Breaking News

মৃত্যুশতবর্ষে মহান লেনিনকে স্মরণ করব কেন– প্রভাস ঘোষ

মৃত্যুশতবর্ষে মহান লেনিনকে স্মরণ করব কেন, নেতা-কর্মীদের প্রতি সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ

আপনারা প্রত্যেকেই জানেন যে, মহান মার্কসবাদী দার্শনিক ও চিন্তানায়ক, রাশিয়ায় বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রূপকার এবং বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণির শিক্ষক ও নেতা মহান লেনিন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি। এই মহান চিন্তানায়কের মৃত্যুশতবর্ষ সমাপ্ত হবে ২০২৪ সালের ২১ জানুয়ারি।

আমাদের দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ৭ নভেম্বর ২০২৩ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত মহান লেনিনের মৃত্যুশতবার্ষিকী উপযুক্ত মর্যাদায় আমরা পালন করব।

এই উদযাপন পর্বে আমাদের স্মরণ করা দরকার, রাশিয়ান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির মধ্যে লেনিনই তীব্র আদর্শগত লড়াইয়ে মেনশেভিকদের পরাস্ত করে ইতিহাসের প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি বলশেভিক পার্টি গঠন করেছিলেন, যা প্রতিটি দেশে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দিকনির্দেশ হিসাবে কাজ করে।

লেনিনই ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকক্স-এর শোধনবাদী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে বিরামহীন আদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে মার্ক্সবাদের বিপ্লবী মর্মবস্তুকে রক্ষা করেছেন।

লেনিনই ইতিহাসে প্রথম সফল সর্বহারা বিপ্লব করেছিলেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ঔপনিবেশিক দেশগুলির মুক্তির জন্য জাতিগঠনের আদর্শগত তাত্ত্বিক ভিত্তি দেন এবং প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ধারণা স্পষ্ট করে উপনিবেশগুলির মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করেন।

লেনিনই হচ্ছেন সেই চিন্তানায়ক যিনি বুর্জোয়া আদর্শ, রাশিয়ার মেনশেভিকবাদ এবং ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’-এর শোধনবাদী বিকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে মার্ক্সবাদকে দর্শনগত, আদর্শগত, রাজনীতিগত ও সংগঠনগত ভাবে বিকশিত করেন এবং এর মধ্য দিয়ে মার্ক্সবাদের জ্ঞানভাণ্ডারে মৌলিক অবদান রাখেন। লেনিনই পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ উপস্থিত করেন। মহান স্ট্যালিন বলেছেন, লেনিনবাদ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্ক্সবাদ।

লেনিনের মূল শিক্ষাগুলির আধার়ে কমরেড স্ট্যালিন, কমরেড মাও সে তুং এবং কমরেড শিবদাস ঘোষ লেনিনের ছাত্র হিসাবে সমসাময়িক সমস্যাগুলির মোকাবিলার জন্য মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে কতদূর এবং কী ভাবে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করেছেন, শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আমাদের সেগুলিও স্মরণ করতে হবে।

মহান লেনিনকে স্মরণ করা ও শ্রদ্ধা জানানোর প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে, মহান মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সে তুং ও শিবদাস ঘোষের যোগ্য ছাত্রের স্তরে নিজেদের উন্নীত করে লেনিনের আন্তর্জাতিকতাবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের লক্ষ্যপূরণের পথে অগ্রসর হওয়া।

প্রিয় কমরেড, এ কথা দুঃখের যে, আমরা যখন লেনিন মৃত্যুশতবর্ষ উদযাপন করছি, তখন রাশিয়া, চিন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে বাইরের ও ভিতরের বুর্জোয়া প্রতিবিপ্লবীদের ষড়যন্ত্রে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এর পরিণামে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার গৌরবময় অগ্রগতি, শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলন এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামগুলি যা একসময় সাম্রাজ্যবাদীদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, আজ তা অনুপস্থিত।

তা সত্ত্বেও, আমরা লক্ষ না করে পারি না যে, বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ আজ ক্রমবর্ধমান সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে হাঁসফাঁস করছে। যে কথা লেনিন আগেই বলেছিলেন– সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদের মুমূর্ষু স্তর। বস্তুত বিশ্বপুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা আজ অন্তহীন মন্দার কবলে পড়েছে, যাকে তারা মধুর ভাষায় নাম দিয়েছে ‘অর্থনীতির শ্লথগতি’। এটা ঘটছে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ক্রমাগত সংকোচনের দ্বারা, যা শেষপর্যন্ত বাজারের সংকোচন ঘটাচ্ছে। এর হাত থেকে বাঁচার ব্যর্থ চেষ্টায় বহুজাতিক পুঁজি, একচেটিয়া পুঁজিপতিরা হাজার হাজার শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে, কোটি কোটি শ্রমিককে ছাঁটাই করছে, স্থায়ী কাজের পরিবর্তে নামমাত্র মজুরিতে অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করছে, কাজ আউটসোর্স করছে এমনকি বন্ডেড লেবার প্রথা ফিরিয়ে এনেছে। তদুপরি কৃত্রিম বাজার সৃষ্টির জন্য ক্রমাগত অর্থনীতির সামরিকীকরণ করছে, যে বিষয়ে মহান স্ট্যালিন দীর্ঘকাল আগে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছিলেন। অস্তে্রর বাজার রক্ষা ও প্রসারের জন্য তাদের প্রয়োজন যুদ্ধ-উত্তেজনা তৈরি করা এবং বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ বাধানো। বর্তমানে ইউক্রেনে সাম্রাজ্যবাদী চিনের প্রচ্ছন্ন মদতপুষ্ট সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার আক্রমণ এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির সক্রিয়তা, মার্কিন ও তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির প্রত্যক্ষ মদতে প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের আক্রমণ, যার ফলে শিশু-নারী সহ হাজার হাজার মানুষ নিহত হচ্ছে, শহর-গ্রাম-বাড়িঘর-বিদ্যালয়-হাসপাতাল ধ্বংস করা হচ্ছে। এসবই– ‘সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধের জন্ম দেয়’– লেনিনের এই সুগভীর সিদ্ধান্তকে আবার সত্য প্রমাণ করছে।

কিন্তু সবটাই অন্ধকার নয়। সকল সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশেই শ্রমিকদের, কৃষকদের, ছাত্র-যুবদের, নারীদের আন্দোলন ক্রমাগত ফেটে পড়ছে, সাথে সাথে স্বতঃস্ফূর্ত যুদ্ধবিরোধী শান্তি মিছিলও দীর্ঘ হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী শাসকরা যতই দমন করতে চাইছে ততই আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান সমস্যা মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলছে। মানুষ পরিবর্তন চায় কিন্তু পরিবর্তনের রাস্তা তার জানা নেই। এ ভাবেই বাস্তবে বিপ্লবের অবজেকটিভ কন্ডিশন বা বাস্তব পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু নেই বিপ্লবের জন্য আদর্শগত প্রস্তুতি।

বর্তমান সময়ের প্রধান কাজ হচ্ছে সব দেশেই যত দ্রুত সম্ভব যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা। এই সময়ের অন্যতম কর্তব্য হবে, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ ও তার পরবর্তী বিকশিত চিন্তা যা স্ট্যালিন, মাও সে তুং ও বিশেষ করে শিবদাস ঘোষ দিয়েছেন, তাকে অধ্যয়ন করা ও আত্মস্থ করা।

 এই সময়ে আমাদের বুঝতে হবে, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা অনুযায়ী আদর্শগত, সংগঠনগত ও নৈতিক ভাবে আরও নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার সাথে এবং নির্ভীক মনোভাব নিয়ে নিজেদের তৈরি করা, যাতে আমরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করতে পারি। এই উপলক্ষে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি সমস্ত রাজ্য কমিটিগুলিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে নিম্নোক্ত কর্মসূচি রূপায়ণ করার আবেদন জানাচ্ছেঃ

কর্মসূচি

১) সারা দেশে একেবারে নিম্ন স্তর পর্যন্ত ব্যাপকভাবে মহান লেনিনের উদ্ধৃতি প্রদর্শনী সংগঠিত করতে হবে।

২) মহান লেনিনের শিক্ষা সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে জনসভা, পথসভা এবং গ্রুপ সিটিং করতে হবে।

৩) কমরেডদের নিজেদের আদর্শগত মান বাড়ানোর জন্য লেনিনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা পড়তে হবে, বিশেষ করে ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বইটি পড়তে হবে ব্যক্তিগতভাবে ও সম্মিলিতভাবে।

৪) পার্টির প্রত্যেক রাজ্য, জেলা এবং লোকাল কমিটিগুলিকে দলের বইপত্র বিক্রির উদ্দেশ্যে ব্যাপক এবং পরিকল্পিত কর্মসূচি নিতে হবে।

৫) পার্টির সমস্ত রাজ্য কমিটি এবং ফ্রন্ট ও ফোরামগুলিকে দেখতে হবে যাতে ৫ আগস্ট ও অন্যান্য সাম্প্রতিক কর্মসূচিতে যে সমস্ত যোগাযোগ পাওয়া গিয়েছে, তাঁদের সকলকে লেনিন মৃত্যুশতবার্ষিকী কর্মসূচিতে যুক্ত করা যায়।

মহান লেনিন জিন্দাবাদ!

মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারা জিন্দাবাদ!

লেনিন-মশাল হাতে এগিয়ে চলুন!

 বিপ্লবী অভিনন্দন সহ

প্রভাস ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক