Breaking News

কেন্দ্রের শ্রম কোডের বিরুদ্ধে এআইইউটিইউসি-র বিক্ষোভ

 

১৪ নভেম্বর, ২০২২ ।। কলেজ স্কোয়ার, কলকাতা বেলা ১২টা

কেন্দ্রীয় সরকার ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে ৪টি শ্রম কোড এনেছে। শ্রমজীবী মানুষ এই শ্রম কোড বাতিলের দাবিতে সোচ্চার। এই শ্রম কোড কেন শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী? কারণ এর মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের প্রায় সব অধিকার হরণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোডের দশম অনুচ্ছেদের ৭৭ নং ধারায় বলা হয়েছে ৩০০-র কম শ্রমিক যুক্ত কারখানায় লে-অফ, ছাঁটাই এবং ক্লোজার করার জন্য মালিকদের উপযুক্ত সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন হবে না। তারা মনে করলেই ছাঁটাই করতে পারবে।

শ্রম কোডে ফ্যাক্টরির সংজ্ঞাও বদলে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান শ্রম আইনে ফ্যাক্টরির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে বিদ্যুৎ চালিত কারখানায় ১০ জন ও বিদ্যুৎ ছাড়া কারখানায় ২০ জন শ্রমিক থাকলে ফ্যাক্টরি বলে চিহ্নিত হবে এবং শ্রমিকরা ফ্যাক্টরি আইনের সকল সুযোগ পাবে। বর্তমান শ্রম কোডে তা উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ নির্ভর কারখানায় ২০ জন ও বিদ্যুৎ ছাড়া কারখানায় ৪০ জন শ্রমিক থাকলে তা কারখানা বলে পরিগণিত হবে। ফলে বহু মালিক এর সুযোগ নিয়ে যথাক্রমে ১৯ জন বা ৩৯ জন শ্রমিক দিয়ে কারখানা চালিয়ে শ্রমিকদের সমস্ত আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে। ঠিকা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সংখ্যা ২০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ জন করা হয়েছে এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ৫ জন থেকে বাড়িয়ে ১০ জন করা হয়েছে। এর ফলে শ্রমিকরা হারাবে আইনের সুরক্ষা অধিকার ও মালিকরা পাবে ছাঁটাই ও শোষণ বঞ্চনার অবাধ স্বাধীনতা।

ফ্লোর ওয়েজ ব্যবস্থা কম মজুরি দেওয়াকে আইনসিদ্ধ করার ছল

আগে মজুরি ছিল তিন প্রকারের। (ক) মিনিমাম ওয়েজ (ন্যূনতম মজুরি)–যার কমে মজুরি দিলে কোনও শ্রমিক, পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না। (খ) ফেয়ার ওয়েজ–কোনও মতে বাঁচার মতো মজুরি। (গ) লিভিং ওয়েজ–বাঁচার মতো মজুরি। এখন শ্রম কোডের মধ্য দিয়ে আনা হয়েছে ফ্লোর ওয়েজ ব্যবস্থা। কারণ ১৯৫৭ সাল থেকে আইনত ন্যূনতম মজুরি শ্রমিকদের দেওয়া বাধ্যতামূলক। যে মালিক ন্যূনতম মজুরির কম দেবেন তিনি আইনভঙ্গকারী হিসাবে চিহ্নিত হবেন এবং আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবেন। এই শাস্তির হাত থেকে মালিকদের বাঁচানোর জন্য এবং আইন অনুযায়ী আরও কম মজুরি শ্রমিকদের দেওয়ার জন্যই এই নতুন ফ্লোর ওয়েজের বিষয়টি কোডে এসেছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করেছে ১৭৮ টাকা, যা ফ্লোর ওয়েজের নামান্তর। এই মজুরির ন্যূনতম মজুরির থেকে অনেক কম।

ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট বাস্তবে স্থায়ী কাজে অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের ব্যবস্থা

নতুন শ্রম কোড অনুযায়ী বর্তমান আইনের পরিকাঠামোর বাইরে গিয়ে শ্রমিকরা মালিকের সাথে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ হবেন। এই চুক্তিবদ্ধ কর্মীদের থাকবে না কাজের কোনও স্থায়িত্ব। মেয়াদ পূরণের আগে, চাকরি হারানোর ভয়ে শ্রমিকরা থাকবে শঙ্কিত। এই কারণে মালিকদের কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে পারবে না। মালিকরা ভাবছে, এর ফলে কারখানা হবে ইউনিয়ন মুক্ত। স্থায়ী কাজে স্থায়ী কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা, যা এতদিন বলবৎ ছিল তা ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট চালু করার ফলে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে মালিকদের শোষণ অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়তে থাকবে।

শ্রমিক ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে

শ্রম কোডে বলা হয়েছে, কোনও শিল্প বা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট করতে হলে ১৪ দিন আগে শ্রমিকদের নোটিস দিতে হবে। বর্তমান আইনে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ক্ষেত্র বাদ দিয়ে আর কোথাও ধর্মঘট করার জন্য নোটিস দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। শ্রম কোডের মধ্য দিয়ে সেই অধিকার খর্ব করা হল। শ্রম কোড চালু হলে যে কোন অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে শ্রমিকরা আইনত ধর্মঘট করতে পারবেন না। ধর্মঘট করলে বেআইনি ঘোষণা করা হবে এবং শ্রমিকদের শাস্তি দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, শিল্প বিরোধ বিষয়ে সরকারের শ্রম দপ্তরের পক্ষ থেকে আলোচনা শুরু করা হলে–যতদিন আলোচনা চলবে ততদিন ধর্মঘট করার কোনও অধিকার শ্রমিকদের থাকবে না। মালিকপক্ষ ও তার তল্পিবাহক সরকার একে ব্যবহার করে যে কোনও অজুহাতে আলোচনা দীর্ঘায়িত করতে থাকবে। শ্রমিকরা আইনসম্মত ভাবে ধর্মঘটে যেতে পারবেন না। আরও বলা হয়েছে যে, অর্ধেকের বেশি শ্রমিক একযোগে ছুটি নিলে তা ধর্মঘট হিসেবে বিবেচিত হবে এবং মালিক এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে।

শ্রম কোডের মাধ্যমে স্থায়ী নিয়োগের রাস্তা বন্ধ করা হচ্ছে

বর্তমান শ্রম কোড ব্যাপক ভাবে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করার সিংহদরজা খুলে দিয়েছে। পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত কোডে এই স্থায়ী কাজের ধারণাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই কোডে কোর অ্যাক্টিভিটিতেও ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করার অধিকার মালিকদের দেওয়া হয়েছে। যা বর্তমান আইনের পরিপন্থী। পরিষেবা ক্ষেত্রেও যেমন ব্যাঙ্ক, ইনসিওরেন্স ইত্যাদিতে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের ঢালাও অধিকার দেওয়া হয়েছে। আর ঠিকা শ্রমিক মানেই হল সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বলে কিছু থাকবে না এবং মজুরিও কমে যাবে।

শ্রম কোড পিএফ এবং পেনশন কমানোর পাকা ব্যবস্থা

সামাজিক সুরক্ষা কোডে বলা হয়েছে যে প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুরক্ষা শ্রমিকরা পাবে, কিন্তু তা ঐচ্ছিক হতে পারে। বলা হয়েছে, যদি কোনও কারখানার মালিক প্রভিডেন্ট ফান্ড স্কিমে না থাকতে চায় এবং মালিকপক্ষ ও সেই কারখানার সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকরা যদি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে তাদের ক্ষেত্রে পিএফ থাকবে না, তা হলে কেন্দ্রীয় প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনার তা অনুমোদন করতে পারে। পিএফ এবং তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পেনশন ভবিষ্যৎ সামাজিক সুরক্ষার একটি নির্ভরযোগ্য প্রকল্প। এখানে সুদের হার নির্ধারণে শ্রমিক প্রতিনিধিদের মতামতকেও বিবেচনা করা হয়। শ্রম কোডের মধ্য দিয়ে একে এভাবে ঐচ্ছিক করে দিলে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।

আবার সামাজিক সুরক্ষা কোড অনুযায়ী কর্মচারী এবং নিয়োগকর্তার উভয়ের প্রদেয় মজুরি মূল বেতনের ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে কর্মচারীর পিএফ অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ৪ শতাংশ করে কম টাকা জমা পড়বে। এর ফলে অবসরের সময় শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রাপ্য টাকা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। এবং কমে যাবে পেনশনের টাকাও।

শ্রম কোড ইন্সপেক্টরদের ক্ষমতা খর্ব করেছে

শ্রমবিরোধের ক্ষেত্রে এতদিন পর্যন্ত যাঁরা ছিলেন ইন্সপেক্টর, এই কোড অনুযায়ী তাঁরা হয়ে যাবেন ইন্সপেক্টর কাম ফ্যাসিলিটেটর। এই শ্রম কোডে পরিদর্শন এবং যেকোনও জ্ঞাতব্য বিষয় ইলেকট্রনিক মাধ্যমে দেওয়া নেওয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সকলেই জানেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ কখনওই বাস্তব পরিদর্শন অর্থাৎ ঘটনাস্থলে সশরীরে উপস্থিত থেকে পরিদর্শনের বিকল্প হতে পারে না। বাস্তব পরিস্থিতি বা ঘটনাকে বুঝতে সশরীরে পরিদর্শন একান্ত প্রয়োজন। তাছাড়া এখানে ইন্সপেক্টর কাম ফ্যাসিলিটেটরের ভূমিকাকে মূলত উভয়পক্ষের পরামর্শদাতা ও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাখা হয়েছে। বর্তমানে শ্রম আইন ভঙ্গকারী মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যতটুকু অধিকার ইন্সপেক্টরদের আছে– তাও খর্ব করা হয়েছে শ্রম কোডের মাধ্যমে। এর ফলে শ্রমিকদের উপর মালিকের শোষণ বঞ্চনা জুলুম আরও বাড়বে।

আন্দোলন রাজ্যের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী নীতির বিরুদ্ধেও

শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী এই কালা শ্রম কোডের বিরুদ্ধে ১৪ নভেম্বর এআইইউটিইউসি কলকাতায় বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক কমরেড অশোক দাস জানান, শুধু কেন্দ্রের বিরুদ্ধেই নয়, রাজ্যের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী নীতির বিরুদ্ধেও এই বিক্ষোভ মিছিল। তিনি বলেন, এ রাজ্যেও চলছে বিজি প্রেস সহ নানা ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া, ছাঁটাই, স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে ব্যাপক হারে চুক্তিতে নিয়োগ, পিএফ এবং গ্র্যাচুইটির টাকা আত্মসাৎ ও স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ। সরকারি ক্ষেত্রে বহু শূন্যপদ পড়ে আছে, কিন্তু নিয়োগ হচ্ছে না। শিক্ষক, নার্স ও সরকারি কর্মচারী সহ যতটুকু নিয়োগ হয়েছে, তাতেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ চট এবং চা শিল্পে চলছে ভয়ঙ্কর শোষণ ও বঞ্চনা। বহু চটকল বন্ধ। চা শিল্পেও এখনও ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি। নেই বন্ধ চা বাগানগুলি খোলার উদ্যোগ। বন্ধ কারখানার শ্রমিকের আত্মহত্যা আজ নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্য সরকার হাইকোর্টের রায় সত্তে্বও সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক সহ অন্যান্য কর্মচারীদের প্রাপ্য ডিএ দিচ্ছে না।

দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা আজ মোট শ্রমিক সংখ্যার ৯০ শতাংশের অধিক। তাঁদের অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর। তাঁদের জন্য নেই বাঁচার মতো মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের প্রতি সরকারের কোনও দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে বলে মনে হয় না। সমাজের জন্য উৎপাদনে এঁদের ভূমিকা অপরিসীম। অথচ পুঁজিবাদী সমাজে এঁরা ভীষণভাবে শোষিত ও উপেক্ষিত। এই সমাজে শ্রমিকের শ্রম ব্যবহার করে মালিকদের মুনাফার পাহাড় বাড়লেও বেশিরভাগ শ্রমিক শোষণের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে। অশোক দাস বলেন, বিভিন্ন সংগঠিত, অসংগঠিত ও স্কিমে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যায় ও আইনসঙ্গত দাবিগুলিকে নিয়ে এআইইউটিইউসি-র নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে। সেই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও তীব্রতর করার লক্ষে্য ১৪ নভেম্বর সমস্ত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের যুক্ত করে কলকাতায় এক বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে। এই মিছিল ও ডেপুটেশনকে সফল করার জন্য তিনি সমস্ত অংশের শ্রমজীবী মানুষের কাছে সক্রিয় ও উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানান।