রাষ্ট্র ও বিপ্লব (৬)– লেনিন

শ্রেণিসংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি সর্বহারা একনায়কত্ব

এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার ষষ্ঠ কিস্তি।

১৮৫২ সালে মার্ক্স প্রশ্নটি যে ভাবে উত্থাপন করলেন

১৯০৭ সালে মেরিং ‘দি নিউ জেইট’ (নবযুগ) পত্রিকায় (খণ্ড ২৫, ২য় সংখ্যা, পৃঃ-১৬৪) ওয়েডেমেয়ার এর কাছে লেখা মার্ক্সের চিঠির (৫ মার্চ, ১৮৫২) অংশবিশেষ প্রকাশ করেন। এই চিঠিতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নিচের অসাধারণ পর্যবেক্ষণটিও ছিল ঃ ‘আমার নিজের কথা বলতে গেলে, আধুনিক সমাজে শ্রেণি বা শ্রেণি সংগ্রামের অস্তিত্ব আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নয়। আমার অনেক আগেই বুর্জোয়া ঐতিহাসিকেরা শ্রেণি সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশ এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা শ্রেণিগুলির অর্থনৈতিক গঠনতন্ত্র বর্ণনা করে গেছেন। নতুন যা আমি প্রমাণ করেছি তা হল– (১) উৎপাদন বিকাশের সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক স্তরের সঙ্গেই কেবলমাত্র শ্রেণিগুলির অস্তিত্বের প্রশ্নটি জড়িত। (২) শ্রেণি সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি সর্বহারার একনায়কত্ব। (৩) এই একনায়কত্বের অবস্থানই হচ্ছে শুধুমাত্র সমস্ত শ্রেণির বিলোপ ও শ্রেণিহীন সমাজে উত্তরণের জন্য।ক্স

এই কথাগুলির মধ্যে আশ্চর্য স্পষ্টতায় মার্ক্স যা দেখিয়েছেন, প্রথমত, বুর্জোয়া চিন্তানায়কদের মধ্যে যাঁরা সর্বাপেক্ষা অগ্রগণ্য, যাঁদের চিন্তা সবচেয়ে গভীর, তাঁদের তত্তে্বর সঙ্গে মার্ক্সের তত্তে্বর প্রধান ও মৌলিক পার্থক্য, এবং দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র সম্পর্কিত তাঁর তত্তে্বর সারবস্তু।

এটা প্রায়শই বলা এবং লেখা হয় যে, মার্ক্সীয় তত্ত্বের মূল কথা হল শ্রেণিসংগ্রাম। কিন্তু এ কথা সত্য নয়। এবং এই ভ্রান্তচিন্তা থেকে প্রায়ই মার্ক্সবাদের সুবিধাবাদী বিকৃতিকরণ ঘটে, বুর্জোয়াদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য মার্ক্সবাদের মিথ্যা রূপ দেওয়া হয়। শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বটি মার্ক্সের আবিষ্কার নয়, মার্ক্সের আগেই বুর্জোয়ারা এই তত্তে্বর আবিষ্কর্তা এবং সাধারণভাবে বলতে গেলে এই তত্ত্ব বুর্জোয়াদের কাছে গ্রহণযোগ্য। শুধু শ্রেণিসংগ্রাম স্বীকার করলেই একজন মার্ক্সবাদী হয়ে ওঠেন না। এমনও হতে পারে, তিনি হয়তো তখনও বুর্জোয়া যুক্তিধারা ও বুর্জোয়া রাজনীতির গণ্ডি পার হননি। মার্ক্সবাদকে শুধুমাত্র শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে সীমাবদ্ধ রাখার অর্থ তার অঙ্গচ্ছেদ করা, বিকৃত করা, বুর্জোয়াদের গ্রহণযোগ্য একটা কিছুতে মার্ক্সবাদকে নামিয়ে আনা। তিনিই মার্ক্সবাদী যিনি শ্রেণিসংগ্রামের স্বীকৃতি থেকে আরও এগিয়ে সর্বহারার একনায়কত্ব স্বীকার করেন। এই হল পেটিবুর্জোয়া তথা বৃহৎ বুর্জোয়া এবং মার্ক্সবাদীদের মধ্যেকার সর্বপ্রধান পার্থক্য। এই কষ্টিপাথরেই যাচাই করতে হবে মার্ক্সবাদের প্রকৃত উপলব্ধি ও স্বীকৃতিকে। এ কথা মোটেই আশ্চর্যজনক নয় যে, ইউরোপের ইতিহাস যখন শ্রমিক শ্রেণিকে বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল, তখন শুধু সুবিধাবাদী এবং সংশোধনবাদীরাই নয়, সমস্ত কাউটস্কিপন্থীরাও (যারা সংশোধনবাদ এবং মার্ক্সবাদের মধ্যে দোদুল্যমান) সর্বহারার একনায়কত্ব অস্বীকার করে নিজেদের হতভাগা কূপমণ্ডুক এবং পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রী হিসাবে প্রমাণ করল। বর্তমান বইটি (রাষ্ট্র ও বিপ্লব) প্রকাশেরও অনেক পরে ১৯১৮ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত ‘সর্বহারা একনায়কতন্ত্র’ নামে কাউটস্কির লেখা পুস্তিকাটি মার্ক্সবাদের পেটিবুর্জোয়া বিকৃতি এবং ভণ্ডের মতো মুখে স্বীকার করে কার্যক্ষেত্রে মার্ক্সবাদকে হীনভাবে বর্জনের একটি নিখুঁত উদাহরণ (পেট্রোগ্রাদ ও মস্কো থেকে ১৯১৮ সালে প্রকাশিত আমার ‘সর্বহারা বিপ্লব ও দলত্যাগী কাউটস্কি’ বইটি দ্রষ্টব্য)।

এক সময়ের মার্ক্সবাদী কার্ল কাউটসস্কি হলেন বর্তমান কালের সুবিধাবাদের প্রধান মুখপাত্র। বুর্জোয়াসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতির বৈশিষ্ট্য, মার্ক্স যা উপরে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদে বর্ণনা করেছেন, আজকের দিনের এই সুবিধাবাদ সেই বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়। কারণ এই সুবিধাবাদ শ্রেণিসংগ্রামের স্বীকৃতিকে বুর্জোয়া সম্পর্কের ক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে (এই ক্ষেত্রের মধ্যে, এর কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখলে কোনও শিক্ষিত উদারনীতিকই ‘নীতিগত ভাবে’ শ্রেণিসংগ্রামকে অস্বীকার করবেন না!) পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের যুগ পর্যন্ত, বুর্জোয়া শ্রেণিকে উচ্ছেদ করে সম্পূর্ণরূপে তাদের বিলুপ্ত করার যুগ পর্যন্ত শ্রেণিসংগ্রামকে স্বীকার করাই আসল কথা– সুবিধাবাদ এতদূর পর্যন্ত শ্রেণিসংগ্রামকে স্বীকার করে না।

প্রকৃতপক্ষে এটি এমন এক সময়কাল যেখানে অভূতপূর্ব তীব্রতায় অভূতপূর্ব শ্রেণিসংগ্রাম দেখা দেওয়াটা অনিবার্য। যার ফলশ্রুতিতে এই পর্যায়ে রাষ্ট্রকে অবধারিত ভাবেই হতে হয় এক নতুন ধরনের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (অর্থাৎ সর্বহারা শ্রেণি এবং সাধারণভাবে সকল বিত্তহীনদের জন্য) এবং নতুন ধরনের একাধিপত্যমূলক (অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে) রাষ্ট্র।

আর এক ধাপ এগিয়ে বলা যায়, মার্ক্সের রাষ্ট্রবিষয়ক তত্ত্বের সারমর্ম তারাই প্রকৃতপক্ষে উপলব্ধি করেছে, যারা বুঝেছে যে, একটি শ্রেণির একনায়কত্ব সাধারণভাবে কেবল প্রতিটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজের জন্য বা বুর্জোয়া শ্রেণিকে উৎখাতকারী সর্বহারা শ্রেণির জন্যই জরুরি নয়, এটা পুঁজিবাদ থেকে শ্রেণিহীন সমাজ তথা সাম্যবাদে উত্তরণের সমগ্র ঐতিহাসিক পর্বটার জন্যও জরুরি। বুর্জোয়া রাষ্টে্র্রর রূপ বহু বিচিত্র হলেও কিন্তু তাদের অন্তঃসার কিন্তু এক ঃ এই রাষ্ট্রগুলির রূপ যাই হোক না কেন শেষ বিচারে অবধারিতভাবেই সেগুলি বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কত্ব। পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের পর্যায়েও বহু বিচিত্র রাষ্ট্ররূপের উদ্ভব হবে, কিন্তু সব রূপই শেষপর্যন্ত হবে মূলগত ভাবে এক– সর্বহারার একনায়কত্ব। (চলবে)