাফটিং কমিটির আহ্বায়ক ডঃ এস কে সিনহাকে ১০ জানুয়ারি এক প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছে অল ইন্ডিয়া কিসান খেতমজদুর সংগঠন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর ঘোষ এবং সভাপতি সত্যবান চিঠিতে বলেছেন, ‘ন্যাশনাল পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক অন এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং’ শিরোনামে ২৫ নভেম্বর একটা খসড়া নীতি আপনি আপনার দপ্তর থেকে প্রকাশ করেছেন এবং ১৫ দিনের মধ্যে ওই খসড়া নীতির উপর আমাদের মন্তব্য বা মতামত জানতে চেয়েছেন। পরবর্তীকালে এই মন্তব্য বা মতামত দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আমরা আমাদের সংগঠন, এআইকেকেএমএস-এর পক্ষ থেকে সেই খসড়া নীতির উপর আমাদের মতামত রাখছি।
যে খসড়া দলিল প্রকাশ করা হয়েছে তাতে ভারতীয় কৃষির একটা মনোহর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব একেবারে বিপরীত কথা বলছে। সবাই জানেন, আমাদের দেশে ৮৪ শতাংশ কৃষি জোত অলাভজনক। সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি কৃষি উপকরণের দাম লাফিয়ে বাড়ছে। এসব বিষয়ে এই বিলে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। খসড়া বিল প্রস্তুতকারকরা ঋণভারে জর্জরিত কৃষকদের চরম দুর্দশার কথা উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন। এ দেশে প্রতি ১২ মিনিটে একজন কৃষক আত্মহত্যা করছেন, এ কথা উল্লেখ করতেও তাঁরা ভুলে গেছেন। বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারলে এ দেশের আশি শতাংশ কৃষক চাষ ছেড়ে দেবেন– এই নির্মম সত্যও এই খসড়া বিলে উল্লেখ করা হয়নি। জমি হারিয়ে কৃষকরা খেতমজুরে পরিণত হচ্ছে, তাও এখানে উল্লেখ করা হয়নি। ভুলে যাওয়ার কী আশ্চর্যজনক ক্ষমতা!
খসড়া দলিলে বলা হয়েছে, কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম দেওয়াই সরকারের উদ্দেশ্য। এই কথা কি সত্য? তাই যদি হয়, তা হলে কী ভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় কৃষকরা এই সঠিক দাম পাবে? বহু বছর ধরে আমাদের দেশের কৃষকরা ফসলের লাভজনক দাম পাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। কৃষকরা মনে করে তা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন সরকার তাদের ফসল উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামে কিনে নেবে। কৃষকদের দাবি, সরকার তাদের ফসল কেনার এই প্রক্রিয়া আইনসঙ্গতভাবে চালু করুক। একেই বলা হয় এমএসপি আইনসঙ্গত করা। কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োজিত স্বামীনাথন কমিশন ২০০৬ সালে তদানীন্তন কংগ্রেস সরকারের কাছে ফসল কেনার এই প্রক্রিয়া কার্যকর করার প্রস্তাব রেখেছিল। কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস সরকার তা করেনি এবং বর্তমানে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারও সেই প্রস্তাব কার্যকর করতে অস্বীকার করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হল, এ বারের এই খসড়া দলিলে ভারতীয় কৃষকদের এই গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে একটি কথাও বলা হয়নি।
ভারতের কৃষকরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে ভালভাবেই জানে, পুঁজিবাদ বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোই তাদের এই দুঃখ দুর্দশার আসল কারণ। তাই তারা দুটো জিনিস চায়। প্রথমত সরকার তাদের ফসল উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামে কিনে নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে সস্তায় বিক্রি করুক। দ্বিতীয়ত, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে পুঁজিপতি ও বহুজাতিক কোম্পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ করুক। এটাকেই তারা বলছে সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য। তারা জানে, আমাদের দেশের ১৩৫ কোটি মানুষকে অনাহার এবং দুঃখ-দুর্দশা থেকে রক্ষা করার এটাই একমাত্র পথ। কিন্তু দুঃখের হলেও এটা সত্য, এই খসড়া দলিলে ঠিক তার উল্টো প্রস্তাবই দেওয়া হয়েছে। এই খসড়া দলিলে এমন সব প্রস্তাব রাখা হয়েছে যাতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি আমাদেরদেশের সমগ্র কৃষি উৎপাদন সামগ্রী এবং বর্তমানে বিপণন ব্যবস্থার যে কাঠামো আছে (৭০০০ এরও বেশি মান্ডি এবং ২৯ হাজার ৯৩১টি গ্রামীণ হাট) তা পুরোপুরি দখল করে নিতে পারে। এর ভয়ঙ্কর পরিণতিতে কৃষক, কৃষি শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং উৎপাদকরা ধ্বংস হয়ে যাবে। বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন জনদরদি গণতন্ত্রপ্রিয় কোনও মানুষ সরকারের এই নীতিকে সমর্থন করতে পারে না। তাই এ আই কে কে এম এস মনে করে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে, কৃষকবিরোধী, জনবিরোধী এই নীতি ‘ন্যাশনাল পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক অন এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং’ সরকারের পুরোপুরি বাতিল করা উচিত। আমাদের পরামর্শ হল অবিলম্বে এই খসড়া বিল বাতিল করে আমাদের দেশের কৃষকদের নিম্নলিখিত দাবিগুলি পূরণের লক্ষ্যে নতুন করে একটা খসড়া বিল প্রস্তুত করা হোক।
আমাদের দাবি– ১) এমএসপি আইনসঙ্গত করে সরকারকে কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামে ফসল কিনতে হবে। ২) কৃষকের সমস্ত ঋণ মকুব করতে হবে। ৩) সস্তা দামে কৃষককে সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। ৪) এমজিএনআরইজিএ আইনে জব কার্ডধারীদের বছরে ২০০ দিনের কাজ ও ৬০০ টাকা দৈনিক মজুরি দিতে হবে। ৫) বিদ্যুৎ বিল-২০২৩ বাতিল করতে হবে এবং স্মার্ট মিটার চালু করা চলবে না। ৬) ৬০ বছরের বেশি সমস্ত কৃষক ও খেতমজুরদের মাসিক ১০ হাজার টাকা পেনশন দিতে হবে। আশা করি, আমাদের দাবিগুলি বিচারে আপনি যথেষ্ট যত্নবান হবেন।