বুঝি বলেই তো দ্বন্দ্বটা বেশি!

প্রতীকী ছবি

হাতিবাগানের পিছনের যে গলিতে বেশ কয়েকটা চায়ের দোকান রয়েছে তা সারাদিনই থাকে জমজমাট। অনেকে বলে উত্তর কলকাতার ডেকার্স লেন। সকাল বেলা সেখানকার আড্ডা মানে টিভির সংবাদ চ্যানেল। সব মতের মানুষের সমাবেশ। কাল কোথায় কী ঘটেছে, কে কী বলেছে, সব কিছুর একেবারে লাইভ রিপোর্ট। সেই আড্ডার অন্যতম সদস্য সুমন্তদা। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

সে দিন আড্ডায় সুমন্তদাকে একটু চুপচাপ দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কী সুমন্তদা শরীর ঠিক আছে তো? বললেন, না রে শরীর ঠিকই আছে। মেজাজটা ভাল নেই। বললাম, কেন, কারও কিছু ঘটেনি তো? প্রচারে বের হচ্ছেন না?

বললেন, আর প্রচার? কোন মুখে বেরোব? কোন মুখে গিয়ে মানুষকে বলব– কংগ্রেসকে ভোট দিন?

বললেন, কাগজে দেখেছিস তো, দল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করছে। আমি বললাম, দেখেছি।

বললেন, শোনার পর থেকে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছি না। বললেন, দেখ, তোরা তো জানিস, আমাদের বামপন্থী পরিবার। বাবা-কাকারা সবাই ছিলেন দলের সক্রিয় কর্মী। বাহাত্তরে দীর্ঘদিন বাড়িছাড়া। শেষ পর্যন্ত কাকা খুন হয়ে গেলেন। আমাকেও অফিসে কম হেনস্থা হতে হয়নি। বললেন, এই তো পাশেই বরানগর। বরানগর হত্যাকাণ্ড মানুষ কি ভুলে গেছে! এখনও খুঁজলে ১১০০ কর্মী খুনের পুরনো দেওয়াল লিখন পাওয়া যাবে।

কথাগুলি এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন। আমি চুপ করেই থাকলাম। আবার বলতে শুরু করলেন, দেখ, সেই পাঁচের দশকের গোড়া থেকে কংগ্রেসের নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেই তো বামপন্থীদের উত্থান। সেই আন্দোলনে সব বামপন্থী দল ছিল। তারপরে আমরা সরকারে এলাম। সেই সরকারের প্রথম প্রায় এক দশক তো কেন্দ্রের কংগ্রেসি সরকারের বঞ্চনাই ছিল দলের মূল স্লোগান। সারা জীবন কংগ্রেসের বিরুদ্ধতা করে এসে এখন সেই কংগ্রেসকে বন্ধু বলে জনগণের মধ্যে প্রচারই বা কী করে করব? আর করলেও জনগণ কি তা বিশ্বাস করবে?

সুরজিৎ কখন পাশে এসে বসেছে খেয়াল করিনি। এক সময়ে ছাত্র সংগঠন করত। এখন কোন একটা সংবাদ চ্যানেলে কাজ করে। হঠাৎ সে বলে উঠল, সুমন্তদা, শুধু তো কংগ্রেস নয়, আইএসএফের মতো একটা দলের সঙ্গে জোটের যে চেষ্টা, তাই কি মানা যায়?

সুমন্তদা বললেন, ভাবতেই পারছি না যে, নেতারা শেষ পর্যন্ত আইএসএফের সঙ্গেও জোট করতে নামবেন। যতই সেকুলার বলা হোক, সত্যিটা যে কী, তা তো সবাই জানে। এ তো বামপন্থাকেই বিসর্জন দেওয়া! এর পরে কি আর আমরা বামপন্থী দল হিসেবে দাবি করতে পারব! নেতারা দক্ষিণপন্থা বামপন্থার পার্থক্যটুকুও আর রাখলেন না! মানুষের কাছে কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াব! নিজের বামপন্থী পরিচয় তো আমি ত্যাগ করতে পারব না।

বললেন, দ্যাখ তোদের দল তো বামপন্থার ঝান্ডা নিয়ে একাই লড়ছে। আমি তো বলেছিলাম, কংগ্রেসের সঙ্গে কেন? কেন তোদের সঙ্গে নয়? সেটাই তো সবচেয়ে ভাল হত। এ তো শোষিত মানুষের মধ্যে শুধু বিভ্রান্তিই ছড়াবে।

সুরজিৎ বলে উঠল, সুমন্তদা, দল যা-ই ঠিক করুক, আমাকে মেরে ফেললেও কংগ্রেসকে ভোট দিতে পারব না। আচ্ছা সুমন্তদা, তোমার সঙ্গে তো নেতাদের পরিচয় রয়েছে। তুমি কেন প্রতিবাদ করলে না?

বললেন, জোনাল নেতাদের সাথে এ নিয়ে অনেক তর্ক করেছি। তাঁরা বলেন, কিছুই নাকি তাঁদের করার নেই। সব ওপর তলার সিদ্ধান্ত।

সুরজিৎ বলল, এমন সিদ্ধান্ত না-ই মানলাম সুমন্তদা।

বুঝলাম, সুরজিতের মধ্যেও একই দ্বন্দ্ব কাজ করছে।

সুমন্তদা বললেন, দ্যাখ, নেতৃত্বকে কখনও অমান্য করিনি। আর কখনও করতে হবে তা-ও ভাবিনি।

আমি বললাম, সুমন্তদা তোমার কী মনে হয়– দল কেন এমন একটা জোটে যাচ্ছে, যা তোমার মতো দলের পুরনো কর্মীরাও মানতে পারছে না।

বললেন, শুধু আমি তো নই, সক্রিয় বহু কর্মী– এই তো সুমন, রঞ্জন, অমলদা– সবাই কত ভাল কর্মী ছিল, কেউই মানতে পারছে না। কতজন চুপচাপ বসে গেছে। অথচ দু-একটা সিট ছাড়া এমন জোটের অন্য কিছু কারণ তো আমি অন্তত খুঁজে পাচ্ছি না।

বললাম, তুমি তো বামপন্থী সুমন্তদা। তোমার কাছে দলের স্বার্থের থেকে শোষিত মানুষের স্বার্থ বড়। তুমি যদি নিশ্চিত হও যে, দল ভুল রাস্তায় যাচ্ছে এবং তাতে বামপন্থী আন্দোলনেরই ক্ষতি হবে, শোষিত মানুষের বাঁচার আন্দোলন পিছিয়ে পড়বে, তবে তুমি তা মানবে কেন? তুমি সত্যের পক্ষে, শোষিত মানুষের পক্ষে বলেই বামপন্থী হয়েছো, কোনও ফ্যাশন থেকে তো হওনি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বুঝি রে! আর বুঝি বলেই দ্বন্দ্বটা আরও বেশি। যাই হোক, বাড়িতে আসিস।