Breaking News

মানুষের জীবন নিয়ে এ ভাবেও ছিনিমিনি খেলা যায়!

 

কোভিডের টিকা পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ, অনিশ্চয়তার মধ্যেই ভুয়ো টিকাকাণ্ড নিয়ে রাজ্য জুড়ে আলোড়ন উঠেছে। এক প্রতারক কলকাতা পুরসভার জয়েন্ট কমিশনার হিসাবে নিজের পরিচয় দিয়ে একের পর এক ভুয়ো টিকাকরণ শিবির চালিয়েছে। সেইসব শিবিরে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের নেতৃস্থানীয় বেশ কয়েকজনের উপস্থিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তৃণমূলের এক সাংসদ পর্যন্ত ভুয়ো শিবিরে টিকা নিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। তাতেই সামনে এসেছে জালিয়াতির এই ভয়ঙ্কর ঘটনা। জানা গেছে, কোভিডের টিকার বদলে শিবিরগুলিতে অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে যা থেকে মৃত্যুও বিচিত্র নয়।

কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভুয়ো টিকার এমন ঘটনায় প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। পুলিশ ও পুরসভা দায় এড়াতে পারে না– এমন কথাও বলেছেন তিনি। এই প্রতারণা চক্রের পিছনে থাকা রাঘব-বোয়ালদের পুলিশ খুঁজে বের করে কি না, সময়ই তা বলবে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন, কোভিডের টিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লোক-ঠকানোর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হল কী করে? কলকাতার সাথে সাথেই মহারাষ্ট্রেও একই ধরনের জালিয়াতির অভিযোগ সামনে এসেছে। আরও কত ঘটনা চাপা আছে কে জানে!

কোভিড অতিমারি বিশ্ব জুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। এই রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনতে উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকাঠামো তৈরি রাখার পাশাপাশি সর্বাগ্রে প্রয়োজন সার্বিক টিকাকরণ, অর্থাৎ সরকারি উদ্যোগে দেশের প্রতিটি মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা। তার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে বিনামূল্যে টিকাকরণের কর্মসূচি সফল করাই ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। তার বদলে দেখা গেল, আমাদের ‘সর্বশক্তিমান’ প্রধানমন্ত্রী কোভিড টিকাকে একজন বিশেষ ব্যবসায়ীর মুনাফা লোটার হাতিয়ারে পরিণত করলেন। দ্রুত প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা দূরস্থান, বিভিন্ন সংস্থার কাছে বিভিন্ন দামে টিকা বিক্রির ব্যবস্থা করল কেন্দ্রীয় সরকার, যার সুযোগ নিল বেসরকারি স্বাস্থ্য-ব্যবসায়ীরা। ঘরে-বাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে অনেক দেরি করে শেষপর্যন্ত যখন বিনামূল্যে টিকার ঘোষণা হল, ততক্ষণে টিকা পাওয়া নিয়ে হাহাকার পড়ে গেছে। সঠিক সময়ে উপযুক্ত পরিমাণ টিকার জোগান না থাকায় মানুষ হন্যে হয়ে যেখানে পাওয়া যায় সেখানেই টিকা নেওয়ার সুযোগ খুঁজছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিই তো প্রতারকদের কাছে লোক-ঠকানোর সুবর্ণসুযোগ উপস্থিত করেছে! একা এই জালিয়াতটিই তো নয়, টিকা নিয়ে গত কয়েক মাসে রাজ্যে আরও কয়েকটি প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। টিকার নামে কোথাও অনলাইনে টাকা হাতানো হয়েছে। কোথাও টিকা প্রদানকারী সংস্থার নাম করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বয়স্ক মানুষকে বোকা বানিয়েছে ঠগবাজরা। অথচ গোড়া থেকেই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই টিকাকরণ কর্মসূচি যদি সম্পূর্ণ ভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকত, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটতে পারত কি? কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি নেতৃত্ব এর দায় এড়াতে পারেন না।

প্রশ্ন আছে আরও। জানা গেছে, এই প্রতারক কলকাতা পুরসভার জয়েন্ট কমিশনার পরিচয় দিয়ে জালিয়াতি চালাত। সেই পরিচয়েই সে একের পর এক ভুয়ো টিকাকরণ শিবির করেছে। সংবাদে প্রকাশ, আজ থেকে দশ বছর আগেই পুরসভার ওই পদটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও এত দিন ধরে সে ওই ভুয়ো পদ ব্যবহার করতে পারল কী করে! এই জালিয়াতি পুরসভার কর্তাদের কারও নজরে এল না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? নাকি তাঁরা সব জেনেও চোখ বুজে ছিলেন! শুধু তাই নয়, এই জালিয়াতটির নামে আগে থেকেই নানা অভিযোগ ছিল। খোদ পুরসভারই এক শীর্ষ কর্তা নিউমার্কেট থানায় এক সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। পুরসভায় চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে অনেকের কাছ থেকে নথি জমা নিয়েছিল সে। এমনকি পুরসভার কর্তাদের সই জাল করে এই জালিয়াত একাধিক ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্টও খুলেছিল, লেনদেন করেছিল বড় অঙ্কের টাকার! খোদ মেয়রের নামের সাথে তার নাম জুড়ে ফলক পর্যন্ত লাগানো হয়েছিল! এবার পুরসভার লোগো, ব্যানার ব্যবহার করে এই প্রতারক অবাধে ভুয়ো শিবির চালিয়ে গেল দিনের পর দিন! প্রশাসন ও শাসক দলের বড়কর্তাদের সঙ্গে যথেষ্ট সুসম্পর্ক না থাকলে এ ঘটনা যে ঘটতে পারে না, বুঝতে অসুবিধা হয় কি?

ভুয়ো টিকার এই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেছে। রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা যাদের কাজ, খোদ রাজধানী শহরে তাদের চোখের সামনে দিনের পর দিন ভুয়ো শিবির চালু থাকল, শয়ে শয়ে মানুষ টিকার নামে অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, অথচ পুলিশ ঘুণাক্ষরেও খবর পেল না, শিবিরগুলি সম্পর্কে খোঁজ নিল না, এ কথা কি বিশ্বাস করা যায়! নাকি, পুলিশমহলের বড়কর্তাদের ঠিকঠাক ‘খুশি’ করতে পারার সুবাদেই সে ছাড় পেয়ে গেছে! পুরসভা এবং কলকাতা পুলিশের বড়কর্তারা তার কাছ থেকে উপহার নিয়েছেন, সে কথাও তো ফাঁস হয়ে গেছে! ফলে শুধু এই প্রতারকের একার কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করলেই হবে না, আগামী দিনে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এই ধরনের জালিয়াতি রুখতে, এর পিছনে থাকা পুলিশ-প্রশাসন ও শাসক দলের রাঘব-বোয়ালদের অতি অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আতঙ্কিত রাজ্যবাসী জোর গলায় আজ এই দাবিই জানাচ্ছে সরকারের কাছে।

এই প্রসঙ্গে কোনও কোনও মহল থেকে পুলিশের সংখ্যাবৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। ওই দফতরে নাকি লোকবলের অভাব! প্রশ্ন হল, পুলিশের সংখ্যা বাড়ালেই কি বন্ধ হবে এই জালিয়াতি, না কি প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা! অন্যায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে আমরা রয়েছি, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে প্রশাসনের প্রতিটি স্তর আজ দুর্নীতিতে পূর্ণ। এর মধ্যেও সদিচ্ছা থাকলে, নাগরিকদের জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে পুলিশ-প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভাবে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে সরকার।

ফলে এই জালিয়াত ও তার পিছনে থাকা রাঘব-বোয়ালদের যথাযথ ভাবে চিহ্নিত করে রাজ্য সরকার প্রতারণা চক্রটির মূলোচ্ছেদ করে কি না, তা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাবে রাজ্যবাসীর জীবন বিপন্নকারী এই ধরনের ভয়ানক প্রতারণা রুখতে তাদের সদিচ্ছা কতখানি। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাজ্যবাসীর ভবিষ্যত জীবনের সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি।

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা