১০ মাস ধরে চলা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে সারা ভারতের খেটে খাওয়া মানুষ পালন করেছেন ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধ। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি বনধের বিরোধিতায় নেমে শহরাঞ্চলে কিছু পরিবহণ এবং কিছু সংখ্যক শিল্পকে জোর করে খোলা রাখতে পারলেও গ্রামীণ ভারতে এই বনধ হয়েছে প্রায় সর্বাত্মক। খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আন্দোলনমুখী মানসিকতা দেখে ভীত বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার কর্ণধাররা কখনও বলছেন কৃষকরা আন্দোলন ছেড়ে আলোচনায় বসুন, যেন কৃষকরা আলোচনার ডাককে উপেক্ষা করেছেন! বাস্তবে সরকার যে আলোচনার নামে টালবাহানা করে কৃষি আইন প্রত্যাহারের আসল দাবিটি শুনতেই চায়নি এই সত্যকে আড়াল করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি দেখা যাচ্ছে এই শোষণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ বিচারব্যবস্থাকেও আন্দোলন বিরোধিতায় ব্যবহারের চেষ্টা করছে শাসক শ্রেণি। শীর্ষ আদালতের দুই বিচারপতি দীর্ঘ দিন ধরে চলা কৃষক আন্দোলন নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। আবার কৌশলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কৃষি আইন নিয়ে আপত্তির কারণগুলি নাকি আন্দোলনকারীরা সুনির্দিষ্ট করে বলতেই পারছেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন-উত্তরের আকারে তা তুলে ধরা হল।
প্রশ্নঃ ২৬ নভেম্বর ২০২০ থেকে দিল্লিতে যে কৃষক আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটেছে, এমন আন্দোলন স্মরণকালের মধ্যে ঘটেনি। লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রবল ঠাণ্ডা কিংবা অসহনীয় গরম সহ্য করে আন্দোলনে সামিল। ইমিধ্যেই ৬০০ জনেরও বেশি আন্দোলনকারী প্রাণ দিয়েছেন। সাড়া ফেলে দেওয়া এই আন্দোলনে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের স্বার্থ কীভাবে জড়িত?
উত্তরঃ একথা ঠিক, আন্দোলনটা কৃষকরাই শুরু করেছেন। সেই অর্থে কৃষক আন্দোলনের চরিত্র নিয়েই এটা গড়ে উঠেছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে সরকারের অনড় মনোভাবের কারণে এই আন্দোলনের তীব্রতাও বাড়ছে এবং দিল্লির রাজপথ শুধু নয়, সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে।
কয়েকশো কৃষক সংগঠনের যুক্ত মঞ্চ এসকেএম (সংযুক্ত কিসান মোর্চা)-র শরিক সংগঠনগুলি, বিশেষ করে এআইকেকেএমএস বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিদিনই বিক্ষোভ, ধরনা, অনশন, অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছে। কৃষক সংগঠনগুলির ডাকে গত বছর গ্রামীণ ভারত বনধ হয়েছে, ভারত জুড়ে সাধারণ ধর্মঘটও হয়েছে কয়েকবার। কয়েক কোটি মানুষ ধর্মঘট সফল করতে সক্রিয়ভাবে সামিল হয়েছে। দেশের শ্রমিক কর্মচারীরা এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-যুব-মহিলারাও আন্দোলনের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছে। অভিনেতা থেকে গায়ক, ক্রীড়াবিদ– একের পর এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা আন্দোলনকে সমর্থন করছেন প্রকাশ্যে। সরকারের দেওয়া পদক ফিরিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধের দিন দেখা গেল হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশের পাশাপশি উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, ঝাড়খণ্ডেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। বিজেপি সরকারের দেখানো ভয় ভীতি উপেক্ষা করে আসাম, কর্নাটকের মতো রাজ্যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে, ওড়িশা, তামিলনাডু মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে কৃষক-শ্রমিকরা বিপুল সংখ্যায় রাস্তায় নেমেছেন। পশ্চিমবঙ্গে উত্তরবঙ্গ জুড়ে বনধ ছিল প্রায় সর্বাত্মক। দক্ষিণবঙ্গেও বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগণা, ঝাড়গ্রাম, দুই মেদিনীপুর সহ সর্বত্র পরিবহণ, বাজার সমস্ত কিছু প্রায় স্তব্ধ ছিল। এ আই ইউ টি ইউ সি সহ বেশকিছু শ্রমিক সংগঠন যথাসাধ্য শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে এই আন্দোলনের পাশে। শ্রমিকদের সাথে ছাত্র-যুব-মহিলারাও আছেন আন্দোলনের পাশে। তাঁরা বলছেন কৃষক অন্নদাতা। শুধু সে আজ বিপন্ন তাই নয়, এই আইন সমস্ত গরিব মধ্যবিত্তের জীবনে আক্রমণ তীব্রতর করবে– এটা উপলব্ধি করে সমাজের বাকি অংশের সব পেশার মানুষ আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
প্রশ্নঃ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন এই কৃষিনীতি ‘যুগান্তকারী’, ‘ঐতিহাসিক’। তাঁর রেডিও অনুষ্ঠান ‘মন কি বাত’-এ তিনি বলেছেন, এই আইনে কৃষকদের দীর্ঘ দিনের শৃঙ্খল মোচন ঘটেছে। সত্যিই কি তাই?
উত্তরঃ এই কৃষিনীতি সত্যিই যুগান্তকারী। কিন্তু তা কৃষকের স্বার্থে যুগান্তকারী নয়, আম্বানি-আদানিদের মতো একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে যুগান্তকারী।
এই কৃষিনীতিকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন শৃঙ্খল মোচনকারী। বাস্তবে কৃষকরা কোথায় শৃঙ্খলিত এবং সেই শৃঙ্খলটিই বা কী? শৃঙ্খলটা আজ প্রকাশ্যে এবং তা হল– পুঁজির শোষণের শৃঙ্খল, যে শৃঙ্খলে কৃষক ইতিমধ্যেই বাঁধা পড়েছে। যে সার, বীজ, কীটনাশক দিয়ে কৃষক চাষ করে তার কোনওটির উপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ নেই, নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বড় বড় পুঁজিপতিদের। তারা যে দাম নির্ধারণ করে কৃষক সেই দামে কিনতে বাধ্য হয়। আবার ফসল বিক্রির সময় কৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা বড় বড় কোম্পানির মালিকরা যেটুকু দাম দেবে, সেই দামেই কৃষককে বিক্রি করতে হবে। দাম ঠিক করার অধিকার বা স্বাধীনতা কিছুই কৃষকের নেই। সরকারি উদ্যোগে কেনার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল বলে বৃহৎ ব্যবসায়ী বা তাদের এজেন্টরা কৃষকদের এভাবে শোষণ করেই চলেছে। নতুন কৃষি আইনে সরকারি উদ্যোগে কেনার ব্যবস্থা আরও দুর্বল হবে, বেচাকেনার মান্ডিগুলো অকার্যকরী হয়ে যাবে। নূ্যনতম সহায়ক মূল্যও (এমএসপি) উঠে যাবে। সরকার যতই বলুক এমএসপি থাকছে, নতুন কৃষি আইনে এমএসপি-র অস্তিত্বকে স্বীকারই করা হয়নি। ফলে এমএসপি-তে ফসল কেনার দায় সরকারের নিজেরই থাকছে না, বেসরকারি কোম্পানির ক্ষেত্রে তো তার প্রশ্নই নেই। এই কৃষি আইনে শৃঙ্খল মোচনের পরিবর্তে কৃষকরা পুঁজিপতিদের শোষণের শৃঙ্খলে আরও বেশি বেশি করে বাঁধা পড়বে।
প্রশ্নঃ প্রথম কৃষি আইনটি মুক্ত বাণিজ্য সম্পর্কিত। এতে মান্ডির বাইরেও কৃষিপণ্য বিক্রির অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে বৃহৎ কৃষি বাণিজ্য-কোম্পানিগুলি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনবে। কোনও মধ্যসত্বভোগী থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এতে কৃষক ন্যায্য দাম পাবে।
উত্তরঃ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সাথে বাস্তবের কোনও মিল নেই। বর্তমানে মান্ডি এবং মান্ডির বাইরে দু’জায়গাতেই বেচাকেনার ব্যবস্থা আছে। যেখানে মান্ডি নেই, সেখানে কি এখন কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছে? বৃহৎ ব্যবসায়ী ও তাদের এজেন্টদের শক্তিশালী চক্র দাম নামিয়ে দিচ্ছে। মান্ডি থাকলে সেখানে নূ্যনতম সহায়ক মূল্য পাওয়ার একটা সুযোগ থাকে। নতুন কৃষি আইনে মান্ডির বাইরে বিক্রির বৈধতা দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে বড় বড় বহুজাতিক এগ্রো কোম্পানিরা কৃষিপণ্য কিনবে। কিন্তু পুঁজি মালিকদের চরিত্র অনুযায়ী তারা সর্বদাই চেষ্টা করবে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের। কৃষককে সবচেয়ে কম না দিলে তা কি সম্ভব? বাস্তব জ্ঞান বলে, না! কোম্পানির মুনাফা জোগাতে বলি দেওয়া হবে কৃষককে।
মান্ডির বাইরে বিক্রির অধিকার দিতে হবে– এটা কোনও দিনই কৃষকের দাবি ছিল না। কৃষকের দাবি ছিল, সরকারকে সরাসরি ন্যায্য মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে ফসল কিনতে হবে। কারণ যুগযুগ ধরে সে প্রতারিত হচ্ছে বৃহৎ ব্যবসায়ী ও তার এজেন্টদের দ্বারা। মান্ডির বাইরে বিক্রির অধিকার দেওয়ার দাবি তুলেছে খাদ্যপণ্যের একচেটিয়া মালিকরা। তীব্র বাজার সংকটে জর্জরিত পুঁজিপতিরা খাদ্য পণ্যের ব্যবসায় ঢুকতে দীর্ঘ দিন ধরে সরকারের উপর চাপ বাড়াচ্ছিল যাতে সরকার পুরনো আইন বাতিল করে একটা নতুন আইন করে দেয়। এদের খুশি করতেই সরকার নতুন কৃষি আইন এনেছে।
কৃষিপণ্য কেনার অধিকার বৃহৎ পুঁজিমালিকদের দিয়ে দিলে বিপদটা দু’জায়গায়। প্রথমত, সে মুনাফা সর্বোচ্চ করতে প্রভাব খাটিয়ে কৃষককে কম দাম দেবে। দ্বিতীয়ত, সে খাদ্য পণ্যের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ইচ্ছা মতো দাম বাড়াবে। এতে গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শহরের সমস্ত ক্রেতার জীবন তীব্র মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার হবে। অনাহারে মরার উপক্রম হবে।
প্রশ্নঃ দ্বিতীয় কৃষি আইনটি মজুতদারি সম্পর্কিত। এতে মজুতের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। অত্যাবশ্যক পণ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে চাল, ডাল, গম, তৈলবীজ, আলু, পেঁয়াজ– এইসব নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যকে। এতে মজুতদারি বাড়বে। সরষের তেল যে ২০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে তা কি এই আইনের ফল?
উত্তরঃ পুঁজিপতিদের দালাল একদল বলছেন, মজুতদারির সুযোগ থাকলেই কি ইচ্ছামতো মজুতদারি হবে? প্রথমত, মজুতদারদের কারসাজিতে কী ভাবে দাম বাড়ে তা কি দেশের মানুষের অজানা? তা হলে যথেচ্ছ মজুতদারি বৈধ করতে আইন করা হল কেন? কেনই বা আইন পাশের আগেই রিলায়েন্স-আদানিদের মতো দৈত্যাকার কর্পোরেটগুলো বড় বড় গোডাউন বানিয়ে মজুতদারির পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে? মজুতদারিতে লাভ পুঁজিপতিশ্রেণির। তারা কম দামে পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। এই মজুতদারির জন্যই গত বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পেঁয়াজ হয়েছিল ৭০-৮০ টাকা কেজি, আলু হল ৪০-৫০ টাকা কেজি। সরষের তেলের কেজি এখন ২০০ টাকা ছাড়িয়েছে। অথচ দেশে সরষে চাষ কম হয়নি, চাষিও বাড়তি কোনও দাম পায়নি। তা হলে দাম বাড়ল কেন? সংবাদমাধ্যমই জানাচ্ছে ফরচুন ব্র্যান্ডের মালিক আদানি গোষ্ঠী, যে প্রধানমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ– বিপুল পরিমাণ সরষে মজুত করেছে। এভাবেই জনগণের পকেট কাটছে তারা।
প্রশ্নঃ কিন্তু দেশের বহু পণ্যের বাজারই তো একচেটিয়া পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে!
উত্তরঃ হ্যাঁ, তাই। কিন্তু এর বিপদটা কোথায়? প্রথমত, একচেটিয়া কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি জিনিসের দাম লাগাম ছাড়া। দ্বিতীয়ত, খাদ্যের সাথে বিলাসদ্রব্যের় একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। খাদ্যের নিয়ন্ত্রণ মুনাফাখোরদের হাতে ছেড়ে দিলে তারা মুনাফা লুটতে ইচ্ছামতো দাম বাড়াবেই এবং মানুষ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও তা কিনতে বাধ্য থাকবে। কারণ খাদ্য ছাড়া বাঁচা যায় না। সরকার পুঁজিপতিদের সেবাদাস হিসাবে কাজ করে চলেছে। তাদের কাছে পুঁজিপতিরা নির্দেশ পাঠাচ্ছে, অন্য পণ্যের মতো খাদ্যের বাজারও মুক্ত করে দাও। কারণ তীব্র মন্দায় হাবুডুবু খাওয়া পুঁজিপতিরা জানে যেভাবে হোক মানুষ খাদ্য কিনবে। এই বাজারের একটা স্থায়িত্ব আছে। সে জন্য তারা খাদ্য ব্যবসায় ঢুকতে চাইছে। এর পরিণাম ভয়াবহ। ফলে সাধারণ মানুষের স্বার্থের দিক থেকে বিচার করলে খাদ্যের ব্যবসা হওয়া উচিত সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় তদারকিতেই। তা ছাড়া খাদ্যের ব্যবসায় কর্পোরেটরা ঢুকলে দেশের লক্ষ লক্ষ খুচরো ব্যবসায়ী উচ্ছেদ হবে।
প্রশ্নঃ একদল প্রচার করেন, বাজারে অনেক বহুজাতিক পুঁজিপতির নিয়ন্ত্রণ কায়েম হলে প্রতিযোগিতায় দাম কমার তো একটা সুযোগ থাকেই।
উত্তরঃ এটা একেবারেই ভুল ধারণা। ওষুধের বাজারে বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ তো রয়েছে। তাতে কি দাম কমেছে? নাকি বেড়েই চলেছে? বহু রাজ্যে একাধিক কোম্পানি বিদ্যুৎ দেয়, তাতে বিদ্যুতের দাম কমেনি। কৃষিপণ্যের বাজারে বৃহৎ পুঁজিমালিকরা এলে তারা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে চাষির কাছ থেকে কেনার ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য রকম দাম কমাবে এবং বিক্রির সময় তা ইচ্ছে মতো বাড়াবে। প্রতিযোগিতায় দাম কমে– এটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বস্তাপচা, অতি সরলীকৃত একটা তত্ত্ব। অবাধ প্রতিযোগিতার সে যুগ বহুকাল আগেই গত হয়েছে। কৃষকরা বারবার ঠকতে ঠকতে এই সত্য সহজেই বোঝেন। তাই তাঁরা আন্দোলনে।
প্রশ্নঃ তৃতীয় কৃষি আইনটি হল চুক্তি চাষ সম্পর্কিত। এই আইনে কর্পোরেটরা চাষির সঙ্গে ফসল কেনায় চুক্তিবদ্ধ হবে। বলা হচ্ছে এটি কৃষকের পক্ষে লাভজনক। কারণ চুক্তিমাফিক সে দাম পাবে। ফড়েদের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার কোনও ব্যাপারই নেই। এই আইন নিয়ে চাষিদের আপত্তি কোথায় এবং কেন?
উত্তরঃ চুক্তি চাষ নিয়ে আপত্তির কারণ বহু। প্রথমত, চাষ করতে হবে বহুজাতিক কোম্পানির চাহিদা মতো। তারা যে ফসল চাষ করতে বলবে, কৃষককে সেটাই করতে হবে। অর্থাৎ চাষের ব্যাপারে কৃষকের স্বাধীনতা থাকবে না।
দ্বিতীয়ত, চুক্তি চাষে কৃষক বেশি দাম পাবে– এ যুক্তি ঠিক নয়। বাজারের গড়পড়তা দামের থেকে বেশি দাম কৃষককে একচেটিয়া মালিকরা দেবে কেন? বাস্তবে চুক্তি হবে সম্ভাব্য গড়পড়তা দামের থেকে কম দামেই। তাছাড়া চুক্তি অনুযায়ী যে দামে কৃষক ফসল বিক্রি করল, পরে যদি দাম বেশি হয় তা হলে তার লোকসান হবে।
তৃতীয়ত, চুক্তি হবে বিশেষ গুণমানের ফসলের ভিত্তিতে। সেই গুণমানের ফসল যদি প্রাকৃতিক কোনও কারণে না ফলে? যদি বৃষ্টিপাতের তারতম্য, আবহাওয়ার তারতম্য, কীটপতঙ্গের উৎপাত ইত্যাদি কারণে ফসল সেই গুণমানের না হয়? তা হলে সেই ফসল কোম্পানি নাও কিনবে না। কোম্পানি চাষিকে দায়ী করবে চুক্তিভঙ্গকারী হিসাবে। তখন যদি বিশেষ গুণমানের ফসল না দেওয়ার জন্য ব্যবসার ক্ষতি দেখিয়ে বিরাট অঙ্কের টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে তারা, কৃষক দেবে কোত্থেকে? নানা অজুহাতে কোম্পানি চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিতে অস্বীকার করলে, কী করবে অসংগঠিত কৃষক? কৃষককে ফাঁদে ফেলার বিপদ থাকছেই।
চতুর্থত, কোম্পানির সাথে বিবাদ নিয়ে আদালতে যাওয়ার অধিকার নেই কৃষকের। স্থানীয় প্রশাসনের ( ডিএম, এসডিও) দ্বারস্থ হতে হবে। সেই প্রশাসন টাকার থলির মালিকের বদলে চাষির পক্ষে থাকবে, এ আশা আদৌ বাস্তব কি? প্রশাসনের হাতেই বিচারের ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে সরকার। কার্যত বিচারব্যবস্থার উপরও এটা একটা আঘাত। প্রশাসনই হয়ে উঠছে বিচারক! যদিও আদালতে যেতে পারলেও সেখানে কি চাষি ন্যায় বিচার পেত? বিপুল অর্থবলে বলীয়ান কর্পোরেটদের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে কৃষক জিততে পারে? চুক্তি চাষ কৃষককে ফাঁদে ফেলার একটা মারাত্মক কৌশল।
প্রশ্নঃ নীতি আয়োগের বড় কর্তা অমিতাভ কান্ত কৃষি আইন পাশ হওয়ার পরে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, নব্বইয়ের (১৯৯০) আর্থিক সংস্কার এতদিনে কৃষিতেও এসে পৌঁছল। ‘৯০-এর আর্থিক সংস্কারের অভিমুখটা কী ছিল? তার সাথে বর্তমান কৃষি সংস্কারের সম্পর্কটিই বা কী?
উত্তরঃ ‘৯০-এর আর্থিক সংস্কারটিকে বলা হয় এক কথায় এলপিজি। লিবারেলাইজেশন প্রাইভেটাইজেশন ও গ্লোবালাইজেশন। এর মূল কথা হল, একচেটিয়া পুঁজির মালিকদের জন্য সব কিছু উদার করে দাও, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি সব তাদের হাতে তুলে দাও, আর বিশ্ব পুঁজির হাতে বাজার উন্মুক্ত করে দাও। কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে আসা এই সংস্কারের লক্ষ্য ছিল মন্দায় আক্রান্ত পুঁজিবাদী বাজারকে কিছুটা চাঙ্গা করা। সেদিনও একদল মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে এর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বায়নের ফল কী দাঁড়াল? ২০২১ সাল বিশ্বায়নের ৩০ বছর। নানা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে বিশ্বায়ন ব্যর্থ। পুঁজিবাদী বাজারে কোনও স্থায়িত্ব এল না। কেন এল না? কারণ পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রতি মুহূর্তে মন্দার জন্ম দিয়ে চলেছে। এখন পুঁজিপতিরা বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র হিসাবে কৃষির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের চাপেই সরকার কৃষিপণ্যের বাজার পুঁজিপতিদের জন্য খুলে দিয়েছে।
প্রশ্নঃ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অভিযোগ করেছেন, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই সংস্কার কংগ্রেস সরকারও আনতে চেয়েছিল।
উত্তরঃ পুঁজিপতিদের অন্যতম বিশ্বস্ত সেবক হিসাবে কংগ্রেস সরকারও শ্রম আইন, কৃষি আইন সংস্কার করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নানা কারণে পারেনি। বিজেপি সরকার সেটা পারল পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে। এখন ভোট রাজনীতির অঙ্ক কষে কংগ্রেস কৃষিনীতির বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছে। যে কংগ্রেস ‘৯০-এর আর্থিক সংস্কারের উদগাতা, যে কংগ্রেস কৃষি আইন সংস্কারের চেষ্টা করেছে, সেই কংগ্রেস কি আন্দোলনের শক্তি হতে পারে? দুর্ভাগ্য এই কংগ্রেসকেই আন্দোলনের শক্তি বলছে সিপিএম। কংগ্রেস কোথায় কৃষি নীতির বিরুদ্ধে লড়ছে? সিপিএমও কি তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে আন্দোলনে নেমেছে? ভোটের স্বার্থে যতটুকু আন্দোলন-আন্দোলন মহড়া দরকার তাই করছে।
প্রশ্নঃ কৃষি আইনের পক্ষে পুঁজিপতিরা, বিপক্ষে জনগণ। তা হলে আইনের চোখে সকলেই সমান– এই ধারণার ভিত্তি কী?
উত্তরঃ আইনের চোখে সকলেই সমান– এই ধারণাকে কৃষক আন্দোলন জোর ধাক্কা দিয়েছে। শুধু কৃষি আইন কেন, ৪৪টি শ্রম আইন পাল্টে যে চারটি নতুন শ্রম আইন এনেছে মোদি সরকার, তার পক্ষে বাজনা বাজাচ্ছে মালিকরা, আর বিরুদ্ধে লড়ছে শ্রমিকরা। কারণ সেই আইন মালিকের স্বার্থে। আইন সবার জন্য সমান, বাস্তবে এটা একটা মিথ্যা কথা। পুঁজিবাদী সমাজে আইন সবার জন্য সমান– এটা লিখিত-পড়িত থাকলেও বাস্তবে আইন হচ্ছে মালিক শ্রেণির জন্য। পুঁজিবাদী সমাজে যে আইনে শ্রমিক-চাষিদের পক্ষে সামান্য হলেও কিছু উল্লেখ আছে– সেগুলিও মালিকরা দ্রুত বদলে ফেলছে। এর মধ্য দিয়ে কর্পোরেটদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম হচ্ছে, যা ফ্যাসিবাদেরই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।