রাষ্ট্র ও বিপ্লব (১৮)—ভি আই লেনিন

বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার অষ্টাদশ কিস্তি।

সাম্যবাদী সমাজের প্রথম স্তর

‘ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম’-এ লাসালের চিন্তাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার জন্য মার্ক্স বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। লাসালের চিন্তা হল, সমাজতন্ত্রের শ্রমিক তার শ্রমের ফসলের ‘অখণ্ড অংশ’ বা ‘পুরোটাই’ পেয়ে যাবে, তার কম পাবে না। মার্ক্স দেখিয়েছেন, সমাজের সমগ্র সামাজিক শ্রম থেকে একটা সংরক্ষিত তহবিল সরিয়ে রাখতে হবে। উৎপাদনের বিস্তার ঘটানো, ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ক্ষয় পূরণ সহ নানা প্রয়োজন এই তহবিল পূরণ করবে। তারপর ভোগের উপকরণ থেকেও একটা অংশ সরিয়ে রাখতে হবে। এ দিয়ে প্রশাসন, স্কুল, হাসপাতাল, বয়স্কদের জন্য বাসগৃহ এবং এই ধরনের আরও অনেক কিছুর ব্যয় নির্বাহ হবে।

লাসালের ভাসা ভাসা, দুর্বোধ্য, মামুলি শব্দবন্ধের (শ্রমের উৎপাদিত দ্রব্যের সবটাই শ্রমিককে দিতে হবে) পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক সমাজ কীভাবে তার সমস্ত কাজকর্ম নির্বাহ করবে মার্ক্স তার একটা বাস্তব হিসাবনিকাশ করেছেন। যেখানে পুঁজিবাদ থাকবে না, সেই সমাজের জীবনধারার সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মার্ক্স বলেছেনঃ ‘‘এখানে আমাদের আলোচনা করতে হবে এমন একটা সাম্যবাদী সমাজের কথা (ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মসূচির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে), যে সাম্যবাদী সমাজ নিজের ভিত্তির উপর বিকশিত হয়নি। তা পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সবে জন্মগ্রহণ করেছে। তাই অর্থনৈতিক, নৈতিক, মানসিক, সব দিক থেকেই তার সর্বাঙ্গে তার গর্ভধাত্রী পুরনো পুঁজিবাদী সমাজের থেকে পাওয়া জন্মচিহ্ন দেগে দেওয়া আছে।’’

এই সাম্যবাদী সমাজকেই মার্ক্স ‘প্রথম’ বা নিম্নস্তরের সাম্যবাদী সমাজ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই সমাজ সবে পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে এবং সবদিক দিয়েই সে পুরনো সমাজের জন্মচিহ্ন বহন করছে।

এই সমাজে উৎপাদনের উপকরণ আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। উৎপাদনের উপকরণগুলি তখন সমগ্র সমাজের সম্পত্তি। সমাজের প্রত্যেক সদস্য সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম দেবেন। এর বিনিময়ে তিনি সমাজ থেকে একটা সার্টিফিকেট পাবেন, তাতে বলা থাকবে তিনি এই পরিমাণ কাজ করেছেন। এই সার্টিফিকেট দেখিয়ে তিনি ভোগ্য বস্তুর সামাজিক ভাণ্ডার থেকে উপযুক্ত পরিমাণ ভোগ্য বস্তু পাবেন। সামাজিক তহবিলের জন্য শ্রমের পরিমাণের কিছুটা রেখে দেওয়ার পর, শ্রমিক সমাজকে যা দেয় সেই পরিমাণেই সে সমাজ থেকে তা ফিরে পায়।

একে ‘সাম্যের’ অপ্রতিহত রাজত্ব বলে মনে হতে পারে।

এই ধরনের সমাজের কথা মাথায় রেখে যখন লাসালে বলেন, (সাধারণভাবে এই সমাজকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বলা হয়। কিন্তু মার্ক্স এর নামকরণ করেছেন, সাম্যবাদের প্রথম স্তর) এই হল ‘ন্যায়সঙ্গত বণ্টন’, এই হল ‘সমাজের সমস্ত সদস্যের শ্রমের উৎপাদিত দ্রব্যের উপর সমানাধিকার’, তখন তিনি ভুল করেন এবং মার্ক্স তাঁর এই ভ্রান্তি উদঘাটন করেন।

মার্ক্স বলছেন, এখানে ‘সমানাধিকার’ আছে ঠিকই, কিন্তু তা এখনও ‘বুর্জোয়া অধিকার’। ধরেই নেওয়া যায়, অন্য সমস্ত অধিকারের মতো এই অধিকারের পিছনেও রয়েছে অসাম্য। সমস্ত অধিকারই হল, ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সব মানুষের উপর একই ব্যবস্থা প্রয়োগ করা। কিন্তু, সব মানুষ এক নয়, পরস্পরের সমানও নয়। তাই ‘সমানাধিকার’ বাস্তবে সাম্যের নীতিকে লঙ্ঘন করে এবং মানুষের উপর অবিচার করে। অবশ্যই, প্রতিটি মানুষ অপর একজনের মতো একই পরিমাণ সামাজিক শ্রম দিয়ে, সামাজিক উৎপাদনের থেকে সমান অংশ পাচ্ছে (উপরে যা বলা হয়েছে, সেই অংশটা বাদ দিয়ে)।

কিন্তু মানুষ তো সমান নয়। একজন বলবান, অন্যজন দুর্বল, একজন বিবাহিত, অন্যজন অবিবাহিত, একজনের অনেক সন্তান আছে, অন্য জনের সন্তান সংখ্যা কম। এই রকম অনেক পার্থক্য আছে। এজন্য মার্ক্স সিদ্ধান্ত করেছেনঃ ‘‘যদি সবাই সমান শ্রম দেয় এবং সবাই যদি সমাজের ভোগের তহবিল থেকে সমান অংশ পায়, তবে বাস্তবে একজন আর একজনের থেকে বেশি পাবে, একজন অন্যজনের তুলনায় ধনী হবে, এবং এই ধরনের আরও পার্থক্য দেখা দেবে। এই ত্রুটিকে দূর করার জন্য অধিকার সমান হওয়ার পরিবর্তে অসমান হতে হবে।’’

তাই, প্রথম পর্যায়ের সাম্যবাদ ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। সম্পদের পার্থক্য ও অন্যায্য পার্থক্য তখনও থাকবে। কিন্তু মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারণ, কারখানা, যন্ত্রপাতি, জমি ইত্যাদি উৎপাদনের উপকরণ কেউ দখল করে ব্যক্তি সম্পত্তিতে পরিণত করতে পারবে না। লাসালের পেটি বুর্জোয়া বিভ্রান্তিমূলক শব্দবন্ধ দিয়ে সাধারণভাবে বলা ‘সাম্য’ ও ‘ন্যায়’-এর বক্তব্যকে খণ্ডন করতে গিয়ে মার্ক্স সাম্যবাদী সমাজের বিকাশের গতিপথ দেখিয়েছেন। এই সমাজ প্রথম যে ‘অন্যায়’কে দূর করতে বাধ্য, তা হল, উৎপাদন উপকরণের উপর ব্যক্তিগত দখলদারি। কিন্তু ‘যতটা শ্রম দিয়েছে সেই পরিমাণ অনুযায়ী ভোগ্য বস্তুর বণ্টনের (প্রয়োজন অনুযায়ী নয়) মধ্যে যে অন্যায় রয়েছে তাকে তখনই দূর করা যাবে না।

বুর্জোয়া পণ্ডিতরা, স্থূল অর্থনীতিবিদেরা, এদের মধ্যে ‘আমাদের’ তুগান বারানভস্কি আছেন, সবসময় এই বলে সমাজতন্ত্রীদের ভৎর্সনা করছেন, মানুষ যে এক নয় এ কথা তোমরা ভুলে যাচ্ছ। আর ভুলে গিয়ে মানুষকে সমান করার ‘স্বপ্ন’ দেখছো। এই ধরনের ভৎর্সনা দেখিয়ে দিচ্ছে, এই বুর্জোয়া পণ্ডিতরা কত অজ্ঞ।

মানুষ যে অবশ্যম্ভাবীরূপেই অসমান, সে কথা মার্ক্স অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিবেচনায় নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি এই কথাও ভেবেছিলেন, উৎপাদন উপকরণকে সমগ্র সমাজের (সাধারণভাবে যাকে সমাজতন্ত্র বলা হয়) সম্পত্তিতে পরিণত করলেই বণ্টনের এই ত্রুটিকে দূর করা যাবে না। যতদিন পর্যন্ত ‘যে পরিমাণ শ্রম দেওয়া হয়েছে, সেই অনুযায়ী’ দ্রব্য বণ্টনের নীতি কার্যকর থাকবে, ততদিন ‘বুর্জোয়া অধিকারের’ অসাম্য থেকে যাবে।

মার্ক্স আরও বলেছেনঃ ‘‘সাম্যবাদী সমাজের প্রথম স্তরে এই ত্রুটি থাকবেই। কারণ, পুঁজিবাদী সমাজের দীর্ঘদিনের প্রসব যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সবে তার জন্ম হয়েছে। অধিকার কখনওই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং এই কাঠামোর দ্বারা নির্ধারিত সাংস্কৃতিক বিকাশকে ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না।’’

সুতরাং, কমিউনিস্ট সমাজের প্রথম স্তরে (সাধারণত সমাজতন্ত্র বলা হয়) ‘বুর্জোয়া অধিকার’ সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় না, হয় অংশত। যতটুকু অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্পন্ন করা গেছে তার অনুপাতে তা লুপ্ত হয়। অর্থাৎ, উৎপাদনের উপকরণের সম্পর্কেই তা ঘটে। ‘বুর্জোয়া অধিকার’ উৎপাদনের উপায়কে ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি বলে মনে করে। সমাজতন্ত্র তাকে সাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত করে। সেই পর্যন্ত, এবং কেবলমাত্র সেই পর্যন্তই, ‘বুর্জোয়া অধিকার’ অবলুপ্ত হয়।

যাই হোক, এর দ্বিতীয় অংশটির নিরিখে কিন্তু বুর্জোয়া অধিকার থেকেই যাচ্ছে। সমাজের সকল সদস্যের মধ্য থেকে যাচ্ছে উৎপাদিত দ্রব্য বন্টন ও কাজের বিলি-বন্দোবস্তের নিয়ন্ত্রক (নির্ধারক শক্তি) ক্ষমতা হিসাবে। সমাজতান্ত্রিক নীতি হলঃ ‘যে কাজ করবে না, সে খাবার পাবে না।’ এই নীতি ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে। অন্য সমাজতান্ত্রিক নীতিঃ ‘একই পরিমাণ শ্রমের জন্য একই পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্য’, এই নীতিও ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু তা এখনও সাম্যবাদ নয়। যে ‘বুর্জোয়া অধিকার’ অসমান ব্যক্তিকে অসমান (বাস্তবেই অসমান) শ্রমের বিনিময়ে সমান উৎপাদিত দ্রব্য দেয়, এই ব্যবস্থা এখনও তা অবলুপ্ত করতে পারেনি।

মার্ক্স বলছেন, এটা ‘ত্রুটিই’। কিন্তু সাম্যবাদী সমাজের প্রথম স্তরে এই ত্রুটি অনিবার্য। কারণ, কল্পনাবিলাস ছাড়া আমাদের এই চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না যে, পুঁজিবাদ উচ্ছেদের সাথে সাথে কোনওরকম অধিকারের মানদণ্ড ছাড়াই জনগণ সমাজের জন্য কাজ করতে শিখে যাবে। তা ছাড়া বাস্তবিকই পুঁজিবাদ উচ্ছেদের সাথে সাথে এই ধরনের অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়ে যেতে পারে না এবং তখনও পর্যন্ত ‘বুর্জোয়া অধিকার’ ছাড়া অন্য কোনও মানদণ্ডনেই। তাই, এই পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা থাকবে। এই রাষ্ট্র উৎপাদন উপায়ের উপর সামাজিক মালিকানাকে রক্ষা করবে, শ্রমের সাম্য ও উৎপাদিত দ্রব্যের বণ্টনের সাম্যকে সুরক্ষা দেবে।

যখন কোনও পুঁজিপতি থাকবে না, যখন কোনও শ্রেণি থাকবে না, এবং সে জন্য, কোনও শ্রেণিকে দমনের প্রয়োজন হবে না, তখনই রাষ্ট্র অবলুপ্ত হবে।

কিন্তু এখনও রাষ্ট্র সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়নি। কারণ এখনও ‘বুর্জোয়া অধিকার’ সুরক্ষিত আছে। এই বুর্জোয়া অধিকার প্রকৃত অসাম্যকে পবিত্র বলে ঘোষণা করছে। রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ বিলীন করার জন্য পূর্ণ সাম্যবাদের প্রয়োজন। (চলবে)