নেতা-মন্ত্রী কেনার হিড়িকেই স্পষ্ট বিজেপি নেতারা আসলে স্বস্তিতে নেই

বিজেপিতে আসলে বিজেপি কতজন? ধাঁধার মতো মনে হচ্ছে কি? হলফ করে বলা যায়, নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে অমিত শাহ, জেপি নড্ডারাও চট করে এই ধাঁধার উত্তর দিতে পারবেন না। আঙুলের কর গুনে সংখ্যা বলতে তাঁদেরও যথেষ্ট সময় লাগবে। মহারাষ্ট্রের রাজ্যসভা সাংসদ সঞ্জয় রাউতের হিসাবে বিজেপির ৩০৩-জন লোকসভা সাংসদের মাত্র ১০১-জন প্রথম থেকে বিজেপি। ২০২ জনের বেশি হয় অন্য দলের হয়ে ভোটে জিতে পরে বিজেপি হয়েছেন, না হলে ভোটের ঠিক আগে সুবিধা বুঝে শাসকদলে এসেছেন।

তা হলে এবারের ভোটে নরেন্দ্র মোদির ‘৪০০ পার’ স্লোগান! না হলেও অন্তত অমিত শাহের বলা ৩৭০ সাংসদের ভাণ্ডার পূর্ণ হবে কাদের দিয়ে? বিজেপি যাদের দাঁড় করাবে কিংবা ভোটের পর কিনবে বলে ছক কষছে তাদের বেশিরভাগই তো আসলে বিজেপি নয়! বাস্তবটা হল মোদি সাহেব নিজেই তাঁর সরকার তথা দলের দুর্বলতা সবচেয়ে ভাল জানেন। তাঁর বাহিনীর রথী-মহারথীদের অনেকেরই যে (একটু চক্ষুলজ্জার রেশ যদি থেকে গিয়ে থাকে কারও) ভোটারদের সামনে দাঁড়াতে পা কাঁপবে, তা তাঁর জানা।

তাঁরা দশ দশটা বছর কেন্দ্রের গদিতে। মোদি সাহেবের দল এখন বেশ কয়েকটি রাজ্যেও সরকার চালাচ্ছে। তাই এখন আর বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিকের কাজের উপযুক্ত বেতন না মেলা, কৃষকের ফসলের দাম না মেলার দায় কংগ্রেসের উপর চাপিয়ে নিজেদের জামা পরিষ্কার রাখার উপায় নেই। মোদি সাহেব জানেন, তাঁর ‘বিকশিত ভারত’ স্লোগানের জোরে সঙ্কটের চিঁড়ে ভিজবার নয়। তাঁর জমানায় ‘বিকাশের’ চোটে মুষ্টিমেয় ধনীদের কেনার উপযুক্ত গাড়ি, বাড়ি, বিলাস দ্রব্যের চাহিদা বেড়েছে। কমেছে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।

এই পরিস্থিতিতে অন্য দলের থেকে এমপি-এমএলএ কেনা ছাড়া তাঁর আর অন্য উপায় নেই। অবশ্য সম্প্রতি চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনের সময় রিটার্নিং অফিসারের সাহায্যে কারচুপিতে তাঁরা যে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন সেটাও একটা রাস্তা হতে পারে। মোদি সাহেবরা ভালই জানেন, এ তাঁদের শক্তির লক্ষণ নয়, বরং চরম দুর্বলতার প্রকাশ। আত্মবিশ্বাস থাকলে কংগ্রেস, তৃণমূল, এনসিপির নেতাদের কিনে দলের ভাণ্ডার ভরাতে বিজেপিকে ঝাঁপাতে হত না।

এখন বিজেপির একাধিক মুখ্যমন্ত্রী, লোকসভা-রাজ্যসভার সাংসদ আসলে কংগ্রেসের পুরনো মুখ। অবস্থা দেখে রাজনৈতিক মহলে এমন কথাও উঠেছে– বিজেপির ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ স্লোগান কি অবশেষে ‘কংগ্রেস-অধ্যুষিত’ বিজেপিতে পৌঁছেছে? সদ্য শেষ হওয়া রাজ্যসভার ভোটে মহারাষ্ট্র থেকে বিজেপির টিকিটে জিতেছেন কংগ্রেস সরকারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক চহ্বন। বিজেপিরই প্রকাশিত শ্বেতপত্রে স্থান পাওয়া ‘আদর্শ আবাসন কেলেঙ্কারি’-র প্রধান অভিযুক্ত তিনি। অবশ্য মহারাষ্ট্রে বিজেপির জোট সরকারটাই চলছে দল-ভাঙানোর খেলার জোরে। শিবসেনা এবং শারদ পাওয়ারের এনসিপিতে ভাঙনের খেলায় কত শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে, কোন কোন দুর্নীতি চাপা দিয়ে রাখার গোপন বোঝাপড়া হয়েছে তা বিজেপি নেতাদের বলবার সাহস আছে? সম্প্রতি হিমাচল প্রদেশে একটা রাজ্যসভা আসন জেতার জন্য বিজেপি যেভাবে কংগ্রেসের বিধায়কদের টোপ দিয়েছে তাও মানুষের স্মৃতিতে টাটকা। বিজেপি সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছে। কিন্তু তার কারিগর কংগ্রেস-ভাঙা নেতারা। পাঁচ বছর আগে মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি হেরে গেলেও কিছুদিনের মধ্যে কংগ্রেসের ২২ জন এমএলএ-কে কিনে নিয়ে সরকার দখল করে নিয়েছিল। গোয়াতে ২০২২-এ একইভাবে ভোটের পর কংগ্রেসের জেতা এমএলএদের ভাঙিয়ে সরকার গড়েছে বিজেপি। কর্ণাটক, উত্তরাখণ্ড, অরুণাচলে একই রকম কাজ করেছে বিজেপি। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ২০১৫-র আগস্ট পর্যন্ত ছিলেন কংগ্রেসের নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে চিটফান্ড সহ বহু দুর্নীতির অভিযোগ আগে তুলত বিজেপি, এখন তিনি শুদ্ধ! মণিপুরের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বীরেন্দ্র সিং, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা দুজনেই কংগ্রেসের পুরনো পরিচিত নেতা। মণিপুরে ৮ জন কংগ্রেস এমএলএ নিজের দল সরকারিভাবে না ছেড়েও বিজেপির সরকারকে সমর্থন করেছেন।

অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অভিজ্ঞতাও এক। এ রাজ্যের বিজেপির সর্বাধিক প্রচারিত মুখ তথা বিধানসভায় বিজেপির পক্ষে বিরোধী দলনেতা মাত্র কয়েক বছর আগেই ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান মুখ। নারদ স্টিং অপারেশনে তাঁর টাকা নেওয়ার ছবি বিজেপি একসময় খুব ছড়িয়েছিল। কোচবিহারের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক তৃণমূলের নেতা থাকার সময় বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে বহু অনৈতিক কাজের অভিযোগ তুলত। এখন তিনিই বিজেপি নেতা। দক্ষিণ দিনাজপুরের এমএলএ সৌমেন রায় বিজেপির হয়ে জিতে তৃণমূলে চলে গিয়েছিলেন, এখন জানা গেল তিনি হঠাৎ আবার বিজেপিতে ফিরেছেন। ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংয়ের দলবদলের তালিকা মনে রাখাও বেশ দুরূহ। তিনি তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছিলেন। মাঝে আবার তিনি এসেছিলেন তৃণমূলে, কাগজে কলমে যদিও তিনি বিজেপিরই সাংসদ ছিলেন। তিনি আবার নাকি চলে গেছেন বিজেপিতে।

পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য দলবদলের খেলায় কোন পক্ষ জিতছে তা বলা মুশকিল। তবে এ ব্যাপারে কারও যে চক্ষুলজ্জারও বালাই নেই তা স্পষ্ট। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে দেখা গিয়েছিল সারদা-নারদা কেলেঙ্কারির দাগ সহ একাধিক তৃণমূল নেতা বিজেপিতে ঢুকছেন, তাঁরা নাকি তখন শ্বাস নিতে পারছিলেন না! আবার ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের পরে হাওয়া বুঝে তাঁরা তৃণমূলেই ফিরেছেন। তাঁদের অনেকেই সংবাদমাধ্যমের সামনে দল বদল করলেও সরকারিভাবে দলত্যাগ করেননি। কারণ দলত্যাগ বিরোধী আইনের কোপে নিজেদের এমএলএ বা এমপি-র গদিটা চলে গেলে সরকারি বেতন ও সুবিধা হাতছাড়া হবে। এই তালিকায় রাজ্যের বিরোধী দলনেতার পরিবারের দু’জন সাংসদও আছেন। যাঁরা নাকি তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইতে একমাত্র বিজেপিকেই চ্যাম্পিয়ন হিসাবে দেখতে পাচ্ছেন, তাঁরা এ ঘটনাগুলি জানেন কি?

অবশ্য কোনও ভোটসর্বস্ব দলেরই যে নীতি আদর্শ বলে কিছু নেই তা এ ঘটনায় স্পষ্ট। কংগ্রেস সহ বিরোধীরা যাদের নেতা বানিয়েছে তারাও উচ্চস্তরের সুযোগসন্ধানী অথবা দুর্নীতিবাজ। না হলে বিজেপি তাদের কিনতে পারত কি? কারণ ভোটে জিতে ক্ষমতা ভোগ করা ছাড়া অন্য কোনও নীতির চর্চা এরা কেউ করে না। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-সিপিএম জোটের হয়ে জিতেই বাইরন বিশ্বাসের তৃণমূলে ঢোকার ঘটনা মানুষ ভোলেনি। সিপিএমও কি বামপন্থা ও আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করেছে? করলে, তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর তাদের ফ্রন্টের শরিক দলগুলির ২৮ জন এমপি-এমএলএ এমনকি মন্ত্রী তৃণমূল কিংবা বিজেপিতে ঢুকেছেন, তার ১৯ জনই সিপিএম-এর টিকিটে জিতেছিলেন কী করে?

১৯৯৬-তে বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, সরকারে থাকতে হলে যদি কোনও দল ভাঙাতে হয়, তেমন জোটকে ছোঁয়া দূরে থাক আমরা দূর থেকে চিমটে দিয়েও স্পর্শ করব না। সে সময় কংগ্রেস ছিল শক্তিশালী, তাই আয়ারাম-গয়ারামের দল সেখানেই আশ্রয় নিত বেশি। এখন বিজেপির টাকা এবং অন্য জোর বেশি তাই সুযোগসন্ধানী নেতাদের ভিড় সেখানেই বেশি। বিজেপির রাজনৈতিক গুরু আরএসএসের ছাঁচে ঢালা যান্ত্রিক শৃঙ্খলার বহর দেখিয়ে যাঁরা একসময় বিজেপিকে ‘অন্যরকম দল’ বলে প্রচার করতেন, বিজেপির সেই নেতারা আজ আর মুখেও সে কথা আনেন না। একচেটিয়া ধনকুবের পুঁজিমালিকদের অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে যে ক্ষমতা ও ধনসম্পত্তি এখন বিজেপি নেতারা ভোগ করছেন, তা রক্ষা করতে কোনও অনৈতিক পথ নিতে তাঁদের কোনও বাছবিচারের বালাই নেই। এরই ফল ভোগ করছে দেশের জনগণ।

এই হল আজকের সংসদীয় ব্যবস্থার চরিত্র। বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া দলগুলোর মোড়ক নানা রঙের, ভিতরের বস্তুটি একই রকমের পচা দুর্গন্ধময়।