বন্ড কেলেঙ্কারিঃ  বিজেপিকে টাকা দিলেই রেহাই দুর্নীতির অভিযোগ থেকে!

দিল্লিতে আবগারি দুর্নীতির অভিযোগে ইডির হাতে এখন বন্দি মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। সেই মামলায় একদা প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন, অরবিন্দ ফার্মা নামে ওষুধ কোম্পানির মালিক পি শরৎচন্দ্র রেড্ডি। ২০২২-এর ১০ নভেম্বর রেড্ডিসাহেব গ্রেফতার হওয়ার পাঁচ দিন পরেই তাঁর কোম্পানি ৫ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনে বিজেপি তহবিলে জমা করে দেয়। ২০২৩-এর মে মাসে কোমর ব্যথার অজুহাতে তিনি হাইকোর্টে জামিন চাইলে ইডি আপত্তি করেনি। ইডি তাদের হেফাজতে থাকা কারও জামিনে সায় দিয়েছে এটা আইন-আদালত সম্পর্কে খোঁজ রাখা কেউ মনে করতে পারছেন না। এমনকি অতি সম্প্রতি বিনা বিচারে দিনের পর দিন কাউকে আটকে রাখার প্রবণতার জন্য সুপ্রিম কোর্ট ইডি-র সমালোচনা করেছে। বন্ড তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর দেখা গেছে, অরবিন্দ ফার্মা মোট ৫২ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে, তার ৩৪.৫ কোটি টাকা গেছে বিজেপির কাছে। রেড্ডি অন্য সংস্থা ১০ কোটি টাকা বিজেপিকে দিয়েছে। এই রেড্ডিএখন সরকার পক্ষের রাজসাক্ষী, তার বিবৃতির ভিত্তিতেই নাকি গ্রেফতার আপের একাধিক নেতা সহ মুখ্যমন্ত্রী!

(আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩.০৩.২৪)

২০১৪-তে কংগ্রেসের নেতা তথা সনিয়া গান্ধীর জামাই রবার্ট বঢরা, হরিয়ানায় কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিং হুডা এবং ডিএলএফ কোম্পানির বিরুদ্ধে জমি দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ব্যাপক প্রচার করেছিল বিজেপি। ২০১৯-এ ডিএলএফ অফিসে তল্লাশি করে সিবিআই। নির্বাচনী বন্ডের তথ্য প্রকাশ পেতে দেখা যাচ্ছে এর পরেই ডিএলএফ গোষ্ঠীর তিনটি কোম্পানি মিলে ১৭০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে বিজেপিকে দেয়। তার পরেই হরিয়ানার বিজেপি সরকার পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে জানায়, এই জমি লেনদেনে কোনও দুর্নীতি হয়নি। অবশ্য বঢরা সমাজমাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার অভিযোগ তোলার পর বিজেপি সরকার আবার জানায় এখনও কাউকেই তারা ক্লিনচিট দেয়নি। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪.০৩.২৪)

বন্ড কেলেঙ্কারিঃ টাকা ঢাললেই সাত খুন মাফ! এটাই নীতি শাসক বিজেপি-র

শাসক দলের তহবিলে বিপুল টাকা ঢেলে একের পর এক কোম্পানি কী ভাবে নানা অন্যায় ও বেআইনি সুযোগ-সুবিধা লুটেছে, নির্বাচনী বন্ড নিয়ে দেশজোড়া তোলপাড়ে তা প্রকাশ্যে এসে গেছে। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে সম্প্রতি উঠে এসেছে এরকম আরও একটি কোম্পানির নাম– নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড।

অনেকেরই মনে আছে কয়েক মাস আগে উত্তরাখণ্ডের সিল্কিয়ারায় সুড়ঙ্গ ধসে কী ভাবে বিপন্ন হয়েছিল ৪১ জন শ্রমিকের প্রাণ। ১৬ দিন পরে একদল র্যাটহোল মাইনার শ্রমিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের উদ্ধার করেছিলেন। প্রকাশ্যে এসে গিয়েছিল, সুড়ঙ্গ তৈরি করতে গিয়ে ওই নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি নিরাপত্তার বহু নিয়ম অমান্য করেছিল যার জেরে এই ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি। সংস্থাটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জোরালো দাবি ওঠা সত্ত্বেও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কিন্তু সেই সময় নড়ে বসেনি।

এখন জানা যাচ্ছে, ওই নির্মাণ সংস্থা ২০১৯ থেকে ২০২২-এর মধ্যে একে একে ৫৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনে এবং পুরো টাকাটাই ঢালে বিজেপির তহবিলে। সুড়ঙ্গ তৈরির বরাত পাওয়া এবং নিরাপত্তার নিয়ম না মেনে এতগুলি মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার এমন ভয়ঙ্কর অপরাধের পরেও সংস্থাটির বিরুদ্ধে বিজেপি সরকারের টুঁ শব্দটি না করার পিছনে যে কাজ করেছে ওই বিপুল অনুদান, বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় কি?

কর্পোরেটের চাঁদাতেও এগিয়ে বিজেপি, সিপিএমও বাদ যায়নি

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর)-এর হিসাব অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো যত চাঁদা দিয়েছে তার ৯০ শতাংশ গেছে বিজেপির তহবিলে। তারা পেয়েছে ৬৮০.৪৯৫ কোটি টাকা। বাকি সব জাতীয় দল মিলে পেয়েছে ৭০ কোটির কিছু বেশি। কংগ্রেস পেয়েছে ৫৫.৬২৫ কোটি টাকা, আপ ১১ কোটি টাকা, সিপিএম ২ কোটি ৮৯ লক্ষ টাকা। সিপিএম নির্বাচনী বন্ড থেকে কোনও টাকা না নিলেও ধারাবহিকভাবে কর্পোরেট কোম্পানির থেকে টাকা নিয়েছে। ২০১৪-২০১৮ পর্যন্ত তারা কর্পোরেট থেকে পেয়েছে ৩ কোটি ১৬ লক্ষ টাকা। ২০১৯-২০২২-এ নিয়েছে ৬.৯১৫ কোটি টাকা (অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট এবং বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১০.০৪.২২)। ২০২১-২২ থেকে কংগ্রেসের সামগ্রিক এবং কর্পোরেটদের থেকে পাওয়া অনুদান ১৬ শতাংশের বেশি কমেছে, বিজেপির বেড়েছে ১৭.২ শতাংশ।

জাতীয় দলগুলির মধ্যে এই সময় কর্পোরট কোম্পানির টাকা এবং অন্য বড় অনুদান পাওয়ায় সিপিএমের হার সবচেয়ে বেশি কমেছে (৩৯.৫৬ শতাংশ)। অবশ্য তারপরেও তারা ২০২২-২৩-এ ৬ কোটি ৭৭ লক্ষ টাকার বড় অনুদান পেয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, যে দলের সংসদীয় ক্ষমতা বেশি, বৃহৎ ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিরা তাদেরঢেলে টাকা দিয়েছে, বাকিদের ভাগ কমেছে। তবে তারা নিজেদের কোনও সেবাদাস দলকেই একেবারে বঞিত করেনি। এক্ষেত্রে ঘোষিত বুর্জোয়া দলগুলি নির্বাচনী বন্ড থেকে গোপনে টাকা নিয়েছে। বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিএম নির্বাচনী বন্ডের টাকা না নিয়েও কর্পোরেট কোম্পানির অশীর্বাদ থেকে বাদ যায়নি। (এডিআর রিপোর্ট ‘২২-’২৩)

এ কোন সান্তা ক্লজ’, ড্রপ বক্সে কোটি কোটি টাকার বন্ড ফেলে যায়!

শিশু ভোলানো গল্প অনুসারে বড়দিনের আগে শিশুদের মাথার কাছে গোপনে উপহার রেখে যায় সান্তা ক্লজ। এখন জানা যাচ্ছে ভোটের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের অফিসের ড্রপ বক্সে এমনই কেউ নাকি গোপনে কোটি কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড ফেলে দিয়ে গেছে! কেউ আবার নাকি চুপি চুপি বার্তাবহ দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। তৃণমূলের দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি নির্বাচনী বন্ড প্রাপ্তির ব্যাখ্যায় এমন রহস্য কাহিনীই শুনিয়েছেন সে দলের নেতারা ।

একই রকম দাবি, সম্প্রতি বিজেপির কোলে ফিরে আসা নীতীশ কুমারের দলের। এভাবেই নাকি ১০ কোটি টাকা তাঁদের কেউ পাঠিয়ে দিয়েছে, তাঁরা জানতেও পারেননি! এমনই অজানা সান্তা ক্লজের আশীর্বাদের কাহিনী শুনিয়েছেন, এনসিপি, তেলুগু দেশম, সমাজবাদী পার্টি ইত্যাদির নেতারা। জনগণ গালে হাত দিয়ে ভাবছে– আহা রে! আমাদের অনাহারের দিনগুলোতেও যদি এমন করে দু’মুঠো চাল হাঁড়িতে রেখে যেত ওই সান্তা!